মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ইরানের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে

রয়টার্স ফাইল ছবি
রয়টার্স ফাইল ছবি

গত অক্টোবর মাসের শেষ দিকে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) ধারালো শিরোনামসহ একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। শিরোনামটি হচ্ছে ‘ম্যাক্সিমাম প্রেশার: ইউএস ইকোনমিক স্যাংকশনস হার্ম ইরানিয়ানস, রাইট টু হেলথ’। ২০১৮ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে আবার একতরফা নিষেধাজ্ঞাগুলো আরোপ করে। এর মধ্যে অমার্কিন প্রতিষ্ঠাগুলোর ওপর মাঝারি মাত্রার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই মাঝারি মাত্রার নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরান বাইরের দেশগুলো থেকে জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জামসহ বহু পণ্য কিনতে পারছে না।

এইচআরডব্লিউ তার প্রতিবেদনে লিখেছে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে ইরানিদের স্বাস্থ্যসেবা ও প্রয়োজনীয় ওষুধ পাওয়ার অধিকার মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। মৃগী রোগীদের জন্য জটিল ওষুধ থেকে শুরু করে ক্যানসারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কেমোথেরাপির ওষুধ—কোনো কিছুই কিনতে পারছে না ইরান। ইরানের গুরুতর পরিস্থিতি সম্পর্কে এমন প্রতিবেদন এইচআরডব্লিউ প্রথম দিল তা নয়, ২০১৩ সালে সিয়ামাক নামাজি উইলসন সেন্টারের জন্য এ ধরনের একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলেও একতরফা মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ইরানের স্বাস্থ্যব্যবস্থার মারাত্মক ক্ষতি সাধন করেছিল। প্রতিবেদনে সিয়ামাক উল্লেখ করেছিলেন, ‘মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ইরানে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে জীবন রক্ষাকারী আধুনিক ওষুধ এবং এগুলোর রাসায়নিক কাঁচামাল সংগ্রহ করা ইরানের জন্য বিশেষভাবে চ্যালেঞ্জপূর্ণ ছিল।’

বেশ কয়েক বছর ধরে একতরফা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে ইরানের অবনতিশীল স্বাস্থ্য পরিস্থিতির বিষয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা চালিয়েছে চিকিৎসা সাময়িকী দ্য ল্যানসেট। এ বছরের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের পাঁচজন চিকিৎসক দ্য ল্যানসেট–এ একটি শক্তিশালী সম্পাদকীয় লিখেছেন, যাতে উল্লেখ করা হয় যে নিষেধাজ্ঞার ফলে ইরানের সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং দেশটি মারাত্মক পরিস্থিতির দিকে যাওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এক বছর আগে ইরানের একাডেমি অব মেডিকেল সায়েন্সেসের প্রেসিডেন্ট সৈয়দ আলিরেজা জাতিসংঘের মহাসচিবকে বেশ কয়েকটি চিঠি লেখেন। সেসব চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, যেসব রোগীর অঙ্গ প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয় এবং যাদের ক্যানসার রয়েছে, তাদের ‘ইচ্ছাকৃতভাবে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করা হচ্ছে না’। এ চিঠির কোনো প্রকাশ্য উত্তর পাওয়া যায়নি।

মার্কিন নিষেধাজ্ঞা যে ইরানের স্বাস্থ্য অবকাঠামোকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তার বহু প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর কারণে বহু ইরানির মৃত্যু হয়েছে এবং অনেক মানুষ ভোগান্তির মুখে পড়েছে গত বছর। একতরফা দমনমূলক ব্যবস্থার নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে জাতিসংঘের বিশেষ র‍্যাপোর্টিয়ার ইদ্রিস জাজিরি মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলো একনজর দেখে বলেছেন, ‘বর্তমান ব্যবস্থা সন্দেহ ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছে, যার ফলে এসব জরুরি মানবিক সরঞ্জাম আমদানি করা ইরানের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এর প্রভাব হবে মারাত্মক, যেমন ওষুধ ফুরিয়ে গেলে রোগীরা মারা যেতে পারে।’ যুক্তরাষ্ট্র আসলে ইরানের শ্বাস রোধ করার জন্য সম্ভাব্য প্রতিটি কৌশল ব্যবহার করেছে। দেশটির সরকার ইরানের অর্থনীতিতে দৃঢ় প্রভাব বিস্তার করার জন্য তার স্পেশালি ডেজিগনেটেড গ্লোবাল টেররিস্ট (এসডিজিটি) সুবিধা, তার স্পেশালি ডেজিগনেটেড ন্যাশনালস অ্যান্ড ব্লকড পারসন্স (এসডিএন) তালিকা এবং তার ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইমস এনফোর্সমেন্ট নেটওয়ার্ক (ফিনসেন) ব্যবহার করেছে। এইচআরডব্লিউ ও ব্যাংকগুলো ইরানে অর্থ স্থানান্তর করতে তাদের পরিষেবাগুলো ব্যবহার করার অনুমতি দিতে অস্বীকার করছে। এমনকি কোনো মানবিক কারণও তারা বিবেচনা করছে না।

গত আগস্টে নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের প্রধান জ্যান ইজল্যান্ড বলেছেন, ‘আমরা এখন এমন ব্যাংক খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছি, যা দাতাদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে তা ইরানকে পাঠাতে সক্ষম এবং ইচ্ছুক।’ ইজল্যান্ড কোনো অনভিজ্ঞ ব্যক্তি নন। তিনি ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মানবিকবিষয়ক এবং জরুরি ত্রাণবিষয়ক জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন।

ব্যাংকগুলোকে চাপে রেখে মার্কিন সরকার খাদ্য ও ওষুধ আমদানিতে ইরানের ক্ষমতাকে নষ্ট করেছে, যা দেশটির জনগণের মানবাধিকারের ওপর প্রভাব ফেলেছে। এ রকম যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র কেবল ইরানের সরকারকে আঘাত করতে চায় তা নয়, বরং ইরানের জনগণের ওপর আঘাত হানার কৌশল অবলম্বন করেছে।

সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ইরান সরকারের একটি মৌলিক নীতি। ১৯৮৫ সালে দেশটিতে জাতীয় স্বাস্থ্য নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার ওপর নজর দেওয়া হয়েছিল। তবে পরবর্তী কয়েক দশকে প্রয়োজনীয় সম্পদের অভাবে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়নি। তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেশটির স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ইরান গত শতকজুড়ে উন্নত মানের দেশীয় ওষুধশিল্প গড়ে তুলেছিল। মাত্র কয়েক বছর আগপর্যন্ত ইরান বিভিন্ন ধরনের ওষুধ উৎপাদনে সক্ষম ছিল। তবে আমদানিনির্ভর কাঁচামালের অভাবে এখন সেসব ওষুধের উৎপাদন করা আর সম্ভব হচ্ছে না।

কয়েক দিন আগে ভেনেজুয়েলার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রী গ্যাব্রিয়েলা জিমনেজ ১০০ ডায়ালাইসিস মেশিনসহ চিকিৎসা সরঞ্জাম কিনতে তেহরানে গিয়েছিলেন। এ ঘটনা আমাদের দুটি বিষয় বলে: প্রথমত, ইরান নিষেধাজ্ঞার পরেও চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধ উৎপাদন করে চলেছে এবং দ্বিতীয়টি, পশ্চিমাদের হাইব্রিড যুদ্ধের কারণে প্রচণ্ড আঘাত পাওয়া দুটি দেশ তাদের বাণিজ্যের জন্য একে অপরের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ভেনেজুয়েলার চিকিৎসাব্যবস্থা ইরানের তুলনায় আরও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত বছর ভেনেজুয়েলান ফার্মাসিউটিক্যাল ফেডারেশন জানিয়েছে, তারা ৮৫ শতাংশ প্রয়োজনীয় ওষুধের ঘাটতিতে ভুগছে।

এটি ইরানের মনোবলের একটি মানদণ্ড যে যুক্তরাষ্ট্রের এই একতরফা নিষেধাজ্ঞার পরও তারা চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধের উৎপাদন বজায় রাখতে সক্ষম। তারপরও এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনকে একটি সতর্কসংকেত হিসেবে দেখা উচিত।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
বিজয় প্রসাদ: ভারতীয় সাংবাদিক ও ইতিহাসবিদ