বুলবুল ঝড়: দুবলারচরের শুঁটকির জেলেদের কী হবে?

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে মাছধরার ট্রলারগুলো সাগরে টিকতে না পেরে উপকূলে নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান নিয়েছে। কলাপাড়ার আলীপুর-মহিপুর মৎস্যবন্দরের শিববাড়িয়া নদীর ছবি। পটুয়াখালী, ৮ নভেম্বর। ছবি: শংকর দাস
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে মাছধরার ট্রলারগুলো সাগরে টিকতে না পেরে উপকূলে নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান নিয়েছে। কলাপাড়ার আলীপুর-মহিপুর মৎস্যবন্দরের শিববাড়িয়া নদীর ছবি। পটুয়াখালী, ৮ নভেম্বর। ছবি: শংকর দাস

ঘূর্ণিঝড় বুলবুল নিয়ে খুব একটা চিন্তার কিছু নেই বলেই অনেকের বিশ্বাস। আমাদের আবহাওয়া অফিসের ধারণা, বাতাসের গতিবেগ সর্বোচ্চ ১৪৪ কিলোমিটার পর্যন্ত উঠতে পারে। সিডরের সময় বাতাসের গতিবেগ ছিল ২২৩ কিলোমিটার। আইলা বা সিডরের গতিবেগের তুলনায় বুলবুল নিতান্তই নস্যি। উপকূলে আছড়ে পড়ার আগে বুলবুল আরও দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। সে সময় বাতাসের গতিবেগ হতে পারে ১০০ থেকে ১১০ কিলোমিটার পর্যন্ত। তা ছাড়া বুলবুলের ভাবগতি দেখে মনে হচ্ছে সে জনমানবহীন সুন্দরবনের দিকেই ছুটছে। ভয়টা সেখানেই। এই গতির ঝড় মে মাসে হলে চিন্তার কিছু ছিল না। নভেম্বরে বলেই যত দুশ্চিন্তা।

বহদ্দারদের (মহাজন) হাত ধরে বৃহত্তর চট্টগ্রাম, মোংলা, রামপাল, খুলনা, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশালসহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে কয়েক হাজার জেলে আর শুঁটকিশ্রমিক (শুঁটকিদাস বলা ভালো) সুন্দরবনের খোলা উপকূলে চলে আসেন। স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, জেলেরা গত ৩১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার দিনে সেখানে পৌঁছে নিজেদের আবাস নির্মাণে ব্যস্ত ছিলেন। কয়েক হাজার জেলের উপস্থিতিতে সাগরপারের সুন্দরবনের দুবলা ও আশপাশের চর এলাকাগুলো সরগরম হয়ে উঠেছিল সেদিন। বুধবার (৩০ অক্টোবর) বন বিভাগের অনুমতি পাওয়ার পরই গভীর রাতে কয়েক হাজার জেলে বনের গহিনে সাহর উপকূল দুবলাসহ আশপাশের চরের উদ্দেশে রওনা দেন। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে অধিকাংশ জেলেবহরের নৌকা ও ট্রলার ঘাটে এসে পৌঁছায়। তাঁরা দুবলার চরে অস্থায়ী বসতি গড়ে পাঁচ মাস পড়ে থাকবেন শুঁটকিমহালে।

সুন্দরবনের সাগরপারের মেহের আলীর চর, আলোর কোল, অফিস কিল্লা, মাঝের কিল্লা, শেলার চর, নারকেলবাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয়া, বড় আমবাড়িয়া, মানিকখালী, কবরখালী, ছাপড়াখালীর চর, কোকিলমনি ও হলদেখালী প্রভৃতি চরকে সম্মিলিতভাবে দুবলারচর বলা হয়। এসব চরে প্রায় ২০ হাজার জেলে আর শুঁটকিশ্রমিকদের জড়ো করা হয়। বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যেই এই মৌসুমে দুবলার চরে ১২ বহদ্দারকে পাস দেওয়া হয়েছে। বন বিভাগ এবার দুবলারচর থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের টার্গেট নির্ধারণ করেছেন। পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মাহমুদুল হাসান সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এবার টার্গেট ৩ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।


পাস পেয়ে বহদ্দাররা ১ নভেম্বের থেকে (বেসরকারি মতে, আরও আগে থেকেই) অস্থায়ীভাবে হাজারেরও বেশি জেলেঘর ও জেলে-মহাজনদের জন্য পঞ্চাশটি ডিপোঘর স্থাপন করা হয়েছে, হচ্ছে। এরই মধ্যে জেলে-মহাজন আর শুঁটকিশ্রমিকেরা চরে অবস্থান নিয়েছেন। বন বিভাগের মাপে তৈরি ২৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১২ ফুট প্রস্থের এসব ঘর যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা বলতে পারবেন পাঁচ মাসের জন্য বানানো এসব খুপরিঘর ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আইলা সিডর লাগে না। কম মাত্রার বুলবুল ঝড়-তুফান সামলানোর ক্ষমতা তাঁদের নেই। এই এলাকার হাতে গোনা সাইক্লোন আশ্রয়কেন্দ্রগুলো তথাকথিত মৎস্যজীবীদের স্বঘোষিত বড় সংগঠন ‘দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপে’র মালিকদের দখলে। এগুলো তাদের রেস্ট হাউস, অফিস, বালাখানা। পাঁচ মাসের জন্য কেনা শুঁটকিদাসদের সেখানে আশ্রয়ের কোনো ইজাজত নেই।
খুবই সংগত কারণে শুঁটকি মৌসুমে দুবলারচরে থাকতে আসা জেলেরা ঘর তৈরিসহ জ্বালানি হিসেবে সুন্দরবনের গাছ ব্যবহার করতে পারেন না। সব নির্মাণসামগ্রী জ্বালানি কাঠ তাঁদের সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হয়। কাজেই মজবুত ভারী কোনো নির্মাণসামগ্রী তাঁরা বহন করতে পারেন না। ফেরার সময় শুঁটকি মাছকে প্রাধান্য দিতে হয়। তাই এমন সব নির্মাণসামগ্রী নেন যা ফেরত না আনলেও ক্ষতি নেই। মানে সবচেয়ে সস্তা সামগ্রী দিয়েই ছাপরা বেঁধে তাঁদের থাকতে হয়। ঝড়–জলোচ্ছ্বাসে এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাঁদের খোলা আকাশের নিচেই থাকতে হয়। পাঁচ মাসের জন্য কেনা শুঁটকিদাসদের কোনো ছুটি নেই। ফেরার অনুমতি নেই।

গত ফেব্রুয়ারিতে অসময়ের ঝড়বৃষ্টিতে শুঁটকিমহালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। টানা ৭২ ঘণ্টা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ও প্রবল ঝড়ের কারণে সে সময় দুবলারচরের শুঁটকিপল্লির ক্ষতি হয় অনেক। শুঁটকিশ্রমিকদের পাঁচ শর বেশি অস্থায়ী ঘর সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়ে গেলে তাঁরা একেবারেই আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন। এই প্রতিবেদক তাঁদের সে সময় খোলা আকাশের নিচে থাকতে দেখেছেন। সে সময় মহাজনরা জানিয়েছিলেন তাঁদের প্রায় ৫০ লাখ টাকার মাছ নষ্ট হওয়ার হাহুতাস। বন কর্মকর্তারা বলেছিলেন রাজস্ব ঘাটতির আশঙ্কা। কেউ বলেননি শুঁটকিশ্রমিকদের আশ্রয়হীনতার কথা।

এবারও সৃষ্টি হতে চলেছে একই পরিস্থিতি। সামান্য ঝড়ে ‘আসমানির ঘরের’ চেয়েও পলকা ছাউনিগুলো উড়ে যাওয়ার আগে হাজার হাজার পণবন্দী শুঁটকিদাসদের জন্য আমাদের করার কি কিছুই নাই? তাঁদের নিরাপদ এলাকায় সরিয়ে আনার সময় এখনো আছে। কোস্টগার্ড, বন বিভাগ, র‍্যাবের সেই সামর্থ্যও আছে। লাশ উদ্ধারের চেয়ে জীবিত মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে আনা কি উত্তম নয়? হোক না তাঁরা গরিব অসহায় আগাম শ্রম বেচা শিশু–কিশোর–আদম।


গওহার নঈম ওয়ারা: দুর্যোগব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ।