নিউমোনিয়া নিরাময়ে আমাদের উদ্ভাবনী উদ্যোগ

শিশুদের নিউমোনিয়া রোগের প্রতিকার নিয়ে সেদিন প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনায় আমাদের ডাক্তারদের অন্তত দুটি সফল ও উদ্ভাবনী উদ্যোগের কথা আলোচনায় এসেছে। আমরা অনেকেই জানি না যে বাংলাদেশের কয়েকজন চিকিৎসক ও ইউনিসেফসহ কিছু প্রতিষ্ঠান গবেষণা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এমন কয়েকটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে, যা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত চরম সংকটাপন্ন শিশুদের বাঁচতে সাহায্য করে। অবশ্য দ্রুত চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক তো অবশ্যই দরকার। কিন্তু তখন হয়তো শিশুর শেষ সময় এসে গেছে। এ অবস্থায় সস্তা ও সহজলভ্য অক্সিজেন বোতল ব্যবহার করে শিশুকে অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা যায়। 

আইসিডিডিআরবির ডা. মুহাম্মদ যোবায়ের জানালেন, তাঁরা ডা. চিশতির নেতৃত্বে গবেষণা করে একটি সহজলভ্য ও টেকসই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। সংকটাপন্ন শিশুকে বাঁচাতে হলে উচ্চ চাপে অক্সিজেন সরবরাহ করতে হয়। বিশেষজ্ঞরা প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করে উচ্চ চাপে অক্সিজেন সরবরাহের মাধ্যমে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত খুব সংকটাপন্ন শিশুদের মৃত্যুহার ৩৫ শতাংশ কমিয়ে আনতে পেরেছেন। 

ইথিওপিয়া থেকে একটি প্রতিনিধিদল সম্প্রতি ঢাকায় এসে এই নতুন উদ্ভাবিত প্রযুক্তি দেখে গেছে। তারা এ পদ্ধতি ব্যবহারে উৎসাহী। এখন ওরা তাদের দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে এর ফলপ্রসূতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে। আইসিডিডিআরবির একটি টিমও ইথিওপিয়া সরকারের সহযোগিতায় সেখানে কাজ করছে। 

উচ্চ চাপে অক্সিজেন সরবরাহের যে প্রযুক্তি রয়েছে, তার দাম প্রায় ১০-১২ হাজার ডলার। মানে ৮-১০ লাখ টাকা। আর আমাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির দাম মাত্র ৩০-৪০ টাকা। 

অন্যদিকে বিদেশ থেকে আমদানি করা একটি ছোট যন্ত্র আমরা ব্যবহার করতে পারি। সেটা বাতাস থেকে অক্সিজেন টেনে নিয়ে শিশুদের চাহিদা পূরণ করতে পারে। এর জন্য আলাদা অক্সিজেন রিজার্ভার লাগে না। এর দাম ৩৫-৪০ হাজার টাকা। কিন্তু অক্সিজেন রিজার্ভারের তুলনায় অনেক কম। ফলে গ্রামপর্যায়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সহজেই এই যন্ত্র ব্যবহার করে শিশুর জীবন রক্ষা করা সম্ভব। যদিও যন্ত্রটি বাংলাদেশি কোনো বিজ্ঞানীর উদ্ভাবিত প্রযুক্তি নয়। কিন্তু আমাদের চিকিৎসকদের কৃতিত্ব হলো, এ রকম যন্ত্র যে আমাদের দেশে সহজে ব্যবহার করে নিউমোনিয়ায় শিশুমৃত্যুর হার কমানো যায়, সেটা বুঝে এর প্রচলন করা। ইউনিসেফ এই যন্ত্র প্রত্যন্ত অঞ্চলের কয়েকটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সরবরাহ করছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবজাতক বিভাগের অধ্যাপক আবদুল মান্নান জানালেন, তাঁদের ইউনিটেও অক্সিজেন সরবরাহের এই ছোট মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে। 

নিউমোনিয়ায় ফুসফুস আক্রান্ত হয়। এর কোষগুলো প্রায় বন্ধ হয়ে শরীরে অক্সিজেন সরবরাহে সংকট সৃষ্টি করে। তখন তার জীবন রক্ষার প্রধান একটি উপায় হলো শিশুকে খুব উচ্চ চাপে পর্যাপ্ত অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এ ক্ষেত্রে আমাদের চিকিৎসকদের উদ্ভাবনী উদ্যোগ সত্যিই উৎসাহজনক। আইসিডিডিআরবি এখন পালস-অক্সিমেট্রি নিয়ে গবেষণা করছে। এর মাধ্যমে জানা যাবে কখন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর উচ্চ চাপে অক্সিজেন দরকার। 

একটি প্রশ্ন ওঠে, আমরা শুধু শিশুদের নিউমোনিয়া নিয়ে ভাবছি কেন? এর কারণ শিশুদেরই এই রোগ বেশি হয় ও দ্রুত সংকটাপন্ন অবস্থায় চলে যায়। মূলত কানের মধ্যভাগে একধরনের সংক্রমণ থেকে শিশুরা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। শিশুদের কানের ভেতর থেকে গলা পর্যন্ত বিস্তৃত ইউস্টেশ্যন টিউব একধরনের জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে সহজেই শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়। কারণ, শিশুদের ইউস্টেশ্যন টিউব সমান্তরাল অবস্থানে থাকে। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউস্টেশ্যন টিউব একটু বাঁকানো অবস্থান নেয়। তখন মধ্য কানের সংক্রমণ থেকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। কিন্তু নিয়ান ডার্থাল প্রজাতির মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউস্টেশ্যন টিউবের কৌণিক পরিবর্তন হতো না। ফলে ওরা প্রায় সারা জীবনই নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন অসুখ-বিসুখে ভুগত। ফলে খাদ্য সংগ্রহ করা কঠিন হতো। এসব কারণে শেষ পর্যন্ত নিয়ান ডার্থাল প্রজাতির মানুষ বিলুপ্ত হয়ে যায়। 

একদল বিজ্ঞানীর সাম্প্রতিক গবেষণায় এসব তথ্য জানা গেছে। অনলাইন জার্নাল দ্য অ্যানাটমিক্যাল রেকর্ড-এ তাঁদের গবেষণার বিস্তৃত ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। 

নিউমোনিয়া একটি কঠিন অসুখ, কিন্তু নিরাময়যোগ্য। টেকসই লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি হাজার জীবিত জন্মের