'ফ্রিডম মিজানরা' যেভাবে আওয়ামী লীগে আসেন

আগামী জানুয়ারি মাসে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল এই দুই সিটির সঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হলেও সেখানে মেয়র দায়িত্ব নেন কয়েক মাস পর। ফলে এবার চট্টগ্রাম সিটির নির্বাচন একসঙ্গে হচ্ছে না। নির্বাচন কমিশনের সচিব জানিয়েছেন, ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন হবে জানুয়ারির মাঝামাঝি কিংবা শেষ সপ্তাহে।

অন্যান্য বার ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ঘোষণা এলে যেভাবে নগরবাসীর মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যেত, এবারে তার ছিটেফোঁটাও নেই। এর প্রথম কারণ ভোট দেওয়ার বিষয়ে অনিশ্চয়তা, বাংলাদেশে নির্বাচন সব সময় ভোটাধিকারের নিশ্চয়তা দেয় না। দ্বিতীয় ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো জনগণ যাঁদের নির্বাচন করেন কিংবা যাঁরা নির্বাচন কমিশন দ্বারা নির্বাচিত বলে ঘোষিত হন, তাঁদের পরবর্তী অপকর্মের খতিয়ান। ২০১৫ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই মেয়র পদ তো বটেই, অধিকাংশ কাউন্সিলর পদেও তাদের বিজয় নিশ্চিত করে।

আওয়ামী লীগের নেতারা অতিশয় সজাগ ছিলেন, যাতে বিএনপি-জামায়াতের ‘আগুনসন্ত্রাসীরা’ কেউ জয়ী হতে না পারেন। কিন্তু কথিত আগুনসন্ত্রাসীদের রুখতে তাঁরা যে ফ্রিডম পার্টির সন্ত্রাসীদের ঘরে ঠাঁই দিয়েছিলেন, শুদ্ধি অভিযানের কল্যাণে দেশবাসী সে কথাও জানতে পারল। শুদ্ধি অভিযান না হলে সেই সত্য চাপা পড়েই থাকত। আর আওয়ামী লীগের ‘মনোনীত’ সব জনপ্রতিনিধি নিজেদের খাঁটি জনসেবক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেতেন।

২০১৫ সালে আওয়ামী লীগের ‘মনোনয়ন’ নিয়ে এমন একজন কাউন্সিলর হয়েছেন, যিনি ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এর নাম হাবিবুর রহমান ওরফে মিজান, ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। তিনি ‘ফ্রিডম মিজান’ নামেও পরিচিত। বঙ্গবন্ধু ভবনে হামলার ঘটনায় ১৯৯৭ সালে কেন্দ্রীয় অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ১৬ জনকে আসামি করে মামলার অভিযোগপত্র দেয়, যাতে মিজানকে হামলার পরিকল্পনাকারীদের একজন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। হামলাকারীদের মধ্যে তাঁর ছোট ভাই মোস্তাফিজুর রহমানও ছিলেন।

আওয়ামী লীগের নেতারা ইদানীং অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে বেশ সোচ্চার। অনুপ্রবেশকারীদের বিভাগওয়ারি তালিকাও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তাঁরা কি বলবেন কার হাত ধরে ফ্রিডম মিজানরা আওয়ামী লীগে প্রবেশ করেছিলেন? কীভাবে তাঁরা স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে অভিষিক্ত হলেন? মিজান ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে ৩০০-৪০০ কোটি টাকার টেন্ডারবাজি করার অভিযোগ আছে। এ ছাড়া তিনি ভূমি দখল, চাঁদাবাজিসহ মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পে মাদক ও চোরাই গ্যাস-বিদ্যুতের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করতেন বলেও অভিযোগ আছে। শুদ্ধি অভিযান শুরু হলে মিজান ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পথে শ্রীমঙ্গলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। এখন তিনি কারাগারে। সত্যিকার জনপ্রতিনিধিই বটে!

শুধু ফ্রিডম মিজান নন, র‌্যাবের অভিযানে ধরা পড়েছেন উত্তরের আরেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব ও দক্ষিণের কাউন্সিলর ময়নুল হক ওরফে মনজু। তাঁদের বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজি, মার্কেট দখল, জমি দখল, অবৈধ অস্ত্র ও মাদক রাখা, অবৈধ সম্পদ আহরণ, বিদেশে অর্থ পাচারসহ এন্তার অভিযোগ আছে। তিন কাউন্সিলর গ্রেপ্তার হওয়ার পর তিন ওয়ার্ডের বাসিন্দারা আনন্দ মিছিল বের করেছেন, মিষ্টি বিতরণ করেছেন বলেও পত্রিকায় খবর এসেছে। অন্যদিকে ক্যাসিনো ব্যবসাসহ নানা অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার দায়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদকে বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তিনি পলাতক। শুদ্ধি অভিযানের আগে এই ‘জনসেবকদের’ বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁকে ষড়যন্ত্রকারী বা উন্নয়নবিরোধী বলে চিহ্নিত করতেন। এখন কী বলবেন?

দুই সিটির তিনজন কাউন্সিলর গ্রেপ্তার হওয়া এবং একজন বরখাস্ত হওয়ার অর্থ এই নয় যে আর কারও বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি দখলবাজি ও অবৈধ সম্পদ আহরণের অভিযোগ নেই। শুদ্ধি অভিযানের পর অনেক কাউন্সিলরই গা-ঢাকা দিয়েছেন, কেউ কেউ বিদেশে পালিয়ে গেছেন। যেসব ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিস কিছুদিন আগেও জমজমাট ছিল, তদবিরবাজদের আনাগোনা ছিল, সেসব অফিস এখন ফাঁকা। একেকজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরই যদি পদ ব্যবহার করে এভাবে গডফাদার হয়ে থাকেন, অন্য পদাধিকারীরা কী করেছেন, তা সহজেই অনুমান করা যায়। আগে সংবাদমাধ্যমে লাখ লাখ টাকার দুর্নীতির খবর আসত। এখন আসছে হাজার হাজার কোটি টাকার।

ক্ষমতার অপব্যবহারকারী কাউন্সিলরদের বেশির ভাগই ২০১৫ সালের সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়ে ভেবেছেন, তাঁদের আর কে পায়! দলের সমর্থন পাওয়া মানেই বিজয় নিশ্চিত হওয়া। আর বিজয় মানে নিজ নিজ এলাকার গডফাদার বনে যাওয়া। তাঁরা ‘ভদ্রলোক’ মেয়রদেরও খুব একটা পাত্তা দিতেন না। ফলে দুই সিটির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করলেও ‘মেয়র টিম’ গঠিত হয়নি। নির্বাচিত হওয়ার পর উত্তরের মেয়র আনিসুল হক তাঁর অফিসে ঠিকাদারদের দৌরাত্ম্য কমাতে গেলে তিনি প্রভাবশালীদের বাধার মুখে পড়েন। তারপরও আনিসুল হক নগর ভবনকে যতটা সম্ভব পরিচ্ছন্ন রেখেছিলেন। তিনি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ক্লিন ঢাকা গ্রিন ঢাকা করতে না পারলেও বেশ কিছু সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তিনি গাবতলী টার্মিনাল এলাকা যানজটমুক্ত করেছিলেন, তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড সরাতে পেরেছিলেন। বাকি কাজগুলো করার সময় পাননি। নির্বাচিত হওয়ার দুই বছরের মাথায় তিনি মারা যান। দক্ষিণে তাঁর সহযাত্রী সাঈদ খোকন কিংবা উত্তরে তাঁর উত্তরসূরি আতিকুল ইসলাম দৈনন্দিন কাজ করে গেলেও ভিশন নিয়ে এগোতে পারেননি। ডেঙ্গু তথা এডিস মশা দমনে তাঁদের ব্যর্থতা অমার্জনীয় বললেও কম বলা হবে।

স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনে কোনো দলের নিরঙ্কুশ জয় বিজয়ীদের মনে আত্মতৃপ্তি বাড়ালেও অনেক সময় জনগণের জন্য দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি বিজয়ী দলের জন্য সেটি সুখকর হয় না। ২০১৫ সালে বিভক্ত হওয়া সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে জয় পেয়েছে, ২০০২ সালে অবিভক্ত সিটি নির্বাচনে বিএনপির জয়ের মাত্রা ছিল তার চেয়েও বেশি। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এতটাই বিধ্বস্ত ছিল যে ঢাকায় মেয়র পদে প্রার্থী দিতেই সাহস পায়নি। ফলে বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী সাদেক হোসেন খোকা প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যান। অধিকাংশ কাউন্সিলর পদ বিএনপির দখলে ছিল। পরবর্তী সময়ে আমরা সেই জয়ের করুণ পরিণতিও দেখেছি। বিএনপির চারজন কমিশনার খুন হন অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে। একইভাবে ২০১৫ সালের সিটি নির্বাচনে যখন আওয়ামী লীগ সগৌরবে বিজয় কেতন উড়িয়েছিল, তখন কি কেউ ভাবতে পেরেছিল তাদের উইকেটগুলো এভাবে পড়ে যাবে?

ঢাকা সিটি করপোরেশনে প্রত্যক্ষ ভোটে প্রথম মেয়র নির্বাচন হয় ১৯৯৪ সালের ৩০ জানুয়ারি। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মোহাম্মদ হানিফ বিজয়ী হন। কিন্তু পরদিন লালবাগে বিএনপির পরাজিত কমিশনার (তখন কাউন্সিলররা কমিশনার নামেই অভিহিত হতেন) প্রার্থী আওয়ামী লীগের জয়ী প্রার্থীর বিজয় মিছিলে গুলি করে সাতজনকে হত্যা করেন। বিএনপি আমলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী মহিউদ্দিন চৌধুরী জিতেছিলেন। আবার ২০১৪ সালে পাঁচ সিটিতে বিএনপির মেয়র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছিলেন। এতে কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে যেটুকু ভারসাম্য রক্ষার প্রয়াস ছিল, পরবর্তীকালে সেটি একেবারে ভেঙে পড়ে। বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত মেয়র-কাউন্সিলরদের অনেকের ঠিকানা হয় জেলখানা। এতে বিরোধী দল কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানি না, তবে সরকারি দল যে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার প্রমাণ আওয়ামী লীগের কাউন্সিলরদের পালিয়ে থাকা কিংবা দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের দায়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হওয়া।

আগামী জানুয়ারির নির্বাচনের চেহারাটি কেমন হবে তার ওপরই নির্ভর করছে নগরের বাসিন্দারা ন্যূনতম নাগরিক সেবা পাবেন কি পাবেন না। আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে ঢাকা সিটিকে দুই ভাগ করে দুটি সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করেছে। এতে নগরবাসী এক নগর ভবনের স্থলে দুটি নগর ভবন পেয়েছে, একজন মেয়রের স্থলে দুজন মেয়র। এর বাইরে কোনো লাভ হয়েছে বলে মনে হয় না।

আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো জয়ের জন্য পারে না এমন কিছু নেই। এ কারণেই আওয়ামী লীগ ফ্রিডম পার্টির ক্যাডারদের দলে টেনে নিতে দ্বিধা করে না। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত বিএনপিরও জামায়াতের সঙ্গে গলাগলি করতে বাধে না।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]