কেন প্রথম আলো

প্রথম আলোর ভিতটা গড়ে দিয়েছিল আজকের কাগজ। এর দেয়াল-দরজার কারিগর ছিল ভোরের কাগজ। তারপর, ২১ বছর আগে প্রথম আলো যাত্রা শুরু করল। ছাদটা পাকা করল, পরিসর বাড়াল। একসময় একটা শক্তিশালী স্থাপনা হয়ে দাঁড়াল পত্রিকাটি। অথচ আজকের কাগজ বন্ধ হয়ে গেল, ভোরের কাগজ আগের অবস্থা ধরে রাখতে পারল না। প্রথম আলো তাহলে যে টিকে থাকল, সক্ষমতা বাড়াল, একসময় সব পত্রিকাকে পেছনে ফেলে অপ্রতিরোধ্য একটা অবস্থানে পৌঁছে গেল, সেটা কীভাবে?

পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে, কারণগুলোর মধ্যে ছিল সত্য প্রকাশের সাহস, যা আজকের কাগজকে জনপ্রিয় করেছিল; ছিল একদল তরুণ সংবাদকর্মী, কার্টুনচিত্রী, কলাম ও ফিচার লেখকের সাহস, মেধা ও পরিশ্রমের বিনিয়োগ, যাঁদের অনেকেই এখন আর পত্রিকাটির সঙ্গে নেই; ছিল সত্য জানাতে উদ্‌গ্রীব এবং সরকারসহ রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির দাবি তোলা পাঠকসমাজ এবং ছিলেন একুশ শতকে ‘নতুন কিছু হোক’ আশা করা অসংখ্য তরুণ। তাঁরা প্রথম আলোর আট বা ষোলো বা কুড়ি পৃষ্ঠার ভেতরে তাঁদের প্রত্যাশা ও দাবিগুলো নানাভাবে প্রতিফলিত হতে দেখেছেন।

এই সময়ের ভেতর পত্রিকাটি অনেক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে, কিন্তু সেগুলো সামলেও নিয়েছে এবং সামলে নিতে নিতে বিপর্যয় মোকাবিলাটা একটা চর্চার মতো করে ফেলেছে। একটি বিপর্যয় হচ্ছে, এর শুরুর দিন থেকে এ পর্যন্ত সব সরকারের রোষানলে পড়া—কখনো বেশি, কখনো কম। অন্য আরেকটি হচ্ছে দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অভাব, যা বস্তুনিষ্ঠ একটি সমালোচনাকেও বিপদের বড় কারণ করে ফেলতে পারে। এ জন্য পত্রিকাটির মাথার ওপর ডেমোক্লিসের তরবারির মতো একটা বিপদ সব সময় ঝুলে থাকে। বাংলাদেশে ডিজিটাল বিপ্লবের ঢেউ এসে লাগলে মুদ্রিত সংবাদপত্র একটা সংকটে পড়ে যায়। ঘণ্টায় ঘণ্টায় যদি অনলাইনে তাজা খবর পড়া যায়, তাহলে কে আর আজকের সংবাদ জানার জন্য আগামীকাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবে এবং হকারের দেরি হলে অধৈর্য হয়ে পায়চারি করতে থাকবে, যেমন অনেক কাগজের অনেক পাঠক করতেন, এই এক-দেড় দশক আগেও।

ডিজিটাল বিপর্যয়কে ডিজিটাল আশীর্বাদে রূপান্তরিত করা কঠিন, কিন্তু প্রথম আলো অনেকটাই তা-ই করতে পেরেছে এবং এর অনলাইন সংস্করণ এখন পড়েন লাখ লাখ পাঠক। তাঁরা তাঁদের মতামতও জানাতে পারেন—যেকোনো খবর নিয়ে, পত্রিকায় ছাপানো যেকোনো লেখা নিয়ে। সেসব মতামত প্রধানত সরকার ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী এবং প্রায়ই বিরোধী বড়-ছোট দলগুলো নিয়েও পাঠকদের থাকে ক্ষোভ। জাতীয় সংসদে কোনো অর্থপূর্ণ বিতর্কের অভাবে পাঠকদের এসব মতামত যে বিতর্ক চালু রাখে, তা অসূয়া, অশ্লীলতা এবং নানা একচোখা মতবাদ প্রচারকদের অভিব্যক্তি বাদ দিলে—ওই অভাবটি কিছুটা হলেও পূরণ করে। তারপরও এই পরিবর্তন প্রথম আলো পরিবারকে সীমিত করেছে, এর দৃষ্টিকে বাজারের দিকে নিয়ে গেছে। শুরুর দিকে পত্রিকাটির যে উদারনৈতিক ও আদর্শবাদী অবস্থান ছিল, এখন সেখানে একটা করপোরেট ভাব এসেছে। তবে সংবাদমাধ্যমের নতুন বাস্তবতায়—যা তৈরি করেছে প্রধানত পুঁজি ও পণ্যায়নের প্রসার—এটি হয়তো অনিবার্য। এই করপোরেট ভাবটি আমি ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে শুরু করে স্টেটসম্যান পর্যন্ত দেখেছি, নিউইয়র্ক টাইমস-এর মতো বনেদি কাগজেও দেখেছি। এই শতবর্ষী পত্রিকাটি, যাকে এর বয়স ও বিচক্ষণতার জন্য ‘দ্য গ্রে লেডি’ নামেও ডাকা হয়, দু-এক বছর আগে প্রথমবারের মতো প্রথম পৃষ্ঠায় বিজ্ঞাপন ছাপতে বাধ্য হয়েছে, টিকে থাকার জন্য।

আজকের কাগজ যত দিন ছিল, আমি তাতে কালেভদ্রে কলামসদৃশ একটি লেখা লিখতাম। প্রথম আলোর শুরু থেকেই এর সঙ্গে আছি। মনে আছে, শুরুর সংখ্যাটির (অথবা শুরুর দিকের একটি সংখ্যার) জন্য আমাকে একটি লেখা পাঠাতে হয়েছিল নিউইয়র্ক থেকে। হাতে লিখে, একটি দোকানে গিয়ে স্ক্যান করে, ই-মেইলে। এই ২১ বছরে আমি প্রথম আলোর অগ্রযাত্রা দেখেছি, এর সমস্যাগুলো এবং এর ভুলগুলো কোথায়, বুঝতে পেরেছি। একটি সমস্যা ছিল, শুরুতে যেসব তরুণ এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের সবাইকে সঙ্গে রাখতে না পারা। হয়তো একটি কাগজ বড় হতে থাকলে এমনটি হয়। কিন্তু প্রথম আলো তো নিজেকে অনেক কাগজের একটি বলে মনে করে না। হয়তো এ ক্ষেত্রে আরও আন্তরিকতার প্রয়োজন ছিল। দ্বিতীয় একটি সমস্যা ছিল এক-এগারোর পরের দৃশ্যপটে ক্ষমতায় আসা সরকারটি দুর্নীতি, অপশাসন ইত্যাদির বিরুদ্ধে নেমে পড়লে এর সমর্থনে কাগজটির এগিয়ে আসা। যে দুই বছর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারটি ক্ষমতায় ছিল, নিশ্চয় তা সুনীতির পরাকাষ্ঠা দেখায়নি, অপশাসনও কম করেনি। ওই সরকারের একটি উদ্দেশ্য ছিল দুই দলের দুই নেত্রীকে সরিয়ে দিয়ে দল দুটির নতুন বিন্যাস। সেটি ছিল একটি বড় ভুল। কারণ, পরিবর্তন আনতে হয় তৃণমূল থেকে গণতন্ত্রের সব প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করে। কিন্তু অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কেউ ক্ষমতায় গিয়ে আর যাহোক গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে পারে না। অর্থনীতিকে হয়তো পারে, কৃষি অথবা স্বাস্থ্য খাতকেও পারে, কিন্তু গণতন্ত্রকে কখনো না। ওই সরকারের প্রতি প্রথম আলোর সমর্থন অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষ ছিল, যেমন দ্রুত রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া। কিন্তু সেটি হয়নি। সে জন্য এই সমর্থন দেওয়াটা প্রথম আলোর জন্য একটা সমস্যা তৈরি করেছিল।

ডিজিটাল বিপ্লবকে পক্ষে আনতে গিয়ে প্রথম আলোকে নতুন পাঠক সৃষ্টি করতে হচ্ছে। এ জন্য এর বিষয়-আশয়ে অনেক বৈচিত্র্য এসেছে। এগুলো তরুণ পাঠকদের আকৃষ্ট করেছে। কিন্তু স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য যে পাতাটি বের হয়, তাতে গাইড বইয়ের মতো বিষয় নির্দিষ্ট কিছু যে পাঠ দেওয়া হয়, তা শিক্ষার আদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। আমরা চাই শিক্ষার্থীরা শুধু পাঠ্যবই পড়বে না, মুখস্থবিদ্যাকে আদর্শ মানবে না, বরং নানা বিষয়ে বই পড়বে। তাদের শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা গৌণ হবে। তারা প্রকৃতি পাঠ করবে, জীবনকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে জানবে। আশা করি, শিক্ষার্থীদের কিছু পরীক্ষার জন্য তৈরি করার পরিবর্তে তাদের মনের জানালাগুলো খুলে দেওয়ার উদ্যোগটাই ২২ বছরে পা দেওয়া প্রথম আলো নেবে। শিক্ষার পাতায় শিক্ষার নতুন বিন্যাস নিয়ে চিন্তা থাকবে। প্রথম আলোর সঙ্গে আমি আছি, কারণ, পত্রিকাটি এখনো সত্য প্রকাশের চেষ্টা করে, মানুষের সমস্যাগুলো তুলে ধরে, দুর্নীতিবাজদের মুখোশ খুলে দেয়, তরুণদের পাশে থাকে। এর ওপর সরকার রুষ্ট হয়। যেহেতু কোনো সরকারই সমালোচনা পছন্দ করে না। এ জন্য অবশ্য পত্রিকাটি সমালোচনা বন্ধ করে না। এখনো অনেক রুষ্ট পাঠক (যেমন যাঁরা ব্যাংক লুটে নিচ্ছেন বা বালিশ-কাণ্ড থেকে হাজার গুণ বড় কাণ্ড করছেন এবং সকালে উঠে পত্রিকাও পড়ছেন) প্রথমেই প্রথম আলোতে চোখ রাখেন।

প্রথম আলোর সাহসটা আরও বাড়ুক, এর দৃষ্টিটা আরও স্বচ্ছ হোক, এর ঘরটা আরও গোছালো হোক, পাঠককে সঙ্গে নিয়ে এর যাত্রা আরও দূরের হোক, ২২ বছরে পা দেওয়ার মুহূর্তে এর জন্য এই ইচ্ছাগুলো আমার থাকল।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