বিদ্যালয়ে উত্ত্যক্ত করা

শিশু–কিশোরদের মধ্যে পরস্পরকে টিটকারি করা, খোঁচা দিয়ে কথা বলা, নানা মাত্রায় শারীরিক–মানসিক যন্ত্রণা দেওয়ার প্রবণতা সব সমাজেই কমবেশি আছে। কোনো সমাজে এটা একটা বড় সমস্যা হিসেবে গুরুত্ব পায়, কোনো সমাজ এ বিষয়ে খুব একটা সচেতন নয়। প্রকৃতপক্ষে এটা একটা বড় সমস্যা। এর ফলে শিশু–কিশোরদের স্বাভাবিক আনন্দময় জীবনযাপন ও পড়াশোনা ব্যাহত হয়, তাদের ভালোভাবে বেড়ে ওঠা বাধাগ্রস্ত হয়। শুধু তা–ই নয়, শৈশব–কৈশোরে অপ্রীতিকর ও নির্মম অভিজ্ঞতার নেতিবাচক প্রভাব পরিণত জীবনেও থেকে যেতে পারে। তাই পশ্চিমা দুনিয়ায় শিশু–কিশোরদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উত্ত্যক্ত করার বিরুদ্ধে বেশ শক্ত বিধিবিধান অনুসরণ করা হয়, শিক্ষকেরা এ বিষয়ে সতর্ক ও সচেতন থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশে সমস্যাটি এখনো প্রায় অনালোচিত রয়ে গেছে। অবশ্য যখন কোনো ঘটনা মর্মান্তিক রূপ ধারণ করে, তখন কথা ওঠে। যেমন সম্প্রতি বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘র‍্যাগিং’ নামে নির্যাতনচর্চার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠলে, কেউ কেউ শিশু–কিশোরদের বিদ্যালয়ে উত্ত্যক্ত করার প্রসঙ্গটিও তুলেছেন। 

ইংরেজি শব্দ ‘বুলিং’ বলতে যত রকমের হয়রানিমূলক আচরণ বোঝানো হয়, আমরা সেসবকেই বলছি উত্ত্যক্ত করা। আমাদের দেশের বিদ্যালয়গুলোতে শিশু–কিশোরেরা তাদের সহপাঠী ও বয়োজ্যেষ্ঠদের দ্বারা উত্ত্যক্তের শিকার হয়, এমন অভিযোগ অনেকেই করে। কিন্তু এর প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না। কারণ, শিশু–কিশোরেরা এ ধরনের আচরণের শিকার হলে সাধারণত তা প্রকাশ করতে চায় না; তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিষণ্ন হয়ে যায়, কেউ বিদ্যালয়ে যেতে ভয় পায় কিংবা গড়িমসি করে। মনোযোগী বাবা–মায়েরা সেটা লক্ষ করলে নানা কৌশলে হয়তো শিশুটি তার অসহায় অবস্থার কথা বলে। কিন্তু তাতে তেমন কোনো প্রতিকার মেলে না, যদি তার অভিভাবক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগটি না তোলেন। অনেক অভিভাবকই অভিযোগ তোলেন না এই ভেবে যে তাতে প্রতিকার মেলার সম্ভাবনা কম; বরং উল্টো তাঁর সন্তানের নিগ্রহ আরও বাড়ার আশঙ্কা করেন। ফলে আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে শিশু–কিশোরদের উত্ত্যক্ত হওয়ার প্রকৃত চিত্র অজানাই থেকে যাচ্ছে।

অবশ্য জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বিদ্যালয়গুলোতে ২৩ শতাংশ ছেলেমেয়ে এই নিগ্রহের শিকার হয়। অর্থাৎ, সমস্যাটি বেশ গুরুতর। কারণ, উত্ত্যক্তের শিকার শিশু–কিশোরেরা নানা ধরনের ঝুঁকির মধ্যে বেড়ে উঠছে। ইউনেসকোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই শিশু–কিশোরেরা নিজেদের বিদ্যালয়েই অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন ও একাকী বোধ করে। তারা নানা অজুহাতে বিদ্যালয় এড়াতে চায়। তাদের অর্জিত শিক্ষা ও পরীক্ষার ফল ভালো হয় না। সেটা আবার তাদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে। শুধু তা–ই নয়, কোনো কোনো শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা রাতে ভালো ঘুমাতে পারে না; তাদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধের অভাব দেখা দেয়, কারও কারও মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা দিতে পারে। এই সবকিছুর ফলই হয় নেতিবাচক, যার নেতিবাচক প্রভাব শিশু–কিশোরদের ভবিষ্যৎ জীবনেও থেকে যায়। 

আমাদের বিদ্যালয়গুলোর প্রায় অজানা এই পরিস্থিতির অবসান ঘটানোর উদ্যোগ অবশ্যই নিতে হবে। জাতিসংঘের সংস্থা ইউনিসেফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, উত্ত্যক্তবিরোধী একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। গত বছর রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করার পর হাইকোর্টও এ বিষয়ে একটি নীতি প্রণয়নের আদেশ দিয়েছিলেন। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, একটি খসড়া নীতি তৈরি করা হয়েছে, সেটা চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। ওই নীতিতে উত্ত্যক্তকারীদের শাস্তির বিধান থাকবে বলেও বলা হয়েছে। 

আমরা আশা করব নীতিটি দ্রুত চূড়ান্ত করা হবে। তবে নীতি প্রণয়নই শেষ কথা নয়, তা বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগও নিতে হবে।