কিশোর স্বাস্থ্য: বয়ঃসন্ধি নিয়ে ওদের জানতে দিন

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশের বেশি ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী। সংখ্যায় প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ। একটি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৫০ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়সে। ১৮ শতাংশ মেয়ের ১৫ বছর বয়সে পরিবার থেকে বিয়ে দেওয়া হয়। একজন কিশোরী মেয়ের প্রজননক্ষমতা একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর তুলনায় ১১৩ গুণ বেশি থাকে। ফলে অসময়ে গর্ভধারণ ও মাতৃমৃত্যু হারের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।

বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি উভয় সংস্থা কিশোর-কিশোরীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বর্তমানে এ বিষয়ে ৩২টি কার্যক্রম চালু রয়েছে। বয়ঃসন্ধিকালের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যের একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে স্কুল কার্যক্রমে সঠিক তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে ইন্টারনেটের সাহায্যে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান অত্যন্ত সহায়ক এবং নির্ভরযোগ্য হতে পারে। বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক পরিবর্তন, ঋতুস্রাব সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা থাকলে এই সময়ের শারীরিক পরিবর্তনগুলো কিশোর বা কিশোরীদের পক্ষে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়াটা অনেক বেশি সহজ হতে পারে। বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনবিষয়ক সচেতনতা নিয়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। এই মৌলিক সচেতনতার অভাবে তারা অনেক ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। যেমন: অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ, যৌন সংক্রমণ ব্যাধি (এসটিডি), যৌন সহিংসতার ঝুঁকি, ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিবাহ, মতামত প্রকাশে ব্যর্থতা ইত্যাদি। কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যের চাহিদা পূরণকে লক্ষ্য করে সরকার স্বাস্থ্য খাতে অগ্রগতি অর্জনের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে এবং এসআরএইচের ২০১৬-২০-এর পাঁচ বছরের পরিকল্পনায় উল্লেখযোগ্যভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। তারপরও যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে এখনো বেশ কয়েকটি উদ্বেগের বিষয় রয়ে গেছে।

প্রথমত, সরকারের পঞ্চবার্ষিক (২০১৬-২০) পরিকল্পনায় কিশোর বয়সী ছেলেদের এবং অবিবাহিত কিশোরীদের জন্য কোনো নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যসেবার নির্দেশিকা নেই। দ্বিতীয়ত, সরকার প্রণীত কিশোর-কিশোরীদের যে স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র (এএফএইচসি) চালু হয়েছে, তার কর্মসময় সকাল ৯টা থেকে বেলা ২টা। যারা শিক্ষার্থী, তাদের পক্ষে এই সময় মোটেও সুবিধাজনক নয়, কারণ, এই সময়ে শিক্ষার্থীরা সাধারণত স্কুল বা কলেজে অধ্যয়নরত থাকে। তৃতীয়ত, জাতীয় কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্য নীতিমালা ২০১৭-৩০ (এনএসএএইচ)-এ তৃতীয় লিঙ্গ, সমকামী, উভকামী এবং ট্রান্সজেন্ডার (এলজিবিটি) কিশোর-কিশোরীদের কথা উল্লেখ নেই। তদুপরি এ প্রস্তাবে শারীরিক বা মানসিকভাবে চ্যালেঞ্জ বিভাগে এই সংখ্যালঘু (এলজিবিটি) কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যসেবায় অন্তর্ভুক্তির কোনো নীতিমালা সংযোজিত হয়নি। চতুর্থত, এই সরকারি নীতিমালায় অতি অল্প বয়সী কিশোর-কিশোরীদের (১০ থেকে ১৪ বছর) বয়সের উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবার প্রস্তাবের অভাব রয়েছে। উল্লেখ্য যে এই দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালাতে প্রারম্ভিক কিশোরকালীন জটিলতা মোকাবিলা ও যুগোপযোগী কর্মসূচির অন্তর্ভুক্তি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের যৌন স্বাস্থ্যসেবা ও সচেতনতা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। কারণ, সাধারণত এ সময়েই তারা যৌন আচরণ, যৌন জীবন এবং সেই সংশ্লিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি গঠন শুরু করে। পঞ্চমত, অন্যান্য উদ্বেগের মধ্যে, সরকারি স্বাস্থ্য নীতিমালাতে বিশেষত কিশোর-কিশোরীদের উপযোগী, যৌন সংক্রমণ ব্যাধি প্রতিরোধব্যবস্থা এবং এইচআইভি প্রতিরোধ ও নির্ণয়ের ওপর সুনির্দিষ্ট মনোযোগের অভাব রয়েছে।

এ অবস্থায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্বারা দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্য প্রোগ্রামের মাধ্যমে তথ্য প্রদান সেশন, কাউন্সেলিং এবং কর্মশালার উদ্যোগ নেওয়া খুবই জরুরি। এর জন্য কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ এবং নিয়মিত স্কুল পরিদর্শন প্রয়োজন। সদ্য বয়ঃসন্ধি পার করা যুবক–যুবতীরা তাঁদের অভিজ্ঞতা আলোচনা করতে পারেন। প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্বারা যৌনতাবিষয়ক তথ্য পরিবেশন করা যেতে পারে। স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে খোলামেলা কথা বলার জন্য অনলাইনে একটি ফোরাম হতে পারে। এই ফোরাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মেয়েদের একত্র হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া এবং বিভিন্ন বার্ষিক দিনগুলোতে সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনায় ভূমিকা রাখতে পারে। অনলাইন রেডিও পরিচালনাকে একটি উপযোগী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে তরুণদের জন্য এএসআরএইচ বিষয়ে প্রশ্নোত্তর সেশনের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি ও সাহায্য করা যেতে পারে। সরকারি সব স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প ও নীতিমালায় তৃতীয় লিঙ্গ, সমকামী, উভকামী (এলজিবিটি) সম্প্রদায়কে সংযুক্ত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের স্বাস্থ্যসেবায় যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব মতামত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি প্রয়োজন।

বয়ঃসন্ধিকালে প্রাপ্ত তথ্য ও সামাজিক রীতিনীতি পরবর্তী সময়ে যৌন জীবন ও যৌন আচরণকে নানাভাবে প্রভাবিত করে থাকে। সুতরাং এসব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠার জন্য যথোপযোগী স্বাস্থ্যসেবা সুনিশ্চিত করা যেতে পারে।

ডা. তামান্না আফরোজ: নরওয়ের ইউনিভার্সিটি অব অসলোর ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটি হেলথের এমফিল শিক্ষার্থী