বিকাশমান অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা

বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংক

বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পাঠের সময় আমাদের পড়ানো হতো ডিককের সেন্ট্রাল ব্যাংকিং। ডিকক নিজেই দক্ষিণ আফ্রিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন। তাঁর মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ হলো প্রবৃদ্ধিকে সহজতর ও ত্বরান্বিত করা। সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অস্ত্র হলো মুদ্রানীতি। মুদ্রানীতির দুটি বাহক হচ্ছে সুদ এবং বিনিময় হার। দেশে দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের সৃষ্টি তথা জিডিপি প্রবৃদ্ধি কিংবা উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এতে অর্থনীতিতে ব্যাপকতর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, অর্থনীতির সক্ষমতা বাড়ে এবং অর্থনীতির পরিসর বা ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পায়।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, মুদ্রানীতি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনেক ভালো কাজ করেছে, যেখানে সুদের হারের উত্থান-পতনের মাধ্যমে বিনিয়োগকে, উৎপাদনশীলতাকে সহায়তা করেছে। উপরন্তু বাজারের নিজস্ব নির্যাতন পদ্ধতি থেকে গরিব মানুষ, শ্রমিককে রক্ষা করার ক্ষেত্রেও মুদ্রানীতি বেশ কাজ করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে, মুদ্রানীতির পাশাপাশি পরিপূরক রাজস্ব নীতিও প্রয়োজন।

নব্বইয়ের দশকে দেখতে পেয়েছি, উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশে শুধু সুদের হার কমালেই বিনিয়োগ বাড়ছে না। বিনিয়োগ বাড়াতে অনেক সময় অর্থকে সহজলভ্য করতে হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সুদের হার কমানোর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সত্যিকার উদ্যোক্তারা সহজেই অর্থ পাচ্ছে কি না এবং সত্যিকারের উদ্যোক্তার কাছে অর্থটা পৌঁছাচ্ছে কি না।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে দেখা গেল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতিকে আরও সম্প্রসারণ করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে মুদ্রানীতি প্রণয়ন, পর্যালোচনা, সুদ ও বিনিময় হারের নজরদারি শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ হতে পারে না। সরকার তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে উন্নয়নকে প্রসারিত, অর্থায়নকে সহজলভ্য করতে হলে আরও দুটি বিষয় দেখতে হবে। এক. আর্থিক খাতের দক্ষতা-শৃঙ্খলা এবং দুই. আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা।

নব্বইয়ের দশকে যুক্তরাজ্যসহ অনেকগুলো দেশে দেখা গেছে, তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং নজরদারি সংস্থাগুলোকে আলাদা করে ফেলেছে। বাংলাদেশেও আলোচনা হয়েছে, বেশি বেশি মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কাজ করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নজরদারিতে পিছিয়ে পড়ছে কি না। তৃতীয় যে বিষয়টি হলো, সত্যিকারের উদ্যোক্তারা অর্থ পাচ্ছে কি না। ইতিহাস বলে, যাদের প্রয়োজন নেই, তাদের কাছে অর্থ গেলে ফেরত কম আসে। ওই উদ্যোক্তাকে বা তার পরিবারকে তারা দুষ্ট হতে শেখায়।

সময়ের আবর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটা বিরাট কাজ হয়ে দাঁড়াল যতটা না বেশি ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করা, তার থেকে বেশি ঋণ যাতে সঠিক উদ্যোক্তার কাছে যায়, সেটা নিশ্চিত করা। দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বৃত্তাবদ্ধ ধারণা থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। রাজস্ব নীতির সঙ্গে সংগতি রেখে মুদ্রানীতি প্রণয়ন, আর্থিক খাতের দক্ষতা বৃদ্ধি ও শৃঙ্খলা বিধান, ঋণ সহজলভ্য করা, আমানতকারীর জীবনকে আরও সহজতর করা, ব্যাংকগুলো যাতে নতুন নতুন পণ্য-সমারোহ সৃষ্টি করে, তাতে উৎসাহ জোগানো, ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা আনা, ব্যাংকিং খাতে মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা দক্ষ করে তোলা। সর্বোপরি, সত্যিকার উদ্যোক্তা যাতে অর্থ পায় এবং দুষ্ট লোকেরা যাতে অর্থ নিয়ে দুষ্টামি না করতে পারে, তার ব্যবস্থা করা।

