স্বাভাবিক প্রসবে উদ্বুদ্ধকরণ ও অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান সেকশন বন্ধে করণীয়

>

১৭ অক্টোবর ২০১৯, প্রথম আলোর আয়োজনে এবং ডেভেলপিং মিডওয়াইভস প্রজেক্ট-ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, আইসিডিডিআরবি, নারী ও শিশুস্বাস্থ্য কেন্দ্র, অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনিকলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) ও সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের সহযোগিতায় ‘স্বাভাবিক প্রসবে উদ্বুদ্ধকরণ ও অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান সেকশন বন্ধে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

সঞ্চালক

আব্দুল কাইয়ুম: সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সমাপনী বক্তব্য

ফিরোজ চৌধুরী: সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনায় সুপারিশ

• প্রতিটি হাসপাতালে সুযোগ–সুবিধাসম্পন্ন প্রসবকক্ষ থাকা আবশ্যক

• প্রসূতি মায়ের সঙ্গে কমপক্ষে একজন সঙ্গী রাখার ব্যবস্থা করতে হবে

• সরকারি হাসপাতালে প্রসূতি মায়ের চিকিৎসাসুবিধা বাড়ানো দরকার

• স্বাভাবিক প্রসবে উদ্বুদ্ধকরণের বিষয়ে সবার সচেতনতা বাড়াতে হবে

• বেসরকারি হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় নীতিমালা প্রয়োজন

• গ্রামীণ এলাকায় পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও মিডওয়াইফের ব্যবস্থা রাখতে হবে

• মিডওয়াইফারি শিক্ষার্থীদের দ্রুত লাইসেন্সের ব্যবস্থা করা দরকার

• নীতিমালা ও আইনে চিকিৎসকদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ–সুবিধা থাকা প্রয়োজন

• নীতিমালায় হাসপাতালে তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে

• দরিদ্র মায়েদের সরকারি চিকিৎসাসেবার আওতায় আনা উচিত

• হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় কায৴কর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে

আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম

আমাদের দেশে সন্তান প্রসবে কখনো কখনো অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান সেকশন করা হয়। এতে মা ও নবজাতককে অনেক সময় ঝুঁকির মুখে পড়তে হয়। অথচ স্বাভাবিক প্রসবে জন্ম নেওয়া শিশু অনেক বেশি সুস্থ, সবল এবং রোগ প্রতিরোধে বেশি সক্ষম। অপরিহার্য হলে নিশ্চয়ই সিজারে যেতে হবে। কিন্তু স্বাভাবিক প্রসব যে সবার জন্য ভালো এ সচেতনতা বাড়াতে হবে।

এ বিষয়ে এখন কথা বলবেন ইশতিয়াক মান্নান।

ইশতিয়াক মান্নান
ইশতিয়াক মান্নান


ইশতিয়াক মান্নান
আজকে দুটি বিষয় নিয়ে কথা হবে। প্রথমত, স্বাভাবিক প্রসবের নিশ্চয়তা। দ্বিতীয়ত, অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান সেকশন বন্ধে করণীয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১০-১৫ শতাংশের বেশি প্রসূতি মায়ের সিজারের প্রয়োজন হতে পারে না। মায়ের অবস্থা সংকটাপন্ন হলেই সিজার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। সিজারের হার ১৫ শতাংশের বেশি হলেও মাতৃমৃত্যুর হার কমছে না। এতে কোনো বাড়তি সুবিধা নেই। সিজার ও মাতৃমৃত্যুকে আলাদাভাবে দেখা যাবে না। মাতৃমৃত্যুর সঙ্গে সিজারের সম্পর্ক আছে।

২০১৪ সালে বিডিএইচএস নীতি আলোচনায় আসে। সেখান থেকে সি সেকশনের বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু হয়। ২০১৬ সালের হিসাব অনুযায়ী, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় ৪ শতাংশ, সরকারি হাসপাতালে ২৮ শতাংশ, বেসরকারি হাসপাতালে ১৩ শতাংশ, বাড়িতে ৫৩ শতাংশ নারী প্রসব করত। আমরা বিডিএইচএস নীতিমালায় ২০১৪ সালে প্রস্তাব করি, ২০৩০ সালের মধ্যে যেন সরকারি হাসপাতালে ৪৪ শতাংশ, বেসরকারি হাসপাতালে ৪৯ শতাংশ, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় ৫ শতাংশ ও বাড়িতে ২ শতাংশ নারী প্রসব করার ব্যবস্থা করা হয়। এই সংখ্যায় পৌঁছাতে হলে, আমরা হিসাব করে দেখেছি, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ১ মাসে গড়ে ২৪টি প্রসূতি মায়ের প্রসবের ব্যবস্থা করতে হবে। ২২ হাজার প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ লাগবে। এ জন্য নতুন করে বিনিয়োগের দরকার নেই। বিদ্যমান অবকাঠামো দিয়েই এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব।

সরকারি হাসপাতালগুলোয় প্রসব করানোর সুবিধা বাড়লে দরিদ্র প্রান্তিক মানুষেরা বেশি সুবিধার আওতায় আসবে।

সিজারিয়ান সেকশনের সঙ্গে অন্যান্য সমস্যাও জড়িত আছে। এ জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। ২০ লাখ সিজারিয়ান শিশুকে হিসাবে নিয়ে, আমেরিকায় একটি জরিপে দেখানো হয়েছে যে সিজারিয়ান শিশুদের সঙ্গে অটিজমের একটি সম্পর্ক আছে।

বিডিএইচএসের ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী আমাদের দেশে ৩৩ শতাংশ প্রসব সিজারের মাধ্যমে হয়। এই সি সেকশন হার বাড়ার জন্য বিভিন্ন বিষয় দায়ী। এর মধ্যে রয়েছে অদক্ষতা, অতিরিক্ত চিকিৎসা নেওয়ার মনোভাব, ব্যবসায়িক চিন্তাধারা, হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণের অভাব।

আমাদের দেশে চিকিৎসা খাতে কোনো নিরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। সি সেকশনে প্রতিবছর ৪৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হয়।

২০১৪ সালের পর থেকে অপ্রয়োজনীয় সি সেকশনের বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু হয়েছে। সাংবাদিকেরা বিভিন্ন প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। তাতে এটি বন্ধে জনসাধারণের মধ্যে চাহিদা তৈরি হয়েছে।

অপ্রয়োজনীয় সি সেকশন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা, সভা, সেমিনার হচ্ছে। জনগণ ও চিকিৎসক সবার মধ্যেই এর বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়ানো উচিত। আরও দক্ষ মিডওয়াইফ তৈরিতে মনোযোগ দিতে হবে। আমাদের দেশে মিডওয়াইফ প্রয়োজন ২২ হাজার। কিন্তু আছে মাত্র ৫ হাজার।

মো. শামসুল হক
মো. শামসুল হক


মো. শামসুল হক
বর্তমানে গ্রামে দক্ষ নার্সের সংখ্যা ১২ হাজার ৪০৮। ৩৩৭টি উপজেলায় ১ হাজার ২০০ মিডওয়াইফ নিয়োজিত আছেন। আরও ৮০০ জন সামনে নিয়োগ হবে।

২০১৮ সালের এক হিসাব অনুযায়ী জেলা হাসপাতালে ৭২ হাজার ও উপজেলা হাসপাতালে ১ লাখ ৫২ হাজার প্রসূতি মা প্রসব করেছেন। এই হার ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালে ২০ শতাংশ বেড়েছে। সব উপজেলা হাসপাতালে দৈনিক ২৪ ঘণ্টা প্রসূতি মায়েদের সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

প্রথমেই যেন প্রসূতি মায়েরা চিকিৎসা পান, সেটার ব্যবস্থা থাকা উচিত। স্থানান্তরের জন্য আমরা উপজেলা হাসপাতালে দুটি অ্যাম্বুলেন্স রাখার ব্যবস্থা করেছি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নীতি অনুসারে, প্রসূতি মায়েদের জরুরি প্রয়োজনে সিজারের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে তাঁদের সিজার করা যাবে না। এখন পর্যন্ত ৫০ শতাংশ প্রসব গ্রামে হয়। সেখানে দক্ষ মিডওয়াইফ নেই। ধাই দিয়ে প্রসবের কাজ করানো হয়।

জাতীয় কর্মপরিকল্পনার আওতায় শতভাগ মাকে নিয়ে আসতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ মা চিহ্নিত করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তঁাদের সেবার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

মো. মনজুর হোসেন
মো. মনজুর হোসেন


মো. মনজুর হোসেন
অপ্রয়োজনীয় সি সেকশনের বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ জন্য সামাজিকভাবে কাজ করাদরকার। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দরিদ্র মায়েদের সরকারি সুবিধার আওতায় আনতে হবে।

আমাদের মূল কার্যক্রম উপজেলা পর্যায়ে। সেখানে সেবা দেওয়া একটু কঠিন। আরও দক্ষ মানবসম্পদ লাগবে। আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব ৪৭ শতাংশ। বাড়িতে ৫৩ শতাংশ মা প্রসব করে থাকেন।

অতিরিক্ত সি সেকশন কমানোর জন্য বাল্যবিবাহ ও গর্ভধারণ কমাতে হবে। তার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

শামস এল আরেফিন
শামস এল আরেফিন


শামস এল আরেফিন
গ্রামে মৌলিক সেবার মান আগের তুলনায় বেড়েছে । তবে এখানে বেসরকারি হাসপাতালের প্রভাব বেশি। বর্তমানে যেসব সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে, তা পাঁচ–ছয় বছর আগেও অনেক দুষ্প্রাপ্য ছিল। গ্রামীণ চিকিৎসাসেবায় পরিবর্তন হচ্ছে। দেরিতে হলেও পরিবর্তন হচ্ছে।

গ্রামের বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে সিজারের প্রবণতা বাড়ছে। এটা আমাদের জন্য দুশ্চিন্তার বিষয়। এই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে কাজ করতে হবে।

জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় অনেক কিছুই নেওয়া হয়েছে। আরও বিষয় যোগ করা লাগবে। আমাদের দেশে বেসরকারি খাত অনেক বড়। এগুলো শক্তহাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শুধু প্রসবের ক্ষেত্রেই নয়, অন্য সব দিকেই খেয়াল রাখতে হবে। এদের সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে কাজ করতে হবে। কিন্তু এ জন্য কোনো নির্দেশনা নেই।

রওশনারা বেগম
রওশনারা বেগম


রওশনারা বেগম
প্রসবকক্ষ ভালো করতে হবে। এই কক্ষ মায়েদের জন্য সুবিধাজনক হওয়া দরকার। বেসরকারি হাসপাতালে সি সেকশন আছে। কিন্তু প্রসবের সুযোগ–সুবিধা সব ক্ষেত্রে উন্নত না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে প্রসবের সুযোগ–সুবিধা অনেক উন্নত হয়েছে। দেশের সব হাসপাতালে পর্যাপ্ত সুযোগ–সুবিধাসহ প্রসবকক্ষের ব্যবস্থা করতে হবে। এটি সনদপ্রাপ্ত দক্ষ মিডওয়াইফের নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার।

প্রসবের সময় মায়ের সঙ্গে একজন সঙ্গী থাকা উচিত। এতে তিনি মানসিক শান্তি পাবেন। তাঁর ব্যথাও তুলনামূলক কম হবে। তাঁর হাঁটাচলা, কথা বলা, গল্প বলার ব্যবস্থা করা জরুরি।

গ্রামে, বস্তিতে বেশি করে স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থা করতে হবে। পরামর্শের জন্য দক্ষ মিডওয়াইফের সাহায্য নেওয়া যায়। তঁাদের পরার্মশক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া উচিত। এ কাজ একা করা যাবে না। সরকারি, বেসরকারি, উন্নয়ন সহযোগী—সবার সহযোগিতা লাগবে। আমরা সবাইকে নিয়ে বসেছি।

দেওয়ান মো. ইমদাদুল হক
দেওয়ান মো. ইমদাদুল হক


দেওয়ান মো. ইমদাদুল হক
২০১০ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তিন হাজার মিডওয়াইফারি পদ সৃষ্টি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সে অনুযায়ী কাজ হয়েছে। বর্তমানে আরও পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলমান।

বিডিএইচএসের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ৩৩৭টি উপজেলায় ১ লাখ ২৬ হাজার প্রসূতি মা সরকারি হাসপাতালে প্রসব করেছেন। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের সদর হাসপাতালের অনেক হাসপাতাল ভালো দায়িত্ব পালন করছে। তারা কীভাবে কাজ করছে, তা থেকে ধারণা নিয়ে অন্য যেসব হাসপাতাল কাজ করতে পারছে না, তাদের শেখানো যায়।

জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় মিডওয়াইফদের জন্য ব্যবস্থা থাকা দরকার। ওজিএসবি ও সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান সেকশন বন্ধে কাজ করছে।

৪২১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রসূতি মায়েদের সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। সেখানে প্রাথমিকভাবে তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

স্বাভাবিক প্রসবকক্ষে গোপনীয়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে প্রতিটি কক্ষের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এগুলো সব জায়গায় ঠিক করতে হবে। প্রসূতি মায়ের সেবায় মিডওয়াইফদের কাজে লাগানো যায়।

পাপুয়া নিউগিনি থেকে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এসেছিলেন। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিন দিন কাজ করেছিলেন। সেখানে তিনি এই তিন দিনের জন্য কোনো সিজার করতে দেননি।

সিজার করানোর জন্য ছোট পরিসরে অনেককেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।

রাশনা ইমাম
রাশনা ইমাম


রাশনা ইমাম
বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন এবং প্রাইভেট ক্লিনিক আইন আছে। কিন্তু এগুলোর বাস্তবায়ন নেই। তা ছাড়া মাতৃমৃত্যু রোধেও কোনো আইন বা বিধিমালা নেই। আইন হওয়ার আগে নীতিমালা হয়।

বাংলাদেশে অপ্রয়োজনীয় সি সেকশন রোধে কোনো আইন বা নীতিমালা নেই। মূলত এ কারণেই রিট করা হয়েছে। এরপর কোর্ট কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা চাই, এ ব্যাপারে আইন না হওয়া পর্যন্ত নীতিমালা তৈরি করে সেগুলো মানতে বাধ্য করা হোক।

নীতিমালায় তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ব্রাজিলে নীতিমালায় তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে। আমরা চাইলে সেখান থেকে শিখতে পারি।

তা ছাড়া চিকিৎসকেরা যেন নিরাপদে ও নির্ভয়ে চিকিৎসা দিতে পারেন, তাঁদের সুরক্ষায় আইন থাকা প্রয়োজন। চিকিৎসকদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করলে তাঁরা সুচিকিৎসা দিতে পারবেন না।

খুরশিদ তালুকদার
খুরশিদ তালুকদার


খুরশিদ তালুকদার
২০১৭ সালে আশুলিয়ায় প্রতিষ্ঠিত আমাদের হাসপাতাল স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে অনেক ভালো করছে।

সিজার কিংবা স্বাভাবিক প্রসবের আগে প্রসূতি মায়ের আত্মীয়স্বজনকে সবকিছু বলা দরকার। সিজারের প্রয়োজনীয়তা থাকলে সে সম্পর্কে তাদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য দিতে হবে। এ জন্যই পরামর্শের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশে চিকিৎসাক্ষেত্রে নীরব থাকার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। চিকিৎসকেরা রোগীদের সঙ্গে কথা বলতে চান না।

প্রসূতি মায়েদের সম্মানজনক প্রসব–সম্পৃক্ত সেবা দেওয়া প্রয়োজন। ব্যথামুক্ত প্রসব শুধু ওষুধের মাধ্যমে হয় না। এটা মানসিক বিষয়। তাই এই সময় মায়েদের মানসিকভাবে সহযোগিতা দিতে হবে। তাঁদের গোপনীয়তা রক্ষা করা আবশ্যক।

 একটু ভুল চিকিৎসা হলে রোগীর আত্মীয়স্বজনের রাগ, ক্ষোভ থাকবে। তঁাদের সঙ্গে চিকিৎসা শুরু করার আগে সবকিছু বলে নিলে অনেক সময় ঝামেলা কমে যায়।

আয়ারল্যান্ডের স্বাভাবিক প্রসব বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রবসন সিজার করানোর প্রয়োজনীয়তা দেখানোর জন্য, হাসপাতাল ও প্রসূতি মায়ের অবস্থা বিভিন্ন ভাগে ভাগ করেছেন। এ পদ্ধতিতে কোথায় ভালো সেবা দেয়, কোথায় খারাপ সেবা দেয় ইত্যাদির মাধ্যমে সব কটি হাসপাতালের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে কাজ করা হয়। আমরা আমাদের হাসপাতাল ও আয়ারল্যান্ডের একটি হাসপাতালের সঙ্গে রবসন তত্ত্ব ব্যবহার করে তুলনা করেছি। তা ছাড়া আমাদের দেশে কেউ নিজেকে স্বাভাবিক প্রসব প্রক্রিয়ার বিশেষজ্ঞ হিসেবে দাবি করে না। এটাও একটা সমস্যা।

সেলিনা আমিন
সেলিনা আমিন


সেলিনা আমিন
আমরা প্রশিক্ষণ দিয়ে মিডওয়াইফ তৈরি করে দিচ্ছি। অন্যরা প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফদের এখান থেকে নিয়ে তাদের হাসপাতালে নিয়োগ দিচ্ছেন।

মিডওয়াইফ কী এবং তাঁদের কাজ কী, এটা নিয়ে সবার স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। মিডওয়াইফদের আন্তর্জাতিক মানের করতে হলে, দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ভালো হওয়া আবশ্যক। তাঁদের জন্য সনদের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

এখন মায়েরা বলেন, তাঁরা প্রসবের ব্যথা সহ৵ করতে পারবেন না, তাই তাঁরা সিজার করতে চান। তাঁদের সিজারের অসুবিধা জানাতে হবে।

বেসরকারি হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। তারা অনেক সময় চিকিৎসকদের সিজারের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেয়, যা খুবই ভয়াবহ।

মিডওয়াইফদের কাজের স্বাধীনতা লাগবে। চিকিৎসকেরা সব জানেন, এই মনোভাবও পরিবর্তন করা উচিত। মিডওয়াইফেরা প্রসবের কাজে দক্ষতা অর্জন করেন। তাঁদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। এখন পর্যন্ত ৩ হাজার মিডওয়াইফারি পদ আছে। কিন্তু আমাদের দেশের চাহিদা ২২ হাজার মিডওয়াইফ।

মামলার কারণে এক বছর ধরে মিডওয়াইফদের সার্টিফিকেট দেওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শেষ করে বসে আছেন কিন্তু তাঁরা লাইসেন্সের অভাবে কাজ পাচ্ছেন না।

শামীম জাহান
শামীম জাহান


শামীম জাহান
অপ্রয়োজনীয় সিজার বন্ধে একটি প্রচারণা শুরু হয়েছিলে ২০১৬ সালে। এখন এটি ২০১৯–এর শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। কিন্তু একে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে আনা জরুরি। তার জন্য পরিকল্পনার সঙ্গে অর্থায়ন খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমার বিশ্বাস, মন্ত্রণালয়, উন্নয়ন সহযোগীসহ সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এটি জাতীয় কর্মসূচির অংশ হবে। একটি পরিকল্পিত ও যুগোপযোগী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে রোগী ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারে এবং অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

মাইনুল আহসান
মাইনুল আহসান


মাইনুল আহসান
অনেক সময় বেসরকারি হাসপাতালের স্বেচ্ছাচারিতার কথা শোনা যায়। তবে এ জন্য বেসরকারি হাসপাতালের মালিকদের এককভাবে দায়ী করলে হবে না। অনেক চিকিৎসকও এর সঙ্গে জড়িত থাকেন, যা দুঃখজনক।

এর বিকল্প কী তাহলে? চিকিৎসকেরা শহরে কাজ করেন। তাঁরা গ্রামে যাবেন কীভাবে? সিজার কমানোর ক্ষেত্রে শহরে বেশ উন্নতি হয়েছে। কিন্তু গ্রামে পর্যাপ্ত চিকিৎসক নেই। সেখানে মিডওয়াইফও নেই। গ্রামে দক্ষ মিডওয়াইফ দরকার।

কোনো কোনো বেসরকারি হাসপাতালের মালিকদেরই নৈতিকতা নেই। তাঁরা শুধু টাকা আয়ের জন্যই হাসপাতাল খুলেছেন। অনেক ক্ষেত্রে তঁারা মানুষের সেবাকে গুরুত্ব দেন না।

নীতিমালা তৈরি করে দিন। তখন বেসরকারি হাসপাতালে নির্দেশনা দিতে পারব। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরকে আরও শক্ত হতে হবে। যঁারা খারাপ চিকিৎসা দেন, তঁাদের সনদ বন্ধের ব্যবস্থা থাকা উচিত। যঁারা সঠিক সেবা দিতে পারবেন না, তঁাদের লাইসেন্স বাতিল করা দরকার।

সালেহা বেগম চৌধুরী
সালেহা বেগম চৌধুরী


সালেহা বেগম চৌধুরী
ব্যথামুক্ত স্বাভাবিক প্রসবের জন্য আমরা কিছু করতে পারিনি। তার জন্য মায়েদের শারীরিক, মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে। তাহলে ব্যথা কিছুটা কমবে।

যাঁদের সিজার করানো আবশ্যক, তাঁদেরই এই সেবা দিতে হবে। তা ছাড়া অনেক দরিদ্র সংকটাপন্ন মায়ের সিজার প্রয়োজন হলেও তাঁরা এই সুবিধা নিতে পারেন না। এই রকম মায়েদের এর আওতায় আনতে হবে।

যাঁরা চিকিৎসাসেবা দেবেন, তাঁদের ব্যবহার ভালো হওয়া উচিত। তাঁদের দক্ষ হতে হবে। প্রসবপ্রক্রিয়ায় চিকিৎসা দেওয়া একটি ধারাবাহিক কাজ। এখানে সবাইকে সেরা সেবা না দিলে হবে না। এই প্রক্রিয়াকে সার্বক্ষণিক নজরে রাখতে হবে।

ওজিএসবি রবসন শ্রেণিবিভাগ নিয়ে কাজ করেছে। আমরা সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছি। বিভিন্ন ধরনের সভা, সেমিনার ইতিমধ্যে করা হয়েছে।

মো. মোশায়ের-উল-ইসলাম
মো. মোশায়ের-উল-ইসলাম


মো. মোশায়ের-উল-ইসলাম
সারা বিশ্বেই সিজারের সংখ্যা বাড়ছে। সিজারের সঙ্গে মাতৃমৃত্যুর বিষয়টা নিয়েও কাজ করতে হবে। প্রসবের পর প্রসূতি মায়ের আত্মীয়স্বজন সেখানে নিয়োজিত কর্মীদের কিছু টাকাপয়সা দেন। তাই সেখানকার কর্মীরা মিডওয়াইফদের সহজে স্থান ছেড়ে দিতে চান না।

প্রসবের সময় মাতৃমৃত্যুর ৫৪ শতাংশ গ্রামে হয়। এর ২৪ শতাংশের মৃত্যু হয় প্রথমবার প্রসবের সময়।

মোহাম্মদ সহিদুল্লা
মোহাম্মদ সহিদুল্লা


মোহাম্মদ সহিদুল্লা
বাংলাদেশে অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান সেকশন ব্যবহার কমানোর জন্য সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ কাজ করছে। তাদের অনেক ধন্যবাদ।

অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান সেকশন বন্ধের সঙ্গে নতুন জন্ম নেওয়া (নিউ বর্ন) শিশুদের স্বাস্থ্যও জড়িত।

জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকেরা দক্ষ। কিন্তু নতুন চিকিৎসকেরা পর্যাপ্ত দক্ষ নন। অনেক নতুন চিকিৎসক বিভিন্ন কারণে সিজার করতে পছন্দ করেন। তাঁরা স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে বেশির ভাগই সময়েই দক্ষ হন না। তা ছাড়া সিজার করালে টাকাপয়সার ব্যাপার আছে। ফলে তাঁরা সিজার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

প্রয়োজনীয় সিজার নিয়ে কারও আপত্তি নেই। কিন্তু অপ্রয়োজনীয় সিজার করতে গেলে অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়। তাই নীতিমালা প্রণয়ন করে তা কাজে পরিণত করতে হবে।

বেসরকারি হাসপাতালে সরকারের অডিট করা প্রয়োজন। তাদের কাজের মূল্যায়ন করতে হবে। অনেক বেসরকারি হাসপাতাল ভালো সেবা দিচ্ছে। যারা ভালো সেবা দিচ্ছে, তারা খারাপ মানের হাসপাতালে দিকনির্দেশনা দিতে পারে। বেসরকারি খাতকে আরও নৈতিক হতে হবে।

আইনে হাসপাতালগুলো নিয়ন্ত্রণের বিধান থাকলে ভালো হয়। মন্ত্রণালয় বিধিমালা অনুমোদন দিলে কাজ শুরু করা যাবে। যদি তার আগে আমাদের কাছে অভিযোগ আসে, তাহলে আমরা তা বিবেচনা করে ব্যবস্থা করব।

এ এইচ এম এনায়েত হোসেন
এ এইচ এম এনায়েত হোসেন


এ এইচ এম এনায়েত হোসেন
প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র তাদের কাজের জন্য প্রশংসা পাচ্ছে। বেসরকারি খাতের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। আমরা এ ব্যাপারে কাজ করছি। বেসরকারি হাসপাতালে যেন তাদের সেবার ব্যাপারে প্রতিবেদন দেয়, তার ব্যবস্থা করব।

হাসপাতালে মিডওয়াইফদের আত্মবিশ্বাসী করে পাঠাতে হবে। এই প্রক্রিয়াটা একটা ধারাবাহিক সেবার মাধ্যম। এখানে প্রতিটি বিভাগের সঙ্গে অন৵ বিভাগের আস্থা ও সম্পর্ক থাকতে হবে।

প্রসবকক্ষের জন্য সার্বক্ষণিক দেখাশোনার ব্যবস্থা করা দরকার। তা ছাড়া যঁারা সেবা নিতে আসবেন, তাঁদেরও সচেতন হতে হবে। স্বাভাবিক 

প্রসবে সহযোগিতার জন্য মিডওয়াইফেরা সবচেয়ে ভালো।

অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান সেকশন বন্ধের জন্য গণমাধ্যমের ভূমিকা অনেক। তাদের প্রচারণা এ ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করবে।

ফিরোজ চৌধুরী

আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।

যাঁরা অংশ নিলেন

এ এইচ এম এনায়েত হোসেন: অতিরিক্ত মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

মোহাম্মদ সহিদুল্লা: সভাপতি, বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ

মো. শামসুল হক: লাইন ডিরেক্টর, মেটারনাল, নিওনেটাল, চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট হেলথ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

রওশনারা বেগম: সাবেক সভাপতি, ওজিএসবি

মো. মনজুর হোসেন: সহকারী পরিচালক, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর

শামস এল আরেফিন: বিভাগীয় প্রধান, শিশু স্বাস্থ্য বিভাগ, আইসিডিডিআরবি

দেওয়ান মো. ইমদাদুল হক: হেলথ সিস্টেম স্পেশালিস্ট, জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)

সেলিনা আমিন: প্রধান, মিডওয়াইফারি শিক্ষা কার্যক্রম ও প্রকল্প পরিচালক, মিডওয়াইফারি প্রকল্প উন্নয়ন

খুরশিদ তালুকদার: নারী ও শিশুস্বাস্থ্য কেন্দ্র (সিডব্লিউসিএইচ)

মাইনুল আহসান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, রোগনির্ণয় মালিক সমিতি (বিপিসিডিওএ)

মো. মোশায়ের–উল–ইসলাম: উপপরিচালক এবং প্রোগ্রাম ম্যানেজার, মেটারনাল হেলথ

রাশনা ইমাম: ব্যারিস্টার অ্যান্ড অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট

সালেহা বেগম চৌধুরী: সেক্রেটারি জেনারেল, ওজিএসবি

ইশতিয়াক মান্নান: ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ

শামীম জাহান: পরিচালক, স্বাস্থ্য পুষ্টি এবং এইচআইভি/এআইডিস, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