ইরাকে নতুন সামাজিক আন্দোলন

ইরাকে চলমান বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স
ইরাকে চলমান বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স

ইরাকে চলমান বিক্ষোভ শিয়া অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে কেন্দ্রীভূত রয়েছে, এখনো সুন্নি বা কুর্দিশ প্রদেশগুলোতে উল্লেখযোগ্যভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। কিন্তু তাই বলে এই বিক্ষোভ শুধু শিয়া সম্প্রদায়ের নয়। শিয়া প্রতীকগুলো বিক্ষোভকারীদের স্লোগানে কেন্দ্রীয় স্থান দখল করেনি এবং বিক্ষোভে শিয়া ধর্মীয় নেতারাও অনুপস্থিত। এসব বিক্ষোভ ইরাকিদের জাতি–গোষ্ঠীগত ও ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে শাসনপ্রক্রিয়ার সাম্প্রদায়িক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেছে।

অক্টোবর মাসের শুরুর দিকে বাগদাদে প্রাথমিকভাবে আর্থসামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের দাবিতে এ বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। শুরুর বিক্ষোভগুলো হয়েছে শহরের পূর্ব অংশে, যেখানে শিয়া জনসংখ্যার ঘনত্ব রয়েছে। মূলত বেকার এবং অল্পবয়সী যুবকেরা এ বিক্ষোভে অংশ নেয়। দাবি পূরণ না হওয়ায় অক্টোবর মাসের শেষ নাগাদ আবার দ্বিতীয় দফার বিক্ষোভ শুরু হয়। শিক্ষার্থী, সুশীল সমাজের সদস্যরাসহ প্রায় সর্বস্তরের মানুষ এ বিক্ষোভে যোগ দেয়। তারা এখন ইরাক সরকারের পতন চাইছে। তারা আসলে গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপরই ক্ষুব্ধ। তারা দেখছে, একের পর এক নির্বাচন হচ্ছে এবং নতুন নতুন নেতা ক্ষমতায় বসছেন, কিন্তু নাগরিকদের ভাগ্যে কোনো পরিবর্তন আসছে না। এটি এখন ইরাকের আধুনিক ইতিহাসে তৃণমূলদের বৃহত্তম সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে, এ বিক্ষোভ নতুন অসাম্প্রদায়িক চিহ্ন এবং প্রতিবাদের একটি ভাষা তৈরি করেছে।

২০০৩ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি ইরাকের প্রভাবশালী শিয়া রাজনৈতিক দলগুলো। এটা ২০১২-১৩ সালের মতো সুন্নিদের বিক্ষোভ নয়। ওই সব বিক্ষোভ কারা করছে, তা সহজেই বোঝা গিয়েছিল। কিন্তু এই বিক্ষোভের সূচনা করেছে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন, কিন্তু যোগ দিয়েছে অন্যরাও। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও হানাহানিকে ১৬ বছর ধরে রাজনীতিকেরা যেভাবে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করছেন, সেটিই মূলত মানুষকে বিক্ষুব্ধ করেছে।

অক্টোবরের গোড়ার দিকে শারক আল-কানাত (বাগদাদের সবচেয়ে পূর্ব দিকে অবস্থিত একটি অঞ্চল) এবং সদর সিটির সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছিল, এই দুটি শহরের জনগণই ব্যাপকভাবে বিক্ষোভে অংশ নেয়। সদর সিটিতে কয়েক দশক ধরে চরম দরিদ্রদের এবং তরুণদের বসবাস। এখান থেকেই সরকারবিরোধী বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়।

এ চলমান বিক্ষোভ আসলে শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি নতুন সীমানা তৈরি করেছে, যাদের একসময় আর্থসামাজিক এবং শ্রেণি পরিচয় দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজন দূর হওয়ার এবং আন্তসাম্প্রদায়িক সংহতি গড়ে তোলার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এ বিক্ষোভ ২০০৩-পরবর্তী রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রাধান্য অর্জনকারী সাম্প্রদায়িক কোটা ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এটি প্রতিবাদের একটি নতুন ভাষা তৈরি করেছে, যা প্রভাবশালী দলগুলো এবং তাদের আদর্শের বিরুদ্ধে যায়।

ইরাকের জনসংখ্যা প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ বৃদ্ধি পায় এবং বছরে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ কাজের বাজারে প্রবেশ করে। সরকারের ব্যাপক দুর্নীতি এবং ক্ষমতাসীন দলগুলোর আগ্রাসী আচরণ সেখানকার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বেচ্ছাচারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান তেল বিক্রি থেকে পাওয়া অর্থ সমভাবে বণ্টনে বরাবরই বাধা দিয়ে এসেছে। আসলে ক্ষমতাসীন দলগুলো সব সময় নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে। জনগণের আশা–আকাঙ্ক্ষা পূরণে তারা কোনো কাজ করেনি। বেকারত্ব, জীবনযাত্রা ও পরিষেবার নিম্নমান এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে এ বিক্ষোভ শুরু হয়। রাজনৈতিক কোনো দল বা ব্যক্তির সমর্থন ছাড়াই রাজপথে নেমে আসে হাজার হাজার মানুষ।

ইরাকের দুর্নীতি কেবল ব্যক্তিগত লোভ এবং নৈতিক অবক্ষয়ের বিষয় নয়; এটি রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। জনগণ যখন দুর্নীতি, দারিদ্র্য এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, তার মানে এই যে তখন তারা সেই রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরোধিতা করছে।

বিক্ষোভের কারণে ইরাকে এখন অচলাবস্থা বিরাজ করছে। বর্তমান অচলাবস্থা এ ইঙ্গিত দেয় যে কোনো অর্থবহ পরিবর্তন আনাটা খুব কঠিন হবে। এর একটি কারণ হচ্ছে জনগণ সরকারের অঙ্গীকারের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে এবং অপর কারণ ইরাকের ক্ষমতা এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত নেই, বরং ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে, ফলে সুষ্ঠুভাবে কোনো সমস্যার সমাধান করতে ইরাক সরকার সমর্থ নয়।

কিন্তু উপায় তো একটা খুঁজে বের করতেই হবে। তা না হলে ইতিমধ্যে সহিংস হয়ে ওঠা বিক্ষোভ আরও মারাত্মক আকার ধারণ করবে, যা আর কোনোভাবেই সামাল দেওয়া যাবে না।

মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
হারিথ হাসান: কার্নেগি মিডল ইস্ট সেন্টারের বিশেষজ্ঞ