বায়ু যেন প্রাণঘাতী না হয়

খারাপ খবরটা আগেই এসেছিল। আরও একবার শোনা গেল কথাটা। জানা গেল, বাংলাদেশের বাতাসে শ্বাস নেওয়া কতটা বিপজ্জনক, এ দেশের পানি কতটা বিষাক্ত হয়ে উঠছে। সম্প্রতি দুটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদন যে তথ্য দিয়েছে তাতে বোঝা যাচ্ছে সামনে আরও ভয়াল পরিস্থিতি থাবার নখরে শাণ দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট (এইচইআই) এবং দ্য ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন (আইএইচএমই) ২০১৭ সালের তথ্যের ভিত্তিতে সম্প্রতি যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেখানে বলা হয়েছে বাংলাদেশে যেসব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে, তার তৃতীয় সর্বোচ্চ কারণ বায়দূষণ। এই দূষণের কারণে মানুষের গড় আয়ুও অন্য সব দেশের চেয়ে বেশি কমছে। এই যখন অবস্থা, তখন অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান মার্কেট ফোর্স এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ৩৫০. ওআরজির যৌথ গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, ২০৩১ সাল নাগাদ বাংলাদেশে যে ৩০টি কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার কথা, তা চালু হওয়ার পর গোটা দেশই ‘কার্বন বোমা’ বিস্ফোরণের শিকার হবে।

প্রথমোক্ত প্রতিবেদন বলছে, অপরিকল্পিত শিল্প, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, ইটভাটা ও নির্মাণকাজে দূষণ প্রতিরোধী ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততার কারণে বাতাস দিন দিন ভারী হচ্ছে। বাতাসে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম) অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণার উপস্থিতি বেড়ে যাচ্ছে। মানবদেহের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর উপাদান পিএম ২.৫। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মান অনুযায়ী, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ১০ মাইক্রোগ্রাম পিএম ২.৫ থাকলে তাকে সহনীয় বলা যেতে পারে। সেখানে দেশে প্রতি ঘনমিটারে পিএম ২.৫ আছে ৬১ মাইক্রোগ্রাম। এর ফলে ফুসফুসে ক্যানসার ও কিডনি বিকলের মতো রোগ ব্যাপকভাবে ছড়াচ্ছে।

বিশ্বব্যাংক আমাদের আগেই সতর্ক করে জানিয়েছে, গোটা বাংলাদেশই বায়ুদূষণের হুমকির মধ্যে আছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে যেখানে সরকারের জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা, তা না নিয়ে উল্টো দূষণ ছড়ানো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বানানোর নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। সারা দুনিয়ায় যেখানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গুটিয়ে নেওয়ার প্রবণতা চলছে, সেখানে আমাদের দেশে তা গ্রহণ করা মোটেও ঠিক হবে না।

দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে, সেখানে ৫২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। ওই কারখানার বর্জ্য আশপাশের নদ–নদীর পানিকে বিষাক্ত করে তুলছে বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। নতুন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাবার পানিতে সিসার যে পরিমাণ উপস্থিতিকে অনুমোদন দেয়, এই কারখানার আশপাশের জলাধারের পানিতে তার চেয়ে ৩৫ থেকে ৩৯৫ গুণ বেশি সিসা পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া এই পানিতে ক্ষতিকর ক্রোমিয়াম উপাদান আছে ৮০২৫ থেকে ১৮৬৭৫ গুণ বেশি। এই যখন অবস্থা, তখন আরও ২৯টি তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র খোলার তৎপরতা চলছে।

মূলত দক্ষিণ উপকূলীয় পায়রা, মাতারবাড়ী ও মহেশখালী এলাকায় এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়ার কথা। এসব কেন্দ্র যখন উৎপাদনে যাবে তখন বাতাস ও পানি কী পরিমাণ দূষিত হবে, তা অনুমান করা যায়। নতুন গবেষণা বলছে, এসব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে দেশকে বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়তে হবে। কারণ এই কেন্দ্রগুলো চালাতে গিয়ে বছরে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার কয়লা আমদানি করতে হবে। এসব বিবেচনায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বানানোর চিন্তাভাবনা থেকে সরে আসতে হবে। একই সঙ্গে বায়ুদূষণ রোধে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশ নামক এই প্লেনে কেউ বিজনেস ক্লাসের যাত্রী, কেউ ইকোনমি ক্লাসের যাত্রী। কিন্তু গোটা প্লেনই যদি বিধ্বস্ত হয়, তাহলে কেউ বাঁচবে না।