সবখানেই সেই লোমশ ভয়াল হাত

দুই কন্যার সামনে বাবাকে নগ্ন করে পেটানোর ভিডিও দেখতে দেখতে পড়ছি মনপুরায় শিশুসন্তানের সামনে মাকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করার খবর। দুটি ঘটনাই ভোলার। শেষ লঞ্চ না পেয়ে সন্তানসহ জননী একটা স্পিডবোটে করে বাড়ি ফিরতে গিয়েছিলেন। পথে পান চার পুরুষ সহযাত্রী। চারজন মিলে তাঁকে এক চরে নামিয়ে নির্যাতন করেন। ধরিত্রীর এতেই কেঁপে ওঠার কথা। কিন্তু কলিকালে কিছুই কাঁপে না, টনক নড়ে না; বরং দৌড়ে আসেন নতুন ধর্ষক। স্পিডবোটের চালক তাঁর মালিক ছাত্রলীগের নেতাকে খবর দেওয়ামাত্রই মওকার গন্ধ পেয়ে তিনি ছুটে আসেন। পুনরায় জঙ্গলে নিয়ে জননীকে আবারও ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের সালিসের নামে পুনরায় ধর্ষণ। সন্তান বা স্বামীকে বেঁধে রেখে ধর্ষণ। মা-মেয়েকে একসঙ্গে ধর্ষণ—এসব আমাদের ‘নিউ-নরমাল’ বাস্তবতা। এসব এই দেশের নতুন স্বাভাবিকতা। যুদ্ধের সময় এমন চরম নির্দয়তা ঘটতে দেখাকে অনেকে স্বাভাবিক বলে থাকেন, কিন্তু যুদ্ধ তো নেই বাংলাদেশে যে ঘটতে ঘটতে সব স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে!

ছাত্রলীগের নেতাটিও ‘স্বাভাবিক’ কাজই করেছেন। ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকেই ‘খারাপ’ ভাবার লোকই দেশে বেশি। সমাজ তার পাশ থেকে সরে যায়। সুতরাং ছাত্রলীগের নেতা এসে যখন দেখলেন তাঁর আগেই চারজন পুরুষ নারীটিকে ‘অপবিত্র’ ও ‘ভোগযোগ্য’ করেই ফেলেছেন, তখন তিনিই–বা বাদ যাবেন কেন? পঞ্চম পুরুষ হিসেবে তিনিও তাঁকে ‘ব্যবহার’ করতেই পারেন। চার ধর্ষককে পিটিয়ে তাঁদের টাকাপয়সা কেড়ে নিয়ে তাড়িয়ে দিতে পারেন যিনি, সেই ক্ষমতার জোরে তো তিনি অপরাধীদের পুলিশে দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি চাননি ঘটনা জানাজানি হোক। হয়তো ভেবেছেন, চারজনের পরে পঞ্চমজনের ধর্ষণে কী আর উনিশ-বিশ হবে! তা ছাড়া ভিডিও করে যেহেতু রেখেছেন, সেহেতু লোকলজ্জার ভয়, স্বামী দ্বারা পরিত্যক্ত হওয়ার ভয়ে নারীটি নরকের পঞ্চম স্তরের অভিজ্ঞতা চেপে যাবেন।

শতকোটি অভিবাদন সেই নারীকে, তিনি চেপে যাননি। ফলে ছাত্রলীগের ওই নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। কিন্তু নারীর ভয় কমল নাকি বাড়ল? এমন বেকায়দায় পড়া নারী যাত্রীই শুধু নন, মামলার আসামি হয়ে পালিয়ে থাকা কিংবা জেলে থাকা ব্যক্তির স্ত্রীরাও দেখা যাচ্ছে ‘অরক্ষিত’—সহজ টার্গেট। সেপ্টেম্বর মাসের শেষেও যশোরে এমন ঘটনা ঘটেছে। স্বামী জেলে যাঁর, সেই নারীর বাড়িতে এসে দুই পুলিশ তাঁকে ধর্ষণ করে যায়। একই মাসে খুলনায় থানায় আটকে ধর্ষণ করা হয় এক নারীকে। মনপুরার ধর্ষক দেখিয়েছিলেন ভিডিও প্রকাশের ভয়, অভিযুক্ত পুলিশেরা দেখায় মাদক মামলার ভয়। এই লেখকের ২০১২ সালের এমন কিছু ঘটনা ধরে লেখায় দেখছি, কুষ্টিয়ায় থানায় ছয় দিন আটকে রেখে মা ও মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ‘অপরাধী’ ধরতে এসে সুযোগ নেওয়া হয়। খবরটি জানাজানি হলে তাঁদের ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। আদালত জামিন দিলে আবার গ্রেপ্তার করা হয় খুনের মামলায়। আবার তোলা হয় আদালতে। সেই আদালত এমনই আদালত, নিপীড়িতদের ফরিয়াদ না শুনে তাঁরা পুলিশের চাওয়ামতো মা ও মেয়েকে জেলে পাঠান। ওই বছরই ঢাকার মিরপুরেও নিহত ব্যবসায়ীর স্ত্রী-কন্যাকে একইভাবে ধর্ষণ করে পুলিশ।

ভাবি, কী ট্রমা জন্ম নেয় এমন নারীদের মনে। মনপুরার কথাই বলি। ছাত্রলীগ নেতা এসে ‘উদ্ধার’ করার পর হয়তো তিনি ভাবলেন দুঃসময়ের প্রহর বুঝি ফুরাল। কিন্তু নরকের শেষ দরজা তখনো দূরে। ধর্ষকদের হাত থেকে হাতে বদল হতে হতে কী দশা হয়েছিল তাঁর? মানুষের ওপর, সরকারের ওপর, আইনের ওপর, মানবাধিকারের ধারণার ওপর কি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি? স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকেরা কি এ রকম বেওয়ারিশ নাকি? তাদের নিয়ে যা খুশি তা করা চলে নাকি?

দেশে নাকি গরু-ছাগলের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু খুনি-ধর্ষকের সংখ্যাও যে বেড়েছে, জরিপ করে তা বলবে কোন সংস্থা? রাজনীতি নাকি মানুষকে রক্ষা করার জন্য, পুলিশ নাকি অপরাধ দমনের জন্য। কিন্তু কে রক্ষক আর কে ভক্ষক, সব যে গুলিয়ে যাচ্ছে? পরিসংখ্যান বলবে, হত্যা-নির্যাতন-ধর্ষণ ক্ষমতাবহির্ভূত লোক কম করে। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা এখানে দুজনে দুজনার হয়ে কারবার করে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের সংগঠনগুলো হয়ে পড়েছে অপরাধ-নির্যাতনের নেটওয়ার্ক। সেই নেটওয়ার্কের দুই একটি গ্রন্থিতে সম্প্রতি ধরপাকড় চলছে বটে, কিন্তু সর্বাঙ্গে যখন পচন লাগে, তখন মৃদু সার্জারি করে কি দেহরক্ষা হবে? ব্যক্তি ধর্ষকের শাস্তি যদিবা হয়ও, কিন্তু যে ক্ষমতার তাপে গরম হয়ে তাঁরা ধর্ষণকে ডাল–ভাত মনে করছেন, সেই ক্ষমতাকে থামানো যাবে কী করে?

মানুষ এখন বড় অসহায়। আশ্রয়ে খোঁজে কোন দরজায় কড়া নাড়বে ভিক্টিমরা? উত্তম কুমার অভিনীত একটা ভূতের সিনেমার গল্পের মতো হয়েছে জাতীয় জীবন। অন্ধকার ভূশণ্ডির মাঠ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে ফিরছিল এক লোক। বৃষ্টি ঝরছে টুপটাপ, অদূরে জঙ্গল। এর মধ্যে সে দেখে একটা কালো লোমশ বড় নখওয়ালা হাত পেছন থেকে তার ঘাড়ের ওপর এসে পড়ছে। ভয়ে চিৎকার করে লোকটা আরও জোরে সাইকেল চালায়। আবারও সেই ভয়াল হাত তাকে ছোঁয়। হাত ছুটতে ছুটতে পথিক পায় এক বন্ধ বাজার। দেখে এক পাহারাদার বসে ঝিমায়। তাকে জাগিয়ে ঘটনাটা বলে লোকটা। সব শুনে প্রহরী চাদরের ভেতর থেকে একটি হাত বের করে বলে, ‘কেমন হাত দেখেছিলেন, এ রকম?’ পুনরায় সেই লোমশ কালো হাত! সেখান থেকে পালিয়ে ছুটতে ছুটতে লোকটা এসে পড়ে এক থানার সামনে। ভেতরে টেবিলের ওপারে বসা এক দারোগা। টিমটিমে বাতি জ্বলছে দেখে লোকটা জানে পানি পায়। বারান্দা টপকে দৌড়ে গিয়ে দারোগাকে বলে, ‘ভাই বাঁচান’।

দারোগা তাকে বসিয়ে ধীর-সুস্থে ঘটনা শোনে। পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। জিজ্ঞাসা করে, ‘কেমন হাত দেখেছিলেন বলেন তো?’ লোকটা বলে। জবাব শুনে দস্তানাটা খুলে হাতটা সামনে বাড়িয়ে দারোগা বলে, ‘এ রকম দেখেছিলেন, এ রকম?’ তৃতীয়বারের মতো সেই লোমশ কালো হাতের থাবা দেখে লোকটার যে দশা, বোধ করি আমাদেরও সেই দশা।

ধর্ষক নেতাটির গ্রেপ্তারের খবর ইতিবাচক। বাকি চারজনকেও পুলিশ চাইলে খুঁজে বের করতে পারবে। কিন্তু ভাবছি ওই নারীর আড়াই বছরের শিশুটির কথা। এ ঘটনা কি তাকে বদলে দেবে? সম্প্রতি আলোড়ন জাগানো হলিউডি মুভি ‘জোকার’ দেখা হলো। কমেডিয়ান চরিত্রটির মানসিক অসুখ। হঠাৎ হঠাৎ তার প্রচণ্ড হাসি পায়, হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলে সে। জীবনে কোনো কিছুই হলো না তার। না প্রেম না স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ানের চাকরি। তার বন্ধু হয় না, রাস্তায় বখাটেরা তাকে পেটায়। জায়গায়-বেজায়গায় নার্ভাস হাসির জন্য বিপদেও পড়তে হয়। পরে জানা যায়, খুব ছোটবেলায় মা-সহ ছেলেটি নির্যাতিত হয়েছিল। তখনই তার মাথায় কোনো সমস্যা হয়। জীবনটা হয়ে পড়ে অভিশপ্ত। ছবির শেষে দেখা যায়, শহরের মেয়র-স্ত্রীসহ নিহত হলো কিশোর পুত্রের সামনে। থম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ওই ছেলেকে দেখে দর্শকের মনে পড়বে জোকারের কথা। এমন কোনো আঘাতই হয়তো জোকারকে জীবনের জন্য অকেজো করে ফেলেছিল।

এই ‘জোকার’ একদিন বিদ্রোহ করে। তার আজন্ম অপমান লাঞ্ছনার শোধ নেয়। সে হয়ে পড়ে হাজারো বিদ্রোহী তরুণের নায়ক। তাদের সবার মুখে জোকারের মুখোশ। তারা চায়, মানুষকে মানুষের মতো দেখা হোক।

আমাদের সমাজে কেবল নির্যাতক নারী-পুরুষই বাড়ছে না, বাড়ছে নির্যাতিত হয়ে মানসিক আঘাতগ্রস্ত নারী-পুরুষের সংখ্যা। বাড়ছে বাবা-মাকে ভয়াবহভাবে নির্যাতিত বা নিহত হতে দেখা শিশু-কিশোরের সংখ্যা। গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্তানদের মানসিক বিকাশ থমকে যাচ্ছে, কেউ কেউ আত্মহত্যাও করেছে বলে জানা যাচ্ছে। জোকারের মতো তাদের জীবনও যেন ধ্বংস হয়ে না যায়। ওই মর্মান্তিক কৌতুকটি যেন সত্যি না হয় যে অসুখী এক লোক বন্ধুকে বলছে, ‘আর কত দিন এই যন্ত্রণা সহ্য করব ভাই।’

বন্ধুর উত্তর, ‘বেশি না আর কিছুদিন করো।’
‘তারপর? তারপর কী হবে? শান্তি পাব?’
জবাব আসে, ‘তারপর তো তুমি মারাই যাবে, তখন কষ্ট করবে তোমার সন্তান।’

অমানবিকতার চাইতে ভয়াবহ হলো নিষ্ঠুরতাকেই ‘নিউ-নরমাল’, তথা নব্য–স্বাভাবিক বলে ভাবা।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]