সেলিব্রিটির ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে চঞ্চলতা কেন

’সেলিব্রিটি’ কথাটির আভিধানিক অর্থ ‘বিখ্যাত বা সুপরিচিত ব্যক্তি’। মূলত খেলাধুলা ও বিনোদন জগতের বিখ্যাত ব্যক্তিরা ‘সেলিব্রিটি’র তকমা লাভ করেন। সেলিব্রিটিদের নিয়ে সারা বিশ্বেই সাধারণ মানুষের কমবেশি উন্মাদনা আছে। এই সেলিব্রিটিদের অনেকে আবার ‘তারকা’ বলেও ডাকেন। এই তারকাদের অনেকেই আছেন, যাঁরা নীরবে–নিভৃতে থাকতে ভালোবাসেন। আবার অনেকে আছেন যাঁরা শুধু আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার প্রয়াসে বৈচিত্র্যময় আলো ঝলমলে জীবন যাপন করেন। অনেকেই তাঁদের আকাশের তারকার সঙ্গে তুলনা করেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এই সব মানব তারকাদের নিয়ে আমাদের মধ্যে যে কৌতূহলের বাহুল্য চোখে পড়ে, সত্যিকারের আকাশের তারকাদের নিয়ে আমাদের সেই আগ্রহ চোখে পড়ে না। মানব তারকা চেনার, জানার এবং তাঁদের জীবনযাপনের চুলচেরা বিশ্লেষণে আমাদের কৌতূহলের কমতি নেই। কখনো কখনো সেই কৌতূহল সীমা অতিক্রম করে। আমরা ভুলে যাই সেলিব্রিটিরাও মানুষ, তাঁদের রয়েছে ব্যক্তিগত জীবন, ব্যক্তিগত মুহূর্ত এবং সুখ-দুঃখের অনুভূতি।

সেলিব্রিটিদের নিয়ে মানুষের এই উন্মাদনার অন্যতম বড় কারণ হিসেবে মনে করা হয় খ্যাতির প্রতি মানুষের অমোঘ আকর্ষণ। মানুষের বিখ্যাত হওয়ার বাসনা চিরন্তন। কারও কারও এই বাসনা প্রকাশিত হয় আবার কারও কারও ক্ষেত্রে তা রয়ে যায় সুপ্ত অবস্থায়। অনেকে আবার নিজেদের অস্তিত্ব খুঁজে ফেরেন বিখ্যাতদের ব্যক্তিগত জীবনে। আজও মনে পড়ে, স্কুলজীবনে পাকিস্তানি তারকা ক্রিকেটার আকিব জাভেদ, শহীদ আফ্রিদি, ভারতীয় ফিল্ম স্টার শাহরুখ খান কিংবা বাংলাদেশের সালমান শাহর প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া মেয়েগুলোর কথা। অনেকে মনে করেন তারকাদের জীবনযাপন আলাদা। তাঁরা যেন ভিন্ন কোনো গ্রহের প্রাণী। তাঁদের জীবনযাপন আমাদের মতো ৯টা ৫টা অফিস সময়ের ফ্রেমে বন্দী নয়। তাঁরা হয়তো একেবারেই অন্য রকম বিলাসী জীবন যাপন করেন।

আবার অনেকে সেলিব্রিটিদের নিজের খুব কাছের মানুষ, পরিচিত কেউ বলে মনে করেন। আর মনে করবেন না–ই বা কেন! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমের বদৌলতে তারকাদের নানা খবরাখবর আজ আমাদের হাতের মুঠোয়। কে কখন কার সঙ্গে প্রেম করছেন, কে কখন কাকে বিয়ে করছেন, কার সঙ্গে কার বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে, কে কখন সন্তানসম্ভবা হচ্ছেন, কোন পাঁচ তারকা হাসপাতালে কোন তারকার সন্তানের জন্ম হচ্ছে—এসব চটকদার খবর আমাদের মুঠোবন্দী। আমরা তাঁদের জীবনযাপন নিয়ে যত খবর রাখি, অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের খবরও অতটা রাখি না। এসব খবরকে পুঁজি করে চলছে বাণিজ্য, পাতা হচ্ছে মুনাফার ফাঁদ। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা তারকাদের ব্যক্তিগত জীবনযাপন নিয়ে নানা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন এবং আমরাও তাঁদের চাঞ্চল্য সুষ্টির ফাঁদে পা দিই। লাইক, শেয়ার আর ভিউয়ের বদৌলতে ব্যবসাও হয় মিডিয়ার। অথচ কত ভালো ভালো মূল্যবান খবর আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে রয়ে যায়।

