বাংলাদেশের সর্বনাশ হয়ে গেছে

দুর্নীতি এখন বাংলাদেশের সর্বত্র। পত্রিকার পাতা খুললেই কোটি কোটি টাকা লোপাট হওয়ার খবর। প্রতিটি ক্ষেত্রেই অপরাধের সঙ্গে রয়েছে ক্ষমতার অতি-নিকট সম্পর্ক। টাকা লোপাটের এই ব্যাপারটা সর্বনাশের কারণ নয়। ব্যাপারটাকে যে আমরা স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছি, সেটাই আমার চোখে সর্বনাশের বড় কারণ।

কয়েক সপ্তাহ ধরে পত্রপত্রিকায় ভয়াবহ সব খবর পড়েছি। পুলিশের প্রহরায়, প্রশাসনের নাকের ডগায় হাজার কোটি টাকার ক্যাসিনো ব্যবসা চলেছে বছরের পর বছর। তার বখরা পেয়েছে সরকারি নেতা থেকে পুলিশের বড় কর্তা। জুয়ার টাকা কাছে রাখতে নেই, পাচার করে দিয়েছেন বিদেশে।

এসব খবর বাসি হতে না–হতেই ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান বললেন, ক্রিকেট খেলাও আসলে একরকমের জুয়া খেলা। যে খেলা রুদ্ধশ্বাসে দেখতে দেখতে আমরা নিজ দলের জয়ের জন্য প্রার্থনা করি, তার সবই নাকি পাতানো। কে জিতবে, কে হারবে; সেসব আগেই ঠিক করা থাকে। ক্যাসিনো ব্যবসার চেয়ে কম রমরমা নয় ক্রিকেট–বাণিজ্য। হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয় এই খেলা নিয়ে। ক্যাসিনো ব্যবসায় যেমন প্রশাসনের ঘাড়ে বন্দুক রেখে সম্রাট সাহেবরা জুয়ার টাকা ঘরে তোলেন, ক্রিকেটেও বাণিজ্যের প্রধান অংশীদার ক্রিকেট পরিচালনা পরিষদ। এই অভিযোগ তুলেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক প্রধান সাবের হোসেন চৌধুরী। তিনি টুইটারে মন্তব্য করেছেন, বিশ্বে বিসিবি একমাত্র ক্রিকেট বোর্ড, যারা ম্যাচ ফিক্সিংকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে।

এই খবর পড়ে কেউ কি বিস্মিত হয়েছেন? পত্রপত্রিকায় ব্যাপারটা তেমন পাত্তাই পায়নি। আমি এ নিয়ে যত লোকের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁদের প্রত্যেকের বক্তব্য, এতে অবাক হওয়ার কী আছে? ক্রিকেট বোর্ডের কেউ যে ধোয়া তুলসী পাতা নয়, সে তো জানা কথা। অন্য কথায়, এমন ভয়াবহ কথা শোনার পরও আমাদের মাথায় আগুন ধরেনি, কারণ, ব্যাপারটা আমাদের কাছে এতটাই ‘নরমাল’।

এটাই হলো আমাদের সর্বনাশের প্রধান কারণ। অপরাধের প্রতিবাদ না করে তা যদি মেনে নেওয়া হয়, তাহলে অপরাধ শুধু বাড়েই।

দুর্নীতি মানে শুধু টাকা এহাত-ওহাত করা নয়। দুর্নীতির মানে ক্ষমতার অপব্যবহার। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বাংলাদেশে কিছু লোক হাজার কোটি টাকার ব্যাংকঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না। তাঁদের হাত দিয়েই হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ঋণ গাফিলতি ও অর্থ পাচারের ফলে ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, নগদ টাকার অভাবে ‘লিকুইডিটি’–এর সমস্যাও প্রকট হয়ে উঠছে। একইভাবে ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় ভয়াবহ মাদক ব্যবসা করে দেশের মানুষকে পঙ্গু করে দেওয়া হচ্ছে। কোনো অর্থপূর্ণ প্রতিবাদ নেই, কোনো কার্যকর প্রতিকার নেই।

কারা এই সব কাজে জড়িত, তা খুব ভালো করে জানা। ক্যাসিনো ব্যবসার ক্ষেত্রেই তো দেখেছি, সবকিছু ঘটছে পুলিশ প্রহরায়। কিন্তু এদের কারও বিরুদ্ধে কুটোটাও তোলা যাবে না। দু-চারটি ছোট মাছ হয়তো জালে ধরা পড়বে, ধরা পড়ছেও, কিন্তু রাঘববোয়ালরা ঠিকই জলকেলি করে বেড়াবেন। মুখে তাঁদের নাম নেওয়াও যেন অপরাধ, পত্রিকার খবর পড়ে সে কথাই মনে হয়। সবাই বলছে ‘গডফাদার’দের কথা, কিন্তু কারা এই গডফাদার, তাঁদের নাম আকারে-ইঙ্গিতে বলতেও আপত্তি।

কে বলবে এই দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে!

ক্ষমতার অপব্যবহার এখন কতটা সর্বব্যাপী ও নির্লজ্জ, তার সর্বশেষ প্রমাণ দিয়েছেন নরসিংদী থেকে নির্বাচিত সাংসদ তামান্না নুসরাত বুবলি।
তিনি ঢাকায়, অথচ তাঁর হয়ে নরসিংদীতে পরপর আটটি পরীক্ষা দিতে বসলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন আট নারী। আইন–কানুন বা নীতি-নিয়মের ব্যাপারে সম্পূর্ণ বেপরোয়া হলেই মানুষ এমন কাজ করতে পারে। বাংলাদেশে এমন ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে, এত ঘন ঘন ঘটছে যে আমরা প্রায় অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছি। পত্রিকায় এই খবর পড়ে বলেছি, এমন কাজ বাংলাদেশেই সম্ভব। কিন্তু কেউ ক্রোধে ফেটে পড়েছি, তা মনে হয় না।

অথচ কোথায় কে ফেসবুকে বানোয়াট কথা বলল, তা নিয়ে গত সপ্তাহে ভোলায় চার–চারটা লাশ পড়ে গেল। রাজনীতিক ও প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের ছাতার নিচে থেকে একদল লোক দেশটাকে দেউলিয়া করে দিচ্ছে, তা নিয়ে বিক্ষোভ নেই, অর্থপূর্ণ প্রতিবাদ নেই, তার কারণ কি এই যে এতে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই? আমাদের অনুভূতি এতটাই ভোঁতা হয়ে গেছে?

এই দুর্নীতির সংস্কৃতির কেন্দ্রে রয়েছে ক্ষমতা ও অর্থের নৈকট্য। যারা ক্ষমতাহীন ও দুর্বল, দুর্নীতি থেকে ফায়দা লোটার সুযোগ তাদের নেই। দুর্নীতি এখন একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপার, যার সঙ্গে রাজনীতিক থেকে পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন থেকে আদালত পর্যন্ত কোনো না কোনোভাবে জড়িত। ক্ষমতাহীন সাধারণ মানুষের পক্ষে এই ব্যবস্থার সাক্ষী ও শিকার হওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই।

এই অপরাধের সংস্কৃতি এক দিনে সৃষ্টি হয়নি, এক দিনে তা শেষও হবে না। কিন্তু অবস্থা বদলাতে হলে তা কোথাও না কোথাও শুরু করতে হবে।
আমরা যদি এই কথায় সম্মত হই যে ক্ষমতা ও অর্থের নৈকট্যের কারণেই দুর্নীতি, তাহলে লক্ষ্য হওয়া উচিত এই দুইকে বিযুক্ত করা। ব্যাপারটা সহজ নয়, আমাদের কর্তাব্যক্তিরা আলুটা-মুলোটা-মার্সিডিজটা হাতাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আর তা করতে গিয়ে ক্যাসিনো ব্যবসা দেখেও দেখেন না, ম্যাচ ফিক্সিং হচ্ছে জেনেও না জানার ভান করেন, টাকা পাচার হচ্ছে জেনেও সে পাচারের ফাঁকফোকর খোলা রাখেন। ফলে মধু থেকে মৌমাছিকে দূরে রাখা যাবে না।

আমাদের দুর্নীতির সংস্কৃতির একটি প্রধান কারণ রাজনীতিতে অর্থের অনুপ্রবেশ। রাজনীতি শুধু ক্ষমতারই উৎস নয়, দুর্নীতিরও। বাংলাদেশে এখন রাজনীতি মানে নির্বাচনের রাজনীতি। আর এই নির্বাচনী রাজনীতির জোগানদাতা হলো অর্থ। বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, অর্থের ভূমিকা কমানোর একটা পথ নির্বাচনী রাজনীতিতে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা যাবে, তার সীমা বেঁধে দেওয়া ও রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে নির্বাচন পরিচালনা। পৃথিবীর অনেক দেশেই এই কথা মাথায় রেখে নতুন নির্বাচনী নীতিমালা তৈরি হয়েছে। শুধু অর্থের দাপটেই সৎ ও যোগ্য লোক রাজনীতিতে জায়গা পায় না। অর্থের দাপট কমানো গেলে সৎ মানুষেরা রাজনীতিতে আসার সুযোগ পাবে, আমাদের নষ্ট সংস্কৃতির চেহারাটাই বদলে যাবে। বাংলাদেশের সর্বনাশ ঠেকানোর এটা একটা সম্ভাব্য পথ।

এই কাজ করতে হলে বিড়ালের গলায় যে ঘণ্টা পরাতে হবে, সে কাজটি কে করবে, তা আমি জানি না। তবে তার সম্ভাব্য উত্তর হিসেবে আমি বঙ্গবন্ধুর জীবনের একটা ঘটনা উল্লেখ করছি। সেটা ১৯৫৭ সাল, আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেছেন। সে সময় তাঁর একটি প্রধান দায়িত্ব ছিল দলীয় কার্য পরিচালনার জন্য অর্থ সংগ্রহ। ২৬ সেপ্টেম্বর নিজের দলীয় কার্যকলাপ নিয়ে তাঁর কথা হয় ঢাকায় মার্কিন কনসাল জেনারেল উইলিয়াম এল এস উইলিয়ামসের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেন, মন্ত্রী হিসেবে দলের জন্য অর্থ চাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। কাজটা অশোভন হতো। তিনি বলেন, ‘কিন্তু এখন আমি নিজ দলের জন্য তহবিল গড়ছি। দলীয় প্রত্যেক মন্ত্রীর জন্য চাঁদা ধার্য করা হয়েছে মাসিক ১০০ টাকা, আর প্রতি সাংসদের জন্য ৪ টাকা।’

মার্কিন সরকারের অবমুক্ত দলিল খুঁজলে আপনারাও এই তথ্য পেয়ে যাবেন।

হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি