হতাশা আছে, আছে আশাও

রংপুর
রংপুর

সম্প্রতি সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের আয়োজনে শিক্ষা কনভেনশনে গাইবান্ধায় গিয়েছিলাম। কনভেনশন শেষে বাসদ (মার্ক্সবাদী) জেলা কমিটির সদস্য কাজী আবু রাহেন সফিউল্লাহ বলছিলেন, গাইবান্ধায় বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, শিল্পকারখানা, অর্থনৈতিক জোন কিছুই নেই। ফুলছড়ি ঘাটে ব্রহ্মপুত্র নদে সেতু, টানেল কিছুই হচ্ছে না। এক বছর থেকে ড্রেজিং করলেও ফেরি চালু হচ্ছে না। গাইবান্ধার সাধারণ মানুষ পরিশ্রম করে নিজেদের অবস্থার সামান্য উন্নতি করলেও সরকারি পর্যায় থেকে সামগ্রিক উন্নয়ন হয়নি বললেই চলে।

বাসদের সংগঠকেরা নেপথ্যে থেকে গাইবান্ধা সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় কাজী নজরুল ইসলাম, মাওলানা ভাসানী, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ক্ষুদিরাম বসু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রফুল্ল চাকী, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামে নয়টি পাঠাগার স্থাপন করেছেন। স্থানীয় অনেকেই সেখানে নিয়মিত পড়তে আসেন। নারীমুক্তি আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক নিলুফার ইয়াসমিন শিল্পী বলেন, ‘পাঠাগার প্রতিষ্ঠায় আমরা স্থানীয় লোকজন ও পাঠকদের খুব সাড়া পাচ্ছি। স্থানীয় সাধারণ মানুষের সহায়তায় এ কাজ সম্ভব হচ্ছে।’

গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার কয়েকজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলি। গাইবান্ধা জেলার সাধারণ মানুষ কেমন আছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে প্রবীণ আনিসুর রহমান বলেন, ‘এলা কারও ভাতের অভাব নাই। বিশ-ত্রিশ বছর আগেও মানুষ তিন বেলা ভাত পায় নাই। আগের দিন দুপরা (দুপুরে) ভাত খাছি আর পরের দিন দুপরা ভাত খাছি। আল্লাহর রহমতে গাইবান্ধার মানুষ হামরা এলা খুব ভালো আছি।’

আরেকজন বয়স্ক ব্যক্তি বাল্যবিবাহ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এখন বাল্যবিবাহ অনেক কম। সাধারণত বাল্যবিবাহ নিজ এলাকায় না দিয়ে অন্য কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে নিয়ে সেখানে দেয়।’ তবে চরাঞ্চলে যে বাল্যবিবাহ এখনো প্রকট আছে, সেটি চরের মানুষের স্বীকারোক্তিতে পাওয়া যায়। রংপুরের পীরগাছায় কিছুদিন আগে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তিস্তার চরের আবদুল খালেকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, তাঁদের চরে ১৮ বছরের নিচেই সব মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়।

গাইবান্ধায় যৌতুক প্রথা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। যৌতুক ছাড়া এখন নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর মেয়েদের বিয়ে হয় না বললেই চলে। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় রশিদুল নামের একজন ভ্যানচালক বলছিলেন, ‘বড়লোকের যৌতুক এখন অন্য রকম। চাওয়া নাগে না। মেয়ের বাবা নিজেই বোঝে কী কী দেওয়ার দরকার।’ বাল্যবিবাহ অনেকটা কমানো সম্ভব হলেও যৌতুক এখনো কমানো যায়নি। একজন গরিব মেয়ের বাবাকে ক্ষেত্রবিশেষে এখনো লক্ষাধিক টাকা যৌতুক দিতে হচ্ছে।

গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জে গিয়েছিলাম করতোয়া (বগুড়া) নদীর অবস্থা দেখতে। রংপুরের পীরগঞ্জ থেকে করতোয়া নদী প্রবাহিত হয়ে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার খুলসিতে দুটি ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। এ নদীর একটি অংশ করতোয়া নাম নিয়ে দক্ষিণে বগুড়ার দিকে, আরেকটি পূর্ব দিকে বাঙ্গালী নাম নিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। খুলসি নামক স্থানে করতোয়ার বিভাজন অংশে মাত্র ১৪-১৫ ফুট একটি স্লুইসগেট তৈরি করা আছে। ১৪-১৫ ফুট স্লুইসগেট দিয়ে বিশাল করতোয়ার পানি পাওয়া অসম্ভব। করতোয়ার বিভাজন অংশে মুখ ছোট করে দিয়ে করতোয়া নদীর সর্বনাশ করা হয়েছে। করতোয়া খনন ও পরিচর্যার জন্য সরকার ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। শুধু খনন করে, দখল উচ্ছেদ করে, দূষণ রোধ করে করতোয়ার প্রাণ ফেরানো যাবে না। পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি করার কোনো বিকল্প নেই। সে জন্য উৎসমুখের সরু স্লুইসগেট তুলে দিতে হবে।

শহরের ভেতর ঘাঘট নদের পুরোনো প্রাকৃতিক খাত বন্ধ করে নতুন একটি খাত সৃষ্টি করা হয়েছে। পুরোনো ঘাঘটের ভেতর স্থানীয় অসাধু চক্র প্রশাসনের চোখের সামনেই অনেক স্থাপনা গড়ে তুলছে।

গাইবান্ধা জেলা শহরের প্রাণ হচ্ছে জেলা পৌর পার্ক। পার্কের ভেতর চারদিক ঘিরে অনেক ছোট দোকান। সারা দিনই এই পার্কে অসংখ্য মানুষ আসে। শহরের মানুষের প্রাণ খুলে নিশ্বাস নেওয়ার জন্য এ পার্কটির গুরুত্ব অপরিসীম। পার্কের কেন্দ্রে একটি পুকুর ও ভেতরেই একটি গ্রন্থাগার রয়েছে। গ্রন্থাগারটির পরিচর্যা জরুরি। গ্রন্থাগারটি পাঠকদের আকৃষ্ট করার মতো উপযোগী করতে পারলে প্রচুর পাঠক পাওয়া সম্ভব। পার্কের একটি কোণে একটি ছাউনি বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য নির্ধারিত করা আছে।

গাইবান্ধার কমিউনিটি রেডিও সারাবেলার অনেক শ্রোতা। শহরের চারদিকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত রেডিও সারাবেলা শোনা যায়। রেডিও সারাবেলার জ্যেষ্ঠ স্টেশন ব্যবস্থাপক মাহফুজ ফারুক বলছিলেন, যাদের কথা গণমাধ্যমগুলোতে আসে না, সেই সব অধিকার এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে রেডিও সারাবেলা সুযোগ দিয়ে থাকে। রেডিও সারাবেলার শতাধিক শ্রোতা ক্লাব আছে। রেডিওটির কিছু কিছু প্রতিবেদন পুরস্কার পেয়েছে। তার মধ্যে ‘শিশু ধর্ষণ ও এর মনো-সামাজিক প্রভাব’ শীর্ষক সান্তা সূত্রধরের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ‘এশিয়া প্যাসিফিক ব্রডকাস্টিং ইউনিয়ন অ্যাওয়ার্ড’ (এবিইউ)-২০১৭ লাভ করে।

শিক্ষা-স্বাস্থ্য, সরকারি বরাদ্দ সব দিক থেকে পিছিয়ে থাকা গাইবান্ধা জেলার মানুষ আগের চেয়ে এখন অনেক ভালো আছে। তবে সারা দেশের গড় উন্নয়ন থেকে অনেকটাই পিছিয়ে এই জেলা। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা ১০টি জেলার একটি গাইবান্ধা। উন্নয়নবৈষম্য দূর করতে গাইবান্ধার উন্নয়নে সরকারকে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

তুহিন ওয়াদুদ: রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপল–এর পরিচালক
[email protected]