এবার বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যায়ন করা যাক। পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশ ব্যাংক ইদানীংকালে মুদ্রানীতি নিয়ে অনেকটা কৃতিত্বের ভাগীদার হতে চেয়েছে। দ্বিতীয় যেটা চেষ্টা করেছে সেটা হলো, অর্থ যাতে কিছুটা সহজলভ্য হয়। বলতে গেলে, বাংলাদেশ ব্যাংক সে ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা এগিয়েছে। একটি ক্ষেত্রে তারা এগোতে পারেনি, সেটা হলো আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা-নিয়মানুবর্তিতা নিশ্চিত, আর্থিক খাতের সেবা পণ্যের সমারোহ বৃদ্ধি এবং আর্থিক খাত যাতে সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সামগ্রিকভাবে দক্ষতা আনতে পারে, সেটা নিশ্চিত করা। আমরা যাঁরা বাইরের ব্যাংকে কাজ করতাম তাঁদের প্রায়ই শুনতে হতো, আপনাদের দেশের আর্থিক খাতের গভীরতা নেই, আর্থিক খাতে বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্য-সমারোহ নেই এবং আর্থিক খাতে সেবা উন্নয়ন বেশ শ্লথ।

সন্দেহ নেই, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভালো কাজ করেছে। তারা গরিবের কথা ভোলেনি। কিন্তু আমরা তো ধীরে ধীরে সরে এসেছি নতুন ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায়। আমরা অনেক বড় বা মহিরুহ কর্মযজ্ঞ সৃষ্টি করব, বিপুল বিনিয়োগ হবে, ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে, প্রচুর লোক চাকরি পাবে এবং প্রচুর লোকের আর্থিক জীবনে পরিবর্তন আসবে। সে ক্ষেত্রে তো আমাদের অনেক কোম্পানিকে নিয়ে যেতে হবে পুঁজিবাজারে। আরও কোম্পানিকে নিয়ে যেতে হবে স্বল্প সুদে কীভাবে সে বিদেশ থেকে অর্থ পেতে পারে। আমাদের ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানুয়েল কি সে কথা বলে?

সময়ের পরম্পরায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকাও পরিবর্তন হয়েছে। সাবেক এক গভর্নর আমাকে একবার বলেছিলেন—আমাদের মতো দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শুধু মুদ্রানীতি আর আর্থিক খাতে সক্ষমতা বৃদ্ধি নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। সেখানে কৃষক, শ্রমিকের কথা ভাবতে হবে। সত্যি কথা হলো, গণচীন নিজেই উপলব্ধি করেছে কৃষি নয়, শিল্পই দেশটির উন্নয়নের প্রধান মাধ্যম; ভবিষ্যতের কান্ডারি। আমরা ব্যক্তি খাতের শিল্পকে এগিয়ে নিতে কী করেছি?

আরেকটি বিষয়, গভর্নররা অনেক সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেছেন। এটা নিঃসন্দেহে দরকার। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা মানে স্বাধীনতা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কোথায় কোথায় প্রয়োজন, সেটা চিহ্নিত করা, সেটাকে নিয়ে বসা, সেটার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করা এবং সেটা নিয়ে কাজ করা। স্বায়ত্তশাসনের অর্থ হলো নিজেদের পরিচালন সক্ষমতা অর্জন, ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাকে ক্রমাগত সহায়তা করা, ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালীভাবে নজরদারি এবং ব্যাংকের অর্থ যেন সত্যিকার উদ্যোক্তা, কৃষকের জন্য সহজলভ্য হয়, সেটা নিশ্চিত করতে পারা এবং সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাত যেন উন্নত প্রযুক্তি ও সেবা প্রদানের মাধ্যমে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে পারে, তার ব্যবস্থা করা।

আমরা সে ধরনের স্বায়ত্তশাসন চাই, যে ধরনের স্বায়ত্তশাসনে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত বা বাণিজ্যিক ব্যাংকের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্তাদের অপসারণের পাশাপাশি শর্ষের ভেতরে ভূত আছে কি না, সেটার ব্যাপারেও অবস্থান নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক