আমাদের শিশুরা কেমন আছে

সম্প্রতি দেশব্যাপী পালিত হলো বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ। সপ্তাহব্যাপী শিশুদের নিয়ে নানা অনুষ্ঠান হয়েছে; কিন্তু তখনো থেমে থাকেনি শিশু ধর্ষণ আর শিশু হত্যার মতো অপরাধগুলো। 

যখন শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ও স্বপ্নের কথা উচ্চারিত হয়েছে, তখন ধামরাইয়ে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক পুরুষ কর্তৃক ধর্ষিত হয়েছে চার–চারটি শিশু, যাদের বয়স পাঁচ থেকে সাত বছর। সুনামগঞ্জে পাঁচ বছর বয়সী শিশু তুহিন খুন হয়েছে নৃশংসভাবে। বস্তির ১৪ বছর বয়সী কিশোরীকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন আরও কত কিশোরী বাল্যবিবাহের শিকার হয় আমরা জানতে পারি না। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও নেই শিশুর নিরাপত্তা। 

বইয়ের বোঝা শিশুদের শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে দেয় না। মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে পড়া কোচিং সেন্টারের ফাঁদ থেকে মুক্তি নেই তাদের। শিশুদের জন্য নেই উপযুক্ত খেলার মাঠ, সাঁতার শেখার জায়গা। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে জানার জন্য নেই মানসম্পন্ন পর্যাপ্ত আয়োজন, নেই যুগোপযোগী আধুনিক লাইব্রেরি।

সামাজিক নানা প্রতিকূলতা ও নিরাপত্তাহীনতা শিশুর পথ রোধ করছে। ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধ করার কথা থাকলেও এখনো প্রায় ১০ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কেমন আছে শিশুরা?

বাংলাদেশে শিশুদের অধিকার সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত। বাংলাদেশে শিশু অধিকার সংরক্ষণের জন্য স্বাধীনতা লাভের পরপরই ১৯৭৪ সালে পাস করা হয় শিশু আইন–১৯৭৪। বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী প্রথম রাষ্ট্রগুলোর একটি। 

শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করার প্রয়াসে প্রণয়ন করা হয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন–২০০০, জাতীয় শিশুশ্রম নিরোধ নীতিমালা-২০১০, জাতীয় শিশু নীতিমালা-২০১১, শিশু আইন-২০১৩, গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা-২০১৫। 

জাতীয় শিশুনীতি ২০১১ সালে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সংবিধান, শিশু আইন ও আন্তর্জাতিক সনদগুলোর আলোকে শিশু অধিকার নিশ্চিত করা হবে। আরও বলা হয়েছে শিশুর সার্বিক সুরক্ষা ও সর্বোত্তম স্বার্থ নিশ্চিতকরণের কথা, শিশুর প্রতি সব ধরনের নির্যাতন ও বৈষম্য দূরীকরণের কথা। 

কিন্তু এসব নীতি ও আইনের বাস্তব প্রয়োগ দৃশ্যমান হয় কোথায়? ২০১৩ সালে শিশু আইন প্রণয়নের পর আজ পর্যন্ত কোনো বিধিমালা আসেনি। ফলে আইন বাস্তবায়নে দেখা দিচ্ছে প্রতিবন্ধকতা এবং উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে শিশু নির্যাতন। 

এই বছরের বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহের প্রতিপাদ্য ছিল ‘আজকের শিশু আনবে আলো, বিশ্বটাকে রাখবে ভালো’। যে দেশে শিশুরা ঝুঁকির মধ্যে বেড়ে ওঠে, সে দেশের শিশুরা ভবিষ্যতের জন্য আলো নিয়ে আসবে কী করে, সেই প্রশ্ন মনকে বিচলিত করে। যে দেশে বছরের প্রথম ৯ মাসের মাথায় ৬০০ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, সে দেশে তাদের শৈশব আর যা–ই হোক, আলোকিত হতে পারে না। ভয়ে মোড়ানো অন্ধকারাচ্ছন্ন শৈশবের পথ বেয়ে আলোকিত ভবিষ্যতের দেখা মেলে কি? 

সম্প্রতি আমি অংশ নিয়েছিলাম বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ উপলক্ষে আয়োজিত শিশু সংলাপে। শিশুদের নানা প্রশ্ন, ওদের যুক্তিতর্ক যত শুনেছি, তত বেশি লজ্জিত আর বিবেকের দংশনে জর্জরিত হয়েছি। এক শিশু প্রশ্ন করেছিল, ‘শিশুবান্ধব পরিবেশ বলতে কী বোঝায়?’ আলোচক শিশুটির প্রশ্নের জবাব দেওয়ার পর শিশুটি পুনরায় প্রশ্ন করেছিল, ‘বাংলাদেশে কোথায় গেলে মিলবে এমন শিশুবান্ধব পরিবেশ?’ শিশুটির পরের প্রশ্ন শুনে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন আলোচক। 

এক কিশোরী জানতে চেয়েছিল, ‘একা পথ চলতে আমার ভয় হয়। এই অপরাধ তো আমার না। তাহলে কেন আমি সব সময় ভয়ে কুঁকড়ে থাকি?’ আরেক শিশু জানতে চেয়েছিল, ‘রাস্তার পাশের উৎকট গন্ধযুক্ত ময়লা ডাস্টবিন আর কত কাল এ দেশে থাকবে? ময়লা সরানোর ট্রাক নিজেই কেন ময়লা ফেলে রাস্তা নোংরা করে?’ 

আরেক শিশু জানতে চেয়েছিল, ‘আমরা তো সবাই জানি খাবারে ভেজাল মেশানো খুব ক্ষতিকর। তাহলে জেনেবুঝেও কেন খাবারে ভেজাল মেশানো হয়? আমাদের কি কেউ ভালোবাসে না?’ আরেকজন বলেছিল, ‘আমি গল্পের বই পড়তে চাই। কিন্তু সে সুযোগ হয় না। পড়ার চাপ কি কিছুটা কমানো যায় না?’

শিশুদের এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের জানা নেই। রাষ্ট্রব্যবস্থায় যাঁরা আছেন, তাঁরা কেউ কি শিশুদের মানবিক এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারেন? এই প্রশ্নগুলো শুধু শিশুদের নয়, বিবেকবান প্রত্যেক মানুষের। 

শিশুরা বলেছিল ওরা রঙিন ফুল, প্রজাপতি আর সবুজ লতাপাতা ছুঁয়ে দেখতে চায়। ওরা প্রকৃতির কাছে যেতে চায়। ওরা চায় নিজের মতো করে কথা বলতে, খেলতে আর প্রাণভরে আনন্দ করতে। কোথায় কীভাবে মিলবে সে সুযোগ? 

নিশাত সুলতানা লেখক ও গবেষক
[email protected]