বিখ্যাত হওয়ার যেমন আনন্দ আছে, তেমনি রয়েছে যন্ত্রণা। বিখ্যাতদের ব্যক্তিগত জীবন প্রায়শই ঝুঁকিতে পড়ে। এই ঝুঁকি মেনে নিয়েই তারকারা তারকা হন। তারকাদের জীবনযাপন নিয়ে যেহেতু সাধারণ মানুষের আগ্রহ অনেক বেশি, তাই তাঁদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা আর প্রাইভেসি রক্ষার ক্ষেত্রে আরও বেশি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। আরেকটি ব্যাপার সত্য যে একজন তারকা ভালো ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত তৈরি ও ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে থাকেন, যা সাধারণের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। অনেকেই আছেন যাঁরা তারকাদের নিজেদের ব্যক্তিজীবনে আদর্শ ও অনুকরণীয় বলে মনে করেন। তাই সাধারণের প্রতি তারকাদের দায়বদ্ধতার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে তারকাদের ‘ব্যক্তিগত’ জীবন নিয়ে আমরা সাধারণ মানুষ যাঁরা আবেগ–অনুভূতির অতিরিক্ত প্রকাশ ঘটাই, তাঁরা নিজেরা আসলে নিজেদের আত্মমর্যাদার প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল, তা ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে।

বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জয়জয়কার। আমাদের প্রিয় তারকার কোনো খবর আমরা কীভাবে শেয়ার করছি, তার ওপর কিন্তু নির্ভর করে আপনার–আমার রুচির বহিঃপ্রকাশ। যা অনাকাঙ্ক্ষিত, অরুচিকর বলে আমরা বিশ্বাস করি, তা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগী হওয়া কোনো অবস্থাতেই নিজের আত্মমর্যাদাকে বাড়ায় না। আমাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে ব্যক্তিগত জীবন ও ব্যক্তিগত মুহূর্ত। আমরা অনেকেই এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বুঁদ হয়ে থাকি। অন্যের গোপন মুহূর্ত পাবলিক করে দেওয়ার আগে একবার তলিয়ে দেখা প্রয়োজন আমাদের নিজেদের সততা, নৈতিকতা আর আদর্শের জায়গাটি। আমরা কয়জন আমাদের ব্যক্তিগত চ্যাটবক্সগুলো দূষণমুক্ত রাখতে পেরেছি! যে আঙুল আমরা অন্যের দিকে তুলছি, সেই আঙুলগুলো যেন কোনো কারণে আমাদের নিজেদের দিকে নির্দেশিত না হয়, সে বিষয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

যা আমরা চর্চা করি না কিংবা বিশ্বাস করি না, তা ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে কোনো মাহাত্ম্য নেই। প্রত্যেক মানুষের রয়েছে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার। তারকারা আলাদা কোনো জগতের বাসিন্দা নন। মিডিয়াতে যাঁরা নিয়মিত কাজ করেন, সেখানে তাঁরা যে খ্যাতি অর্জন করেন, তা মূলত তাঁরা তাঁদের পেশাগত কারণেই করেন। বিষয়টিকে পেশাগত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলে তারকাদের ‘ব্যক্তিগত’ জায়গাটির প্রতি অনেক বেশি শ্রদ্ধাশীল থাকা যায়। শুধু সেলিব্রিটিই নয়, যেকোনো মানুষের সম্মতি ব্যতীত তাঁর ব্যক্তিগত বিষয় বাইরে প্রকাশ ও প্রচার অর্থ মানবাধিকার লঙ্ঘন করা। এটি সাইবার অপরাধও বটে এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আসুন, আমরা যা অনাকাঙ্ক্ষিত তা প্রচারে সহায়ক হওয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখি, অন্যের সম্মানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই এবং নিজেরা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন হই।

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক
[email protected]