যে ফুলের খুশবুতে সারা জাহান মাতোয়ারা

বিশ্বের বিস্ময় নবী ও রাসুলগণের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.), যাঁর তারিফ জগৎময়। ‘বালাগাল উলা বিকামালিহি, কাশাফাদ দুজা বিজামালিহি; হাসুনাত জামিউ খিসালিহি, সল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি।’ পূর্ণতায় যিনি ঊর্ধ্বে সবার, যাঁর নুরের ঝলকে কেটেছে আঁধার; সবকিছুই সুন্দর তাঁর।

জাজিরাতুল আরব বা আরব উপদ্বীপের মরু সাহারায় সে বসন্তে যে গোলাপ ফুটল, তার সৌরভে বিশ্বজগৎ বিমোহিত হলো। সে অনিন্দ্যসুন্দর ফুলের ঘ্রাণে সম্মোহিত হলো সমগ্র দুনিয়া। সে ফুলের রঙে রঙিন হলো আরব-অনারব, সাদা-কালো সব মানুষ; সব বিভেদ ভুলে একত্র হলো এক কাতারে। সৃষ্টির সেরা সে অনুপম অপরূপ অতুল ফুলের নাম মুহাম্মদ রাসুল (সা.)।

তিনি জগতে চৈত্রের খরতাপে দাবদাহের অবসান ঘটিয়ে বসন্তের সুবাতাস বইয়ে দিলেন। স্নিগ্ধ সমীরণে কোকিলকণ্ঠে ধ্বনিত হলো খোদার পাক কালাম। যাঁর সুর মাধুরীতে বিভোর হলো জিন ও ইনসান। তিনি জগৎ থেকে দূর করলেন বর্ণবাদ, জাতিভেদ, ভৌগোলিক বিভেদ ও কুল-মানের ব্যবধান। সব মানুষকে গ্রন্থিত করলেন একই সূত্রে, সবাইকে আসীন করলেন ভ্রাতৃত্বের মর্যাদার সমাসনে। শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার মানদণ্ড নিরূপণ করলেন সত্য বিশ্বাস, সুচিন্তা ও সত্কর্ম সম্পাদন। প্রচার করলেন শান্তি, সম্প্রীতি, ঐক্য, সাম্য, সৌহার্দ্য ও সহাবস্থানের বাণী। স্থাপন করলেন কল্যাণময় সমাজব্যবস্থা, স্থিতিশীলতা ও সৃজনশীল উন্নয়নের নতুন ধারা। সম্মিলন ঘটালেন ধর্ম ও কর্মের। মানুষকে অধিষ্ঠিত করলেন মানবীয় মর্যাদার আসনে। পূর্ণতা দিলেন মানবীয় সদ্‌গুণাবলির।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, আখেরি নবী, আল্লাহর হাবিব, প্রিয় রাসুল (সা.) ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে ১২ রবিউল আউয়াল এই দুনিয়াতে শুভাগমন করেন। তাঁর পিতার নাম খাজা আবদুল্লাহ, মায়ের নাম বিবি আমিনা। তিনি আরবের মক্কা নগরে সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত। রহমাতুল লিল আলামিন ‘সারা বিশ্ব জাহানের জন্য রহমত বা কল্যাণের আধার, শান্তির ধারক-বাহক। আল্লাহ তাআলা কোরআন করিমে বলেন: ‘আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (২১: ১০৭)

আখেরি নবী (সা.)-এর দুনিয়ায় আগমনের দিনটি সারা বিশ্বের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও বরকতময় এবং মানবসভ্যতার সৌভাগ্যের কারণ। তাই বিশ্বনবী (সা.)-এর জন্মদিনটি অত্যন্ত ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে সারা দুনিয়ায় পালিত হয়। কখনো ‘ফাতেহায়ে দোয়াজ দাহুম’, কখনো ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) এবং কখনো ‘সিরাতুন নবী (সা.) নামে। আল্লাহ তাআলা কোরআন করিমে বলেছেন: ‘আর আমি আপনার আলোচনা ও স্মরণকে সমুন্নত করেছি।’ (৯৪: ৪)

সায়্যেদে খায়রুল বাশার, হাদিয়ে রওশন জমির, বাদশাহে দো-আলম, ইমামুল মুরসালিন, খাতামুন নাবিয়্যিন, শাফিউল মুজনেবিন, হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহমদ মুজতবা (সা.) বিশ্বের সব মানুষের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে বলেন: ‘আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর মাঝে তোমাদের জন্য রয়েছে সর্বোত্তম অনুকরণীয় আদর্শ।’ (৩৩: ২১)। ‘নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের সর্বোচ্চে অধিষ্ঠিত।’ (৬৮: ৪)। নবী করিম (সা.) বলেন: ‘আমি উত্তম চরিত্রের পূর্ণতাদানের জন্য প্রেরিত হয়েছি।’ তিনি হলেন বিশ্বশিক্ষক। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: ‘আমি শিক্ষকরূপেই প্রেরিত হয়েছি।’

তিনি শ্রেষ্ঠ নবী, ইমামুল আম্বিয়া নবীগণের প্রধান ও সায়্যিদুল মুরসালিন রাসুলগণের সরদার। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘এই রাসুলগণ, তাদের মধ্যে কাউকে কারও ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। তাদের মধ্যে এমনও কেউ রয়েছে, যার সঙ্গে আল্লাহ কথা বলেছেন, আবার কাউকে উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত করেছেন।’ (২: ২৫৩)।

তিনি ছিলেন ‘আস সুদুকুল আমিন’। আস সুদুক অর্থ মহা সত্যবাদী, আল আমিন মানে বিশ্বস্ত ও বিশ্বাসী। সত্যতা, সততা, ন্যায়বিচার, নিষ্ঠা, বিনয়, নম্রতা, সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণ তাঁর চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কোরআন করিমে বিবরণ: ‘অবশ্যই তোমাদের মধ্য হতেই তোমাদের নিকট এক রাসুল এসেছেন। তোমাদিগকে যাহা বিপন্ন করে উহা তার জন্য কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মোমিনদের প্রতি তিনি দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু।’ (৯: ১২৮)।

মহানবী (সা.) শানে কোরআন করিমে বহু বিবরণ রয়েছে। বিশেষত নবীজি (সা.)-এর গুণগানে ও তাঁর নামে নির্দিষ্ট কিছু বিশেষ সুরাও রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো: সুরা মুহাম্মদ, সুরা ইয়াসিন, সুরা ত্বহা, সুরা মুজ্জাম্মিল, সুরা মুদ্দাসসির, সুরা দুহা, সুরা ইনশিরাহ, সুরা নসর, সুরা কাউসার, সুরা ইসরা, সুরা নাজম, সুরা ফাত্হ ইত্যাদি।

তিনি মানবজাতিকে আঁধার থেকে আলোতে নিয়ে এসেছেন। তিনি রেখে গেছেন আমাদের জন্য মহান আদর্শ। বিদায় হজের ভাষণে তিনি বলে গেছেন: ‘আমি তোমাদের জন্য রেখে যাচ্ছি আল্লাহর কিতাব কোরআন মাজিদ, আমার সুন্নাহ হাদিস শরিফ ও আমার আহলে বাইত। যত দিন
তোমরা এসব আঁকড়ে ধরে থাকবে, তত দিন তোমরা বিপথগামী হবে না।’

প্রিয় নবীজি (সা.)-এর জীবনচরিত ও তাঁর কর্ম-আদর্শ বিশ্লেষণ বিষয়কে ‘সিরাত শাস্ত্র’ বলা হয়। সুন্দর সমাজ ও সফল সার্থক উন্নত জীবনের জন্য আমাদের সিরাত চর্চা করতে হবে, সিরাত তথা নবীর জীবনীবিষয়ক গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন ও অনুসরণ করতে হবে।

সভ্যতার বিকাশে, মানবজাতির উন্নয়নে, মধ্যপন্থা ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনদর্শনে তাঁর অবদান সর্বাধিক। তাই সারা বিশ্ব তাঁর প্রতি চিরকৃতজ্ঞ ও চিরঋণী। অনন্ত দরুদ ও সালাম তাঁর প্রতি এবং তাঁর আহলে বাইত, সব সাহাবির প্রতি ও সব সৎকর্মশীল ন্যায়পরায়ণ একনিষ্ঠ অনুসারীদের প্রতি।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম–এর সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail,com