লোকসানি নয়, লাভজনক শিক্ষাই চাই

পরীক্ষার শৃঙ্খলে বন্দী শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের মুক্ত জগতে বিচরণের সুযোগ করে দিতে হবে
পরীক্ষার শৃঙ্খলে বন্দী শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের মুক্ত জগতে বিচরণের সুযোগ করে দিতে হবে

সতীর্থ ছাত্রদের ভয়ংকর নির্যাতনে আবরার ফাহাদের মৃত্যু কেবল সেই নির্মমতায় শরিক ২৩ ছাত্রকেই কাঠগড়ায় তুলছে না, একই সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্রকেও তুলছে। কাদের ভুলে, ব্যর্থতায় ও প্রশ্রয়ে একদল ‘মেধাবী’ তরুণ এ রকম হিংস্র হয়ে উঠতে পারে, তা জানা জরুরি। যদি আমরা বলি এ ঘটনা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অকার্যকারতারই সাক্ষ্য দিচ্ছে, তাহলে বোধ হয় ভুল হবে না। হ্যাঁ, একা স্কুল বা শিক্ষাব্যবস্থা দায়ী নয়, এর সঙ্গে পরিবার এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্বের কথাও বলতে হবে। কেননা শিক্ষার লক্ষ্য, আদর্শ নির্ধারণ এবং পাঠক্রম থেকে পাঠদান ও মূল্যায়ন পর্যন্ত সরকারি নির্দেশনাতেই চলে। পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ, পাস এবং জিপিএ ৫-এর হার নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার সুযোগ নেই। শিক্ষার গলদটা বুঝতে ও চিহ্নিত করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়ে আগ্রহী। এ ছাড়া শিক্ষা নিয়ে নানা দাতা সংস্থা বা দাতা দেশের সঙ্গে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে শিক্ষায় বহু রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে আসছে। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না। মানবশিশুর শিক্ষা কেবল পাঠ্যবই আর স্কুলের পাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। কেবল বই পড়ে, পাঠ্য বিষয় ভালোভাবে মুখস্থ করে পরীক্ষায় চমৎকার ফল মিললেও এ প্রক্রিয়ায় শিশুর শেখার এবং দক্ষতার সব প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। এর বাইরেও ভারসাম্যপূর্ণ পুষ্টিকর খাবারের মতোই আরও আনুষঙ্গিক বিষয়ের সঙ্গে পরিচয় ও তাতে দক্ষতা প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ অনেক কাল আগেই বলে গেছেন চিত্তের উপযুক্ত আহার্য না পেতে পেতে ছাত্রদের ক্ষুধামান্দ্য রোগ দেখা দেয়, তারা আর ভারী বই পড়তে পারে না, জটিল চিন্তার খেই হারিয়ে ফেলে। এরা লঘুচিত্তের চপল মানুষ হয়। এ শিক্ষা, তাঁর বিবেচনায়, লোকসানি মাল। আবরারের হত্যাকাণ্ড আমাদের বিবেকে আঘাত দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে দুর্বল অসম্পূর্ণ শিক্ষার খেসারত কতটা দিতে হয়।

কেন ‘মেধাবী’ ছাত্ররাও অবিশ্বাস্য রকম নির্মমতায় অংশ নিচ্ছে, কেন অমানুষের মতো আচরণ করছে, তা খুঁজে বের করা জরুরি।

প্রথমত, বর্তমান শিক্ষা যেহেতু পরীক্ষানির্ভর, তাই শিক্ষার্থীরা কেবল পরীক্ষা-সংশ্লিষ্ট নির্বাচিত সীমিত বিষয়ের উত্তর মুখস্থ করেই শিক্ষাজীবন কাটিয়ে দেয়। তাই মানুষ হয়ে ওঠার পথে জরুরি অন্যান্য বিষয়ের চর্চা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত থাকছে। অথচ ছাত্রোত্তর জীবনে তো একজন ব্যক্তির কাছ থেকে তাঁর পিএসসিতে গণিতের মান বা জেএসসিতে ইংরেজির গ্রেড, এসএসসিতে ইতিহাসের স্কোর কত এসব কেউ জানতে চায় না, দেখতে চায় তার ভাবপ্রকাশে লিখিত-মৌখিকে দক্ষতার মান, দেখতে চায় আত্মবিশ্বাস, ন্যায়বোধ, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, নেতৃত্বগুণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, সংবেদনশীলতা ইত্যাদি মানবিক গুণাবলির মান কেমন। সমাজের দিকে তাকালে, পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলে এসব গুণাবলির ঘাটতিই দেখা যাচ্ছে বেশি। নয়তো শিক্ষিত সমাজেই এত অন্যায়, এত দুর্নীতি, ভয়ংকর নিষ্ঠুরতার বিস্তার ঘটত না।

আমরা জানি খুন, নির্যাতন, ঘুষ, দুর্নীতি সবাই করে না; করে মুষ্টিমেয় কয়েকজন। কিন্তু সমস্যাটা হলো, অধিকাংশ শিক্ষার্থী এবং প্রায় সব শিক্ষক এসব ঘটনা মানতে না পারলেও কার্যকর কোনো ভূমিকা নেয় না। এখানেও গলদটা শিক্ষার। বর্তমান পদ্ধতিতে শিশু একজন সক্রিয় শিক্ষার্থী নয়। সে আসলে প্যাসিভ লার্নার বা নিষ্ক্রিয় শিক্ষার্থী। সাধারণভাবে আজকের শিক্ষার্থী তো শিক্ষকের প্রশ্নের শিক্ষক বা টিউটরের লেখা উত্তর মুখস্থ করে পাস করে। দীর্ঘ নিষ্ক্রিয়তার ফলে পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে অ্যাকটিভিজম বা কর্মোদ্দীপনা দেখতে পাই না। তারা চোখের সামনে ঘটা বা ঘটমান অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস রাখে না। দীর্ঘকাল শিক্ষা এভাবে চলতে থাকায় গোটা সমাজই এখন কার্যত নিষ্ক্রিয় নাগরিকে ভরে গেছে।

দ্বিতীয়ত, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা জ্ঞানের তৃষ্ণা জাগাতে ব্যর্থ। এ ব্যবস্থায় শিশুর কৌতূহল, জিজ্ঞাসা, মতামত সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়। ফলে দীর্ঘ উপবাসে গোটা সমাজ ক্ষুধামান্দ্য রোগে ভুগছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কোথাও জ্ঞান সৃষ্টি ও চর্চায় শিক্ষার্থীর যুক্ত হওয়ার সুযোগ ঘটে না। এ সমাজ যেমন জ্ঞানের ক্ষেত্রে তামাদি, তেমনি নীতি-মূল্যবোধের ক্ষেত্রে নেতিবাচক মান পাবে।

শিক্ষার্থীরা বড় হয় বড়দের দেখে, ওদেরই অন্ধভাবে অনুসরণ করে। কেননা প্যাসিভ লার্নিং তাদের ভাবতে শেখায় না, মৌলিক চিন্তা প্রকাশের কোনো সুযোগ দেয় না। এভাবে তাদের চিন্তাশক্তি এবং বিবেকবোধ সবার অগোচরে ঘুমিয়ে পড়ে। এ অবস্থায় অল্প কিছু ছাত্র অত্যাচারী দুর্নীতিবাজ হয়ে ওঠে আর বাকিরা এদের প্রতিরোধে অক্ষম, বরং তাদের দাপটের কাছে নতি স্বীকার করেই বাঁচে। মানুষ হয়ে ওঠার শর্তগুলো অপূর্ণ রেখেই সবাই বড় হচ্ছে—হচ্ছে অসম্পূর্ণ ব্যর্থ মানুষ হিসেবে।

তৃতীয়ত, একালে অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে ঘরে মেহমানের মতো রাখা হয়। তার কাজ শুধু পড়া ও পরীক্ষা দিয়ে যাওয়া, যাতে পাবলিক পরীক্ষায় খুব ভালো করে পরিবার, প্রতিষ্ঠান এবং নিজের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে। আমি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের এমন ছাত্রছাত্রী, এমনকি কিছু নবীন শিক্ষকও পেয়েছি, যারা নিজের পাঠ্য বিষয়ের বাইরে কোনো উপন্যাস পড়েনি, উচ্চমাধ্যমিকের পরে কারও কবিতা পড়েনি, কোনো দিন মঞ্চনাটক দেখেনি, এমনকি একটি পূর্ণাঙ্গ ফুটবল বা ক্রিকেট ম্যাচ খেলেনি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহযোগী অধ্যাপক আমার বাড়িতে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতে দেখে এবং তা শুনে সরলভাবে কবুল করেছিলেন যে এর আগে তিনি কখনো সামনাসামনি বসে কাউকে গাইতে শোনেননি। গানের প্রত্যক্ষ শ্রোতা হিসেবে এই তাঁর হাতেখড়ি! প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত শিক্ষার্থী জীবন, সমাজ, সমকাল, ঐতিহ্য, রুচি, ইত্যাদি সব বিষয়েই ঘাটতি নিয়ে বড় হয়।

চতুর্থত, সাধারণভাবে সবাই ভাবেন শৈশব থেকে নীতিবাক্য শেখালে বিবেকবান, সচ্চরিত্র মানুষ তৈরি হবে। কিন্তু তা হবে না। এমনকি ধর্মগ্রন্থ মুখস্থ করলেও লাভ হবে না। তাকে তো অর্থ বুঝতে হবে, ব্যাখ্যা জানতে হবে। যাঁরা ব্যাংক লুট করেছেন, যাঁরা ঋণখেলাপি হচ্ছেন, যাঁরা সহপাঠীকে অত্যাচার করে মেরে ফেলছেন তাঁরা সবাই শৈশবে নীতিবাক্য পড়েছেন, যখন-তখন মা-বাবা বড়দের কাছে প্রচুর উপদেশ শুনেছেন, প্রায় সবাই ধর্মগ্রন্থও পড়েছেন। কিন্তু মাদ্রাসা, সাধারণ স্কুল, ইংরেজি মাধ্যম কোথায় খুন-ধর্ষণ-নির্যাতনের অনাচার ঘটছে না! মানুষ নীতি, নিয়ম, প্রচলিত বিধান, আইন মানতে শেখে তার যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা ও পরিবেশ থেকে। কিন্তু আমাদের সমাজ তো অপরাধ, দুর্নীতির সঙ্গে আপস করে বসে আছে। এখানে অবলীলায় মিথ্যা উচ্চারিত হয়, কপটতা এই সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত অংশ হয়ে পড়েছে এবং সর্বোপরি বিচারহীনতার সংস্কৃতি জোরদারভাবেই বহাল আছে।

নেতিবাচক কথা না বাড়িয়ে এবার বলতে চাই সমাধানের কথা। শিক্ষাকে কোচিং সেন্টার থেকে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরাতে হবে। পরীক্ষা নয়, শিক্ষার আসল কাজ শিক্ষার্থীকে জ্ঞানের পথে আকৃষ্ট করা, তার মধ্যে মৌলিক চিন্তার ক্ষমতা জাগানো, তাদের সৃজনশীল কাজের ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়া। অর্থাৎ ছোট্ট মানুষটাকে ধাপে ধাপে বিকশিত হওয়ার রসদ জোগানোই শিক্ষার মূল কাজ। এভাবে একজন যুগপৎ ভালো মানুষ এবং দক্ষ কর্মী হওয়ার পুঁজি পেয়ে যাবে। এই সাফল্য অর্জনের জন্য এখনকার পরীক্ষার শৃঙ্খলে বন্দী শিক্ষার্থীদের দ্রুত জ্ঞানের মুক্ত জগতে বিচরণের সুযোগ করে দিতে হবে।

ছেলেমেয়েরা শ্রেণিকক্ষে পঠনপাঠনের পাশাপাশি নানা কাজের মধ্য দিয়ে একে অপরের বৈশিষ্ট্য ও গুণের পরিচয় পেলে তখন মেয়েরা আর ছেলেদের অপরিচিত একজন হয়ে থাকবে না, বরং নিজস্ব গুণ, যেমন—সুন্দর হাতের লেখা, সুরেলা গলা, ছবি আঁকার পটুত্ব ইত্যাদির মাধ্যমেই পরিচিত হবে। তখন একে অপরকে চিনবে, জানবে তাদের নানা গুণের মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়ায় পরস্পরের অপরিচয়ের দেয়াল সরে গেলে পরিচিত মেয়েকে সহপাঠীর পক্ষে জ্বালাতন করা, পেছনে লেগে কষ্ট দেওয়ার প্রবণতাও কমে যাবে। স্কুলে পঠনপাঠনে শিক্ষার্থীর সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের চাহিদাকে জায়গা দেওয়া, কাজকে মূল্য দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। পাঠের মতোই সংস্কৃতিচর্চা ও খেলাধুলাকে গুরুত্ব দিতে হবে।

রাজনীতি, প্রশাসন, পরিবার, সমাজ সর্বত্র একদিকে নৈতিকতার ভিত্তি স্বচ্ছ ও দৃঢ় করতে হবে, অন্যদিকে স্কুল থেকে ছেলেমেয়েদের সৃজনশীলতা ও মানবিক গুণাবলির বিকাশে সহায়ক কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। সমাজেই যদি জ্ঞানের চাহিদা তৈরি না হয়, যদি অনৈতিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস হারিয়ে ফেলে, তবে বিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুণগত পরিবর্তন আনতে পারবে না।

তবে এ প্রক্রিয়ার সূচনা স্কুল ও পরিবার থেকেই হতে হবে। শিক্ষার কাজটা সত্যিই বড় ও মহৎ কাজ। তাই স্কুলশিক্ষক হিসেবে সবচেয়ে মেধাবী সৃজনশীল তরুণদের আকৃষ্ট করতে হবে। পরিবর্তনের ধারা সৃষ্টিতে তাঁরাই নেতৃত্ব দেবেন।

এ পথে না এগোলে মেধাবী সংবেদনশীল শিক্ষার্থীও টেন্ডারবাজি, দখলদারি, নেশা এমনকি খুনেও জড়িয়ে পড়তে পারে। আমরা তেমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতিই দেখতে পাচ্ছি। এই লোকসানি ব্যবস্থাটিকে লাভজনক করে তোলার কাজে আর দেরি করা যাবে না।

আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক