কৃষিব্যবস্থার বাণিজ্যিক বিকাশ

বাপ ভালো তো ব্যাটা ভালো, মা ভালো তো ঝি ভালো—গাভি ভালো তো দুধ ভালো, দুধ ভালো তো ঘি। গ্রামীণ এই প্রবাদের সঙ্গে কৃষিব্যবস্থার বাণিজ্যিকীকরণের ক্ষেত্রে প্রচলিত ‘ফারমার্স হাব’–এর উদ্ভাবনী চিন্তাটি মিলে যায়। ফারমার্স হাবকে আমরা বাংলায় ‘কৃষি ব্যবসাকেন্দ্র’ শব্দবন্ধ দ্বারা প্রকাশের প্রস্তাব করি। আমাদের কৃষকদের চিন্তা করতে হয়: কী জাতের ফসল করব, তার জন্য ভালো বীজ কোথায় পাব, কোন পদ্ধতিতে রোপণ করলে ভালো লাভ করা যাবে, ইত্যাদি। কৃষি ব্যবসাকেন্দ্রের ধারণা এই ক্ষেত্রে কিছু বাস্তব পন্থা নিয়ে এসেছে। কৃষি ব্যবসাকেন্দ্র একটি ব্যবসায়িক উদ্যোগ; এর মালিক সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক ভিত্তিতে উন্নত জাতের মানসম্পন্ন বীজ, সার ও অন্যান্য উপকরণ, চাষের যন্ত্রপাতি ভাড়া, আধুনিক সেচব্যবস্থা ইত্যাদি সুলভ মূল্যে জোগান দেন।

কোন ফসল কীভাবে রোপণ–বপন করতে হবে এবং ঠিক কখন কী মাত্রায় উপকরণ ব্যবহার হবে, কৃষি ব্যবসাকেন্দ্রে এসব সম্পর্কে হাতে–কলমে শেখানোরও ব্যবস্থা থাকে। উৎপাদন সম্পর্কিত তথ্যও ‘কৃষি ব্যবসাকেন্দ্র’ থেকে সহজে জানা যায়। এরপর ফসল ওঠার পর কৃষকেরা তাঁদের উৎপাদিত ফসল ও পণ্যসামগ্রী বিক্রির জন্য কৃষি ব্যবসাকেন্দ্রের নির্দিষ্ট চত্বরে নিয়ে আসেন। এ জন্য কৃষি ব্যবসাকেন্দ্র প্রয়োজনীয় যানবাহনের ব্যবস্থাও করে থাকে। কেন্দ্রে ফসলের মান বাছাই, গ্রেডিং, ধোয়ামোছা, প্যাকিং, সঠিক ওজন ও পরিমাপ ইত্যাদি সেবার ব্যবস্থা থাকে। এরপর কৃষি ব্যবসাকেন্দ্রের মালিক জড়ো হওয়া অনেক বেশি পরিমাণ ফসল ও পণ্য একসঙ্গে ভালো দামে বিক্রির জন্য বড় ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের সঙ্গে যোগাযোগ ও দর–কষাকষি করে। আলাদাভাবে কোনো কৃষকের পক্ষে দর-কষাকষি সম্ভব নয় বলে এই পদ্ধতিতে কৃষকেরা পণ্যের বাজার দাম অপেক্ষা একটু বেশি দাম পেয়ে থাকেন।

সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক ধারণা থেকে কৃষকদের গ্রুপ গঠন করা হয় এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ‘কৃষি ব্যবসাকেন্দ্র’ নির্মাণ করা হয়। সাধারণত টিনের চালা, পাকা দেয়াল ও ভিটি দিয়ে শুরু করা যায়। পরে সংগতি অনুযায়ী পুরোটাই পাকা করে নেওয়া যায়। নির্মাণ খরচ মূলত কৃষি ব্যবসাকেন্দ্রের মালিকের, জমি ও মূলধনও তাঁরই। তবে প্রথম দিকে উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে প্রায় অর্ধেক অংশ মূলধন সহায়তার ব্যবস্থা করা যায়। কৃষি ব্যবসাকেন্দ্র স্থাপনে যে মূলধন প্রথমে বিনিয়োগ করা হয়, তা থেকে যাতে দ্রুত ফিরতি লাভ করা যায়, সেদিকে নীতিগতভাবে বিশেষ লক্ষ রাখা হয়। তা না হলে কৃষি ব্যবসাকেন্দ্রের মালিক বিনিয়োগে আকৃষ্ট হবেন না এবং অচিরেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে পারেন। তাই সাধারণভাবে কৃষি ব্যবসাকেন্দ্র স্থাপনকালে প্রথমেই এমন কিছু ব্যবসায়িক উদ্যোগের কথা সামনে আনা হয়, যার থেকে তিন–চার মাসের মধ্যেই প্রাথমিক বিনিয়োগের লাভ পাওয়া যায়। ইতিমধ্যে কৃষি ব্যবসাকেন্দ্র সম্পর্কে বেশ কিছু উৎসাহব্যঞ্জক উদাহরণ পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশে মূলত এটি প্রথম আনে সুইস আন্তর্জাতিক সংস্থা সিনজেন্টা ফাউন্ডেশন। বৃহত্তর রাজশাহী ও রংপুর অঞ্চলে ইতিমধ্যে ১২০টি ‘কৃষি ব্যবসাকেন্দ্র’ গঠন করে সফলভাবে কৃষি ব্যবসার সুযোগ করে দিয়েছে। রাজশাহীর গোমস্তাপুরে তাসফিয়া কৃষক হাব এমনি একটি সম্ভাবনাময় উদ্যোগ। এটার উদ্যোক্তা আবদুর রসিদ নামের একজন তরুণ। স্বল্প শিক্ষিত। এই কৃষি ব্যবসাকেন্দ্রের ঘর, যন্ত্রপাতি এবং সবজি ও ফলের নার্সারি স্থাপনে মোট চার লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে উদ্যোক্তা দিয়েছেন দেড় লাখ টাকা, বাদবাকি আড়াই লাখ টাকা দিয়েছে সিনজেন্টা ফাউন্ডেশন অনুদান হিসেবে। ৪০ ফুট বাই ৬০ ফুট আকারের একটি ঘর, তার প্রায় অর্ধেকটা উন্মুক্ত রাখা হয় কৃষকদের বৈঠক, প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনে ফসল বাছাই ও বেচাকেনার জন্য। তাঁর মোট সাত একর জমি আছে, যার প্রায় অর্ধেকটা আমবাগান, বাকিটা ধান ও অন্যান্য ফসলের চাষ হয়। সিনজেন্টা ফাউন্ডেশনের মতে, একেকটা কৃষি ব্যবসাকেন্দ্র শুরু করতে কোনো উদ্যোক্তার ৪৫ হাজার টাকা জোগাড় করতে পারলেই চলে।

কৃষি ব্যবসাকেন্দ্রের প্রাথমিক ফিরতির কথা, যেটা আগে বলা হয়েছিল, সেদিকে বিবেচনা করে তাসফিয়া হাব সবজি ও ফলমূলের চারা উৎপাদন ও বিপণন উদ্যোগকে বেছে নেন। সিনজেন্টা ফাউন্ডেশন হাইব্রিড বেগুন, চালকুমড়া, মরিচ, টমেটো, সবজি এবং ফলের মধ্যে পেঁপে, আম, পেয়ারা ইত্যাদির চারা উৎপাদনের আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে হাতে–কলমে প্রশিক্ষণ দেয়। মাটি ছাড়াই কেবল নারকেলের ছোবড়ার গুঁড়া ব্যবহার করে চারা উত্পাদন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এতে চারা দ্রুত সবল–সতেজভাবে বেড়ে ওঠে এবং চারার রোগব্যাধিও কম হয়। বিশেষ পদ্ধতিতে আম্রপালি উন্নত জাতের আমের চারা উৎপাদন করা হয়, যা রাজশাহী বরেন্দ্র অঞ্চলে কোকাকোলা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নের অতিঘন পদ্ধতিতে রোপণ করে নতুন নতুন বাগান ঘরে তোলা হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে লাগানো আমগাছগুলো খাটো, প্রায় মাথাসমান এবং ৬ ফুট ও ৯ ফুট ঘনত্বে এগুলো রোপণ করা হয় বলে বাগান পরিচর্যা খরচ কম ও সহজ হয়। খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এ পদ্ধতি, যাকে বলা হয় ইউএইচডিপি বা অতিঘন রোপণ পদ্ধতি। সেই সঙ্গে নার্সারিগুলোও আমের চারা বিক্রি করে ভালো ব্যবসা করছে। উল্লিখিত কৃষি ব্যবসাকেন্দ্রের নার্সারিটি একেকটি মরিচের চারা ১ টাকা ২০ পয়সা, চালকুমড়া ও বেগুন চারা ৫ টাকা এবং আম্রপালি আমের চারা ৫০ টাকা বিক্রি করে মাত্র চার মাসেই ১ লাখ ২০ হাজার টাকা আয় করেছে। এ জন্য কৃষি ব্যবসাকেন্দ্র গঠনে প্রাথমিক বিনিয়োগ হিসেবে নার্সারি ব্যবসাকে প্রাধান্য দিয়ে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা হচ্ছে।

কৃষি ব্যবসাকেন্দ্র সম্পর্কে আরেকটি মজার বিষয় হচ্ছে যে বহু তরুণ উদ্যোক্তা চাকরির পেছনে না দৌড়ে এখন আধুনিক কৃষি, বিশেষ করে উচ্চমূল্যের ফলদ বাগান করাকে লাভজনক ও সম্মানজনক পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। এমনই এক তরুণ উদ্যোক্তা রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার তিলাহারী এলাকার এস এম সারোয়ার হোসেন কৃষি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে কৃষিবিদ। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ছয়–সাত বিঘা জমির ওপর গড়ে তুলেছেন একটি কৃষি ব্যবসাকেন্দ্র। তাঁকেও সহযোগিতা করছে সিনজেন্টা ফাউন্ডেশন, অর্থায়নে কোকাকোলা ফাউন্ডেশন, সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাধায়নে ডব্লিউআরজি-২০৩০। এই কৃষি ব্যবসাকেন্দ্র ইতিমধ্যে ৪০০ সদস্যকে সংগঠিত করেছে। অতিঘন পদ্ধতিতে গড়ে তুলেছেন হিমসাগর, আম্রপালি ও ক্ষীরশাপাতি আমবাগান। সেচের জন্য ড্রিপ ইরিগেশন ব্যবস্থা হচ্ছে। নিজের বাগান করার পাশাপাশি কৃষি ব্যবসাকেন্দ্রের সদস্য কৃষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও উদ্বুব্ধকরণকাজ চলছে। এটিও বিনিয়োগ থেকে দ্রুত বিনিয়োগ ফিরতি লাভের আশায় গড়ে তুলেছে সবজি ও ফলের নার্সারি। এই তরুণ শিক্ষিত কৃষিবিদ উদ্যোক্তা কিছুদিন চাকরি করার পর ধান চাষে মনোযোগ দেন। কিন্তু ধানের দাম কম এবং শ্রমিকের সংকটের কারণে তা ছেড়ে এই ফলবাগানের দিকে ঝুঁকছেন। এখানেও তিনি প্রচলিত আমবাগান পদ্ধতির পরিবর্তে কৃষি ব্যবসাকেন্দ্রের ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অতিঘন পদ্ধতিতে উচ্চফলনশীল আমের বাগান করতে আগ্রহী। ব্যবসাটি তিনি কেবল আম নয়, লিচু–পেয়ারা এমনকি মসলাজাতীয় ফসল চাষেও প্রসারিত করতে চান।

কৃষি ব্যবসাকেন্দ্রের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে যেখানেই সম্ভব কৃষিতে পানিসাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহার করা। ধান চাষ না করে ফলের বাগান করলে এমনিতে পানি সাশ্রয় হয়। লাভ তো বটেই। তবে সে ক্ষেত্রেও দুটো পদ্ধতি অনুসরণ করার কথা বলা হচ্ছে। প্রথমত, ফলের বাগানে ড্রিপ ইরিগেশন বা ফোঁটায় ফোঁটায় সেচপদ্ধতি ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। এ জন্য ড্রিপ সেট, যা সহজেই প্লাস্টিক পাইপ ও ছোট্ট ছোট্ট নল ব্যবহার করে বানানো এবং ব্যবহার করা যায়। তেমন খরচও হয় না। প্রতিটি গাছের গোড়ায় গোড়ায় প্রয়োজনমতো ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ে বলে যথেষ্ট পানি সাশ্রয় হয় এবং সেচ খরচ প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। দ্বিতীয়ত ধানখেতে পালাক্রমে ভেজানো–শুকানো পদ্ধতিতে সেচ দেওয়া। ইংরেজিতে এটাকে বলে এডব্লিউডি বা অল্টারনেট ওয়েটিং অ্যান্ড ড্রায়িং পদ্ধতি। এ জন্য কৃষক হাব প্লাস্টিকের ছিদ্রবিশিষ্ট পাইপ সরবরাহ করেন, যা ধানখেতের মাঝে পুঁতে রাখলে তার ভেতরে জমা হওয়া পানির স্তর দেখে খেতে কখন কতটুকু সেচ দিতে হবে, তা বোঝা যায়। কৃষি ব্যবসাকেন্দ্রগুলো এই পানিসাশ্রয়ী প্রযুক্তিগুলো জনপ্রিয় করে তুলছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বেশ আগে থেকেই এ পদ্ধতি চালু করেছে। কৃষি ব্যবসাকেন্দ্রগুলো রাজশাহী অঞ্চলে বর্তমানে প্রচলিত বড় বড় আমগাছসমৃদ্ধ বাগানের পরিবর্তে অতিঘন পদ্ধতির ফলবাগান করার অর্থনৈতিক যুক্তি, বাগান করার পদ্ধতি, মানসম্পন্ন চারা সরবরাহ, কৃষিতাত্ত্বিকভাবে দক্ষ রোপণ ও গাছের পরিচর্যা পদ্ধতি সম্পর্কে কৃষকদের জ্ঞানদান, প্রশিক্ষণ, ব্যবসা সম্পর্কিত তথ্য ও প্রযুক্তি সমর্থন দিচ্ছে। আশা করা যায়, কৃষি ব্যবসার আধুনিক ধারণা হিসেবে কৃষি ব্যবসাকেন্দ্র উত্তরোত্তর আরও প্রসার লাভ করবে।

. এম এ সাত্তার মন্ডল: বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের ইমেরিটাস অধ্যাপক