সংসদ কি নিজের মর্যাদা রক্ষা করবে

জাতীয় সংসদ ভবন। ফাইল ছবি
জাতীয় সংসদ ভবন। ফাইল ছবি

গত কয়েক সপ্তাহের গণমাধ্যমের শিরোনাম থেকে আমরা জেনেছি: ১. জালিয়াতির অভিযোগে নরসিংদী সরকারি কলেজ আওয়ামী লীগ মনোনীত নরসিংদীর সংরক্ষিত আসনের সাংসদ তামান্না নুসরাতের বিএ পরীক্ষা বাতিল করেছে। তাঁর পক্ষে প্রক্সি পরীক্ষা দিতে গিয়ে ধরা পড়ায় কলেজ কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত নেয়। ২. ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি এবং মহাজোটের মনোনীত সাংসদ রাশেদ খান মেনন গত ১৯ অক্টোবর বরিশালে নিজেকে সাক্ষী দাবি করে ৩০ ডিসেম্বর জনগণ ভোট দিতে পারেনি বলে দাবি করেন। অর্থাৎ, জনগণের ভোট ছাড়াই বর্তমান সংসদ গঠিত হয়েছে। ৩. গত ২১ অক্টোবর শুল্কমুক্ত গাড়ি বিক্রির মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকির অভিযোগে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিএনপি–দলীয় সাংসদ হারুনুর রশীদকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেন 

ঢাকার বিশেষ জজ আদালত; এর বিরুদ্ধে তিনি আপিল করেছেন।

প্রচলিত বিধিবিধান অনুযায়ী তিনটি ঘটনাতেই জাতীয় সংসদ ও সংসদের সদস্যদের মর্যাদাহানির প্রশ্ন জড়িত। এমতাবস্থায় প্রশ্ন হলো, সংসদ কি তার মর্যাদা রক্ষা করবে? নাকি তা বিসর্জন দেবে?

বাংলাদেশের সংবিধানে দুটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। সেগুলো হলো: সরকারি হিসাব কমিটি ও বিশেষ অধিকার কমিটি। সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদে সংসদ ও সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তির বিধান রয়েছে, ‘৭৮ (১) সংসদের কার্যধারার বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না। (২) সংসদের যে সদস্য বা কর্মচারীর উপর সংসদের কার্যপ্রণালী নিয়ন্ত্রণ, কার্যপরিচালনা বা শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষমতা ন্যস্ত থাকিবে, তিনি এই সকল ক্ষমতাপ্রয়োগ-সম্পর্কিত কোনো ব্যাপারে কোনো আদালতের এখতিয়ারের অধীন হইবেন না। (৩) সংসদে বা সংসদের কোনো কমিটিতে কিছু বলা বা ভোটদানের জন্য কোনো সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না। (৪) সংসদ কর্তৃক বা সংসদের কর্তৃত্বে কোনো রিপোর্ট, কাগজপত্র, ভোট বা কার্যধারা প্রকাশের জন্য কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো আদালতে কোনো কার্যধারা গ্রহণ করা যাইবে না। (৫) এই অনুচ্ছেদ-সাপেক্ষে সংসদের আইন দ্বারা সংসদের, সংসদের কমিটিসমূহের এবং সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার নির্ধারণ করা যাইতে পারিবে।’

বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তির বিষয়টিকে দুভাবে বিভাজন করা হয়, যেগুলো এককভাবে সাংসদদের জন্য প্রযোজ্য এবং যেগুলো পুরো সংসদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ব্যক্তি সাংসদের বেলায় প্রযোজ্য বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তির ক্ষেত্রগুলো হলো: (ক) বাক্স্বাধীনতা; (খ) দেওয়ানি মামলায় গ্রেপ্তার থেকে অব্যাহতি; (গ) জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালন থেকে অব্যাহতি এবং (ঘ) সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত হওয়া থেকে অব্যাহতি। এগুলো মূলত দায়মুক্তি–সম্পর্কিত অধিকার, যা ব্যক্তি সাংসদকে স্বাধীনভাবে কাজ করার নিশ্চয়তা প্রদান করে। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ১৭২-১৭৬ ধারায় এসব বিষয়–সম্পর্কিত বিধান রয়েছে।

পুরো সংসদের ক্ষেত্রে অধিকার ও ক্ষমতাগুলো হলো: (ক) শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার অধিকার। কোনো ব্যক্তিকে বিশেষ অধিকার ক্ষুণ্ন করার বা সংসদ অবমাননার জন্য শাস্তি প্রদান, যার মধ্যে দুর্নীতি, দুষ্কর্ম ও অসদাচরণের জন্য সংসদ সদস্যদের বহিষ্কার অন্তর্ভুক্ত। সংসদের এ অধিকারকে শাস্তিমূলক ক্ষমতা বলা হয়। (খ) সংসদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের ব্যবস্থাপনা বা কার্যপদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ–সম্পর্কিত ক্ষমতা। (গ) সংসদ সদস্যদের উপস্থিতি ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করার ক্ষমতা। (ঘ) তদন্ত করার, সাক্ষী ও রেকর্ডপত্র তলব করার ক্ষমতা। (ঙ) সাক্ষীদের শপথ প্রদানের ক্ষমতা। (চ) মানহানিকর বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এমন কাগজপত্র প্রকাশ করার ক্ষমতা। কার্যপ্রণালি বিধির ২০১-২০৫ ধারায় এ–সম্পর্কিত বিধান রয়েছে। অন্যভাবে বলতে গেলে, নিজস্ব অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাকে সংসদের বিশেষ অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কোনো ব্যক্তিকে সংসদের অধিকার ক্ষুণ্ন করা বা অবমাননার দায়ে শাস্তি দেওয়ার অধিকারকে ক্ষমতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সংসদে যেকোনো কিছু বলার জন্য কোনো সাংসদ দায়ী না হওয়ার অধিকারই দায়মুক্তি।

সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে বলা না থাকলে কি সংসদ কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে? এ প্রসঙ্গে টমাস এম কুলির আ ট্রিটাইস অন দ্য কনস্টিটিউশন্যাল লিমিটেশনস গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে: সংসদের ‘নিজস্ব সদস্যদের বিশৃঙ্খল আচরণ এবং অন্য ধরনের অবমাননার জন্য শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। তাদের যেকোনো সদস্যকে বহিষ্কারের ক্ষমতা রয়েছে, যদি তারা মনে করে যে কোনো কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সংসদে সদস্যপদ রাখার উপযোগী নন। এই ক্ষমতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংবিধানের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। তবে সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে বলা না থাকলেও এ ক্ষমতা বিদ্যমান। সংসদের মহৎ দায়িত্ব পালনের এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য...এটি একটি রক্ষাকবচমূলক ক্ষমতা।’

আরেকটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন, অসদাচরণের দায়ে একজন সংসদ সদস্যকে বহিষ্কারের ক্ষমতা কি আমাদের সংসদের রয়েছে? এ ক্ষেত্রে সংবিধান বিশেষজ্ঞ প্রয়াত মাহমুদুল ইসলামের কনস্টিটিউশন্যাল ল অব বাংলাদেশ গ্রন্থে প্রদত্ত মতামত বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য, ‘বিশেষ অধিকারের বিষয়টি অর্থহীন, যদি তা ক্ষুণ্ন করার কারণে সংসদের ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতার স্বীকৃতি না দেওয়া হয়। তাই ক্ষমতা আছে কি নেই তা প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হলো কতটুকু আছে।’

প্রসঙ্গত, অর্থের বিনিময়ে সংসদে প্রশ্ন উত্থাপনের এবং স্থানীয় উন্নয়নের জন্য সংসদ সদস্যদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ে অনিয়মের অভিযোগে ২০০৫ সালে একই সঙ্গে ১১ জন সদস্যকে ভারতীয় লোকসভা ও রাজ্যসভা থেকে বহিষ্কার করা হয়, যা আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হয়। রাজা রামপাল বনাম স্পিকার [(২০০৭) ৩ (এসসিসি)] মামলায় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ ৪-১ ভোটের ব্যবধানে এ বহিষ্কারাদেশের পক্ষে রায় দেন। এর আগে ১৯৭৮ সালে ইন্দিরা গান্ধীকে বিচারপ্রক্রিয়ায় বাধাদান ও মিথ্যা মামলা দায়েরের অভিযোগে সংসদ থেকে বহিষ্কার এবং কারাগারে প্রেরণ করা হয়। ২০০৮ সালে বাবুভাই কাতারা নামের এক সাংসদকে নিজের স্ত্রী ও ছেলের পাসপোর্ট ব্যবহারের মাধ্যমে মানব পাচার করার অভিযোগে সংসদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। উল্লেখ্য, বিশেষ অধিকার–সংক্রান্ত ভারতীয় ও বাংলাদেশের সাংবিধানিক বিধান প্রায় একই।

এটি সুস্পষ্ট যে স্নাতক পরীক্ষা দিতে গিয়ে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে তামান্না নুসরাত সংসদের মর্যাদাহানি বা সংসদ অবমাননা করেছেন। এ ব্যাপারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে সংসদ তাঁকে বহিষ্কার করতে পারে।

জনাব রাশেদ খান মেনন বরিশালে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা হয় সত্য, না হয় অসত্য। যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে বর্তমান সংসদের বৈধতাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আর যদি অসত্য হয়ে থাকে, তাহলে তিনি সংসদ সম্পর্কে কুৎসা রটনা করেছেন, যা নিঃসন্দেহে সংসদ অবমাননা। একই সঙ্গে তিনি ব্যক্তিগতভাবে মিথ্যাচার করেছেন, যা অসদাচরণের শামিল। আর তাঁর অসদাচরণও সংসদের মর্যাদাহানি করেছে। উভয় কারণেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে সংসদ তাঁকে বহিষ্কার করতে পারে।

হারুনুর রশীদের শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার বিষয়টি নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধ। তবে একজন ব্যক্তি চূড়ান্তভাবে অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হন না, যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর আপিল প্রক্রিয়া নিঃশেষ না হয় এবং শেষ আপিল আদালত কর্তৃক তিনি দোষী সাব্যস্ত হন। এ কারণেই প্রাথমিক বিচারিক আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরপরই মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া তাঁদের সংসদ সদস্যপদ হারাননি। তাই তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সংসদকে আপিল আদালতের চূড়ান্ত রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

সংসদ অবমাননার দায়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার প্রক্রিয়াটি শুরু করার দায়িত্ব সংসদ ও সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার–সম্পর্কিত ১০ সদস্যের স্থায়ী কমিটির, যার সভাপতি স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। এ কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, রওশন এরশাদ, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, ফজলে রাব্বি মিয়া, আনিসুল হক ও সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। আমাদের এই জ্যেষ্ঠ সাংসদেরা সংসদের মর্যাদা রক্ষার জন্য কি তাঁদের করণীয় করবেন?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক