ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের ক্ষয়ক্ষতি

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র এখনো এসে পৌঁছায়নি; তবে আমাদের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করে গতকাল সোমবার দুপুর পর্যন্ত যে অসম্পূর্ণ চিত্র পাওয়া গেল, তাতে বিপুলসংখ্যক মানুষের দুর্ভোগের বিষয়টি অনুমান করা যায়। গতকাল সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড় বুলবুলে মৃতের সংখ্যা ১৩ তে দাঁড়িয়েছে। এর আগে রোববারেই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রীর বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর বেরোয়, ২ জন নিহত ও ৩০ জন আহত হয়েছে এবং চার থেকে পাঁচ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সোমবার দুপুরে আমরা জানতে পারি, শুধু সাতক্ষীরা জেলাতেই প্রায় ১৭ হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে এবং ৩৫ হাজার আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে ৫ হাজার ১৪টি চিংড়িঘের। বিপুলসংখ্যক গাছপালা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যারা আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের অধিকাংশই নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরে গেছে। তবে তাদের মধ্যে একটা বড় অংশই ফিরে গিয়ে দেখতে পেয়েছে, তাদের ঘরবাড়ি ভূমিসাৎ হয়েছে।

বাগেরহাট, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও ভোলা জেলায়ও বিপুলসংখ্যক মানুষের ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিপুলসংখ্যক গাছপালা। ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমন ফসল ও শীতকালীন শাকসবজি। যাঁদের ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে, তাঁরা সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার। এর মধ্যে অনেক শিশু ও গর্ভবতী নারী আছেন। সাতক্ষীরা জেলায় গৃহহীন হয়ে পড়া গর্ভবর্তী ও অসুস্থ নারী-শিশুদের কেউ কেউ এখনো ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রেই রয়ে গেছে। সবচেয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের ঘরে ঘরে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে এবং পুরো এলাকাতেই খাওয়ার পানির সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষত, খাওয়ার পানি সরবরাহ করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। গৃহহীন পরিবারগুলোর ঘরবাড়ি নির্মাণ ও মেরামতের কাজে সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন। সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় জেলাগুলোর বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবিকা কৃষিকাজ ও চিংড়িঘেরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। দুটোই ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে কর্মসংস্থানের সংকট প্রকট হবে এবং তা আগামী দুই-তিন মাস চলবে। এই সময় এসব মানুষের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করা কিংবা অন্য কোনোভাবে আয়ের ব্যবস্থা করা যায় কি না, তা ভেবে দেখা উচিত।

ঘূর্ণিঝড় বুলবুল দক্ষিণাঞ্চলের বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবন-জীবিকার স্বাভাবিক ছন্দ ও গতি ওলট-পালট করে দিয়ে গেছে। এর ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠে আবার নতুন করে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরু করার সংগ্রামে রাষ্ট্রকে এসব মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত। বুলবুলের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ওপরে যে আকস্মিক দারিদ্র্য চেপে বসল, এর ফলে নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টিগত পরিস্থিতির অবনমন ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। তাই তারা যত তাড়াতাড়ি সব ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারে, রাষ্ট্রের উচিত সেই লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। প্রচুর প্রাণহানি ঘটেনি বলে বুলবুলের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর দিকে সরকারের সংবেদনশীল দৃষ্টি পড়বে না, এমনটি যেন না ঘটে।

ঘূর্ণিঝড় বুলবুল প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয়ের প্রতি আমরা বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে চাই। যতটা আশঙ্কা করা হয়েছিল, সুন্দরবনের বাধার কারণে বুলবুল ততটা প্রলয়ংকরী রূপ ধারণ করতে পারেনি। বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমে জানানো হয়েছে, বুলবুল বাংলাদেশ ভূখণ্ডে আঘাত হানার শুরুতে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ১৪০ কিলোমিটার। সুন্দরবনের গাছপালায় বাধা পেয়ে ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ১০০ কিলোমিটারে নেমে যায়। এই পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবনের সহায়ক ভূমিকার গুরুত্ব আবার পরিষ্কার হলো। সুতরাং সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, এমন সব ধরনের উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ড অবিলম্বে নিষিদ্ধ করা উচিত।