এমপিদের গাড়িবিলাস ও ব্যবসা-বাণিজ্য

শুল্কমুক্ত গাড়ি এনে তা উচ্চ দামে এক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেওয়ায় বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড এবং ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করেছেন বিচারিক আদালত। বর্তমান সংসদে বিএনপির যে ছয়জন সাংসদ আছেন, তিনি তাঁদের একজন। কিন্তু যে গাড়ির জন্য তাঁর সাজা হয়েছে, সেটি আনা হয়েছিল ২০০১-০৬ মেয়াদে, অষ্টম সংসদে। নবম, দশম সংসদ পার হয়ে এখন একাদশ সংসদ চলছে। কিন্তু শুল্কমুক্ত গাড়ির মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। সাংসদ হারুনুর রশীদ হাইকোর্টে রিট করে ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পেয়েছেন। উচ্চ আদালত তাঁর জরিমানাও স্থগিত করেছেন। মামলার অপর দুই দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির একজন এনায়েতুর রহমান মঙ্গলবার আদালতে আত্মসমর্পণ করলে বিচারক কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে দুদক আপিল করেছে।

খবরটি পড়ে মনে হতে পারে, সাংসদ হারুন একাই শুল্কমুক্ত গাড়ি এনে বিক্রি করে দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে গত কয়েকটি সংসদের মেয়াদে আনা কয়েক শ গাড়ি হাতবদল হয়েছে। মামলা হয়েছে খুবই কম। অনেক সাংসদ শুল্কমুক্ত গাড়ি এনে বিক্রি করে দিলেও দুদক মামলা করেছে হাতে গোনা কয়েকটি। এ বিষয়ে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, ছয়-সাতজন সাংসদের বিরুদ্ধে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মামলা হয়েছিল। কিন্তু দুটির তথ্যপ্রমাণ তাঁদের কাছে আছে। ওই দুটি মামলার একটি সাংসদ হারুনুর রশীদের, অপরটি আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী প্রয়াত ছায়েদুল হকের। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আগে বা পরে শুল্কমুক্ত গাড়ি বিক্রি নিয়ে কোনো মামলা হয়নি।

তবে খেলাফত মজলিসের সাবেক সাংসদ মুফতি শহিদুল ইসলাম ফেঁসে যান এনবিআরের মামলায়। তিনি শুল্কমুক্ত সুবিধায় প্রায় ৪৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকায় বিলাসবহুল টয়োটা লেক্সাস (এলএক্স-৪৭০) গাড়ি আমদানি করে ৮০ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন লিনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান আবদুল জব্বার মিয়ার কাছে। দোষ স্বীকার করায় শুল্ক কর্তৃপক্ষ তাঁকে ৫১ লাখ টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেয়।

শুল্কমুক্ত গাড়ি বিক্রির মামলায় হারুনুর রশীদ সাজা পেলেও খালাস পান সাবেক মন্ত্রী ছায়েদুল হক। ২০০৭ সালের ৯ আগস্ট করা দুদকের মামলায় বলা হয়েছিল, সাংসদ মোহাম্মদ ছায়েদুল হক শুল্কমুক্ত কোটায় একটি জিপগাড়ি এনে একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের প্রধানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। মামলাটির বিচারকালে ১৭ সাক্ষীর মধ্যে ১৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছিল। দুদক অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায় আদালতে দুজনই খালাস পেয়ে যান। দুদক এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেনি।

স্বৈরাচারী আমলের আইন

সাংসদদের শুল্কমুক্ত গাড়ি দেওয়া শুরু হয় স্বৈরাচারী এরশাদের আমলে। ১৯৮৮ সালের ২৪ মে এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হয়। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সে সময় এরশাদবিরোধী আন্দোলনে থাকা সব রাজনৈতিক দল ওই সংসদ প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে শুল্কমুক্ত গাড়ির সুবিধা নিয়েছেন সব দলের সাংসদই। এ ক্ষেত্রে স্বৈরাচারী-গণতান্ত্রিক কিংবা বাম-মৌলবাদীদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ‘জাতীয় ঐকমত্য’ আছে।

বিএনপি বা আওয়ামী লীগ কোনো সরকারই আইনটি বাতিল করেনি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শুল্কমুক্ত গাড়ির অপব্যবহার রোধে নানা উদ্যোগের কথা শোনা গিয়েছিল। সাংসদদের শুল্কমুক্ত গাড়ি কেনার সুবিধা না দিয়ে ভারতের মতো সরকারি পুল থেকে তাঁদের গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচারী আমলের আইনই বহাল থাকে। এর আগে চারদলীয় জোট সরকার আইনে একটি সংশোধনী আনে, যাতে বলা হয়, একজন সাংসদ প্রথমবার নির্বাচিত হওয়ার পর শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর বা সম্পূরক শুল্ক ছাড়াই একটি মোটর কার বা জিপ আমদানি করতে পারবেন। তবে তিনি দ্বিতীয়বার বা অন্য যেকোনো সময়ে আবার নির্বাচিত হলে আট বছরের ব্যবধানে আরেকটি গাড়ি আমদানি করতে পারবেন। একজন সাংসদ যতবারই নির্বাচিত হন না কেন, এই সুবিধায় তিনি দুটির বেশি গাড়ি আমদানি করতে পারবেন না। এ সময় শুল্কমুক্ত আমদানির জন্য গাড়ির সিসিও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়—১৬৫০ থেকে ৩০০০।

আইনের ফাঁকফোকরে গাড়ি-বাণিজ্য

সাংসদদের শুল্কমুক্ত গাড়ি দেওয়ার পক্ষে যুক্তি ছিল, তাঁরা নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে জনগণের জন্য আরও বেশি কাজ করতে পারবেন। এমনকি শুল্কমুক্ত গাড়িতে সাংসদের নির্বাচনী এলাকা উল্লেখসহ ফলক লাগানোর কথা ছিল। বেশির ভাগ সাংসদ সেসব শর্ত উপেক্ষা করে বেশি দামে আনা গাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। আইন যাঁরা তৈরি করেন, তাঁরা আইনের ফাঁকফোকরগুলোও ভালো জানেন। একজন সাংসদের নামে আনা গাড়ি একজন ব্যবসায়ীর ব্যবহার করতে হলে তিন ধরনের কাগজে সাংসদের সইয়ের প্রয়োজন হয়। প্রথমটি হচ্ছে বন্ধকি দলিল। এই দলিলে দেখানো হয় যে গাড়ি দেশে আনা পর্যন্ত যে ব্যয় হয়, তার ১০ শতাংশ বেশি পরিমাণ অর্থ সাংসদ ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ধার নেন। আমদানি করা গাড়িকে বন্ধকি সম্পত্তি হিসেবে দেখানো হয় এবং এই ঋণ তিন বছরের মধ্যে ফেরতযোগ্য। তিন বছরের মধ্যে ঋণ ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে গাড়ি ওই ব্যবসায়ীর নামে চলে যায়। দ্বিতীয় চুক্তিটি হয় সরাসরি। চুক্তি অনুযায়ী তিন বছর পর ওই ব্যবসায়ী গাড়ির মালিক হয়ে যাবেন। আর সর্বশেষ দলিলটি হয় পাওয়ার অব অ্যাটর্নি-সংক্রান্ত। এ ক্ষেত্রে সাংসদ ব্যবসায়ীকে গাড়ি ব্যবহারের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়ে দেন। ফলে সাংসদ তাঁর গাড়িটি বিক্রি করে দিলেও আইনে ধরার সুযোগ থাকে না।

অষ্টম সংসদের সাংসদদের শুল্কমুক্ত গাড়ি কেনা নিয়ে প্রথম আলোয়প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল: ‘সাংসদদের কোটায় আনা শুল্কমুক্ত গাড়ি চলে গেছে ব্যবসায়ীদের হাতে। কাগজ-কলমে নিজেদের নামে থাকলেও অধিকাংশ সাংসদ এসব গাড়ি ব্যবহার করেন না। বিনিময়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তাঁরা নেন মোটা অঙ্কের টাকা। সাংসদদের শুল্কমুক্ত গাড়ি নিয়ে এই বাণিজ্যের ফলে দামি গাড়ি আমদানির প্রতিযোগিতা বেড়েছে। একাধিক সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশির ভাগ সাংসদের অতিরিক্ত আয়ের একটি বড় উৎস হয়ে উঠেছে এই গাড়ি-বাণিজ্য। ...আর এতে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২৮০ কোটি টাকা।’ (প্রথম আলো, ৫ এপ্রিল ২০০৬ সাল)

ওই সংসদের মেয়াদে আমদানি করা ২৭৫টি শুল্কমুক্ত গাড়ির মধ্যে ৫৫টিই বিএমডব্লিউ গাড়ি ও জিপ। শুল্ক ছাড়া এগুলোর সর্বোচ্চ মূল্য ৮৪ লাখ টাকা পর্যন্ত। মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি ও জিপ আনা হয়েছে ৪০টি। এই ব্র্যান্ডের জিপের দাম সর্বোচ্চ ৭৩ লাখ টাকা ও গাড়ির সর্বোচ্চ দাম ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা। বিশ্বের অন্যতম দামি গাড়ি পোরশে। এগুলোর দাম সর্বোচ্চ ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত। সাংসদদের নামে পোরশে এসেছে ১০টি। লেক্সাস গাড়ি ও জিপ আনা হয়েছে ২৩টি। লেক্সাস জিপের দাম ৪৭ লাখ টাকা পর্যন্ত। ল্যান্ড রোভার রেঞ্জ রোভার ১৬টি।

কর রেয়াতের খতিয়ান

শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুবিধা কাজে লাগিয়ে নবম সংসদের মেয়াদে আমদানি হয়েছে ৩১৫টি। অষ্টম সংসদে ৩১১টি, পঞ্চম সংসদে ৩০১টি ও সপ্তম সংসদের মেয়াদে ১৭৬টি গাড়ি আমদানি হয়েছিল। নবম সংসদে প্রশ্নোত্তরকালে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানিয়েছিলেন, ‘৩১৫ জন সাংসদকে শুল্কমুক্ত গাড়ি কেনার সুবিধা দেওয়ায় সরকারকে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার কর রেয়াত দিতে হয়েছে। দুই শতাধিক সাংসদ টয়োটা, ল্যান্ডক্রুজার, প্রাডো অথবা স্টেশনওয়াগন কিনেছেন। ১৮ জন সাংসদ কিনেছেন ভক্সওয়াগন টুরেজ। বাকিরা অন্যান্য মডেলের গাড়ি কিনেছেন; বেশির ভাগ সদস্য ২ থেকে ৪ কোটি টাকার কর রেয়াত পেয়েছেন। বেশ কয়েকজন সাংসদের পাওনা কর রেয়াতের পরিমাণ ৬ কোটি টাকার বেশি।’ (প্রথম আলো, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩)

নবম সংসদের মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াসহ ৩৫ জন সাংসদ শুল্কমুক্ত গাড়ি না নিলেও অন্যদের সঙ্গে জাতীয় পার্টির প্রধান এরশাদ নিয়েছেন। কেননা, তাঁর আমলে করা আইনের সুবিধা তিনি হাতছাড়া করতে চাননি। শুল্কমুক্ত সুবিধাপ্রাপ্ত অনেক সাংসদ গাড়ি হাতবদল করলেও সাজা পেয়েছেন মাত্র একজন—বিএনপিদলীয় সাংসদ হারুনুর রশীদ।

আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চালাচ্ছে। শুল্কমুক্ত সুবিধায় কেনা গাড়ি বিক্রি করে দেওয়া বড় দুর্নীতি এবং যে জনগণ তাদের ‘নির্বাচিত’ করেছেন, তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা।

শুল্কমুক্ত গাড়ি এনে বিক্রি করে দেওয়ার অপরাধে একজন সাংসদ শাস্তি পেয়েছেন। সরকার বাকিদের ধরার চেষ্টা করবে কি?

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি
[email protected]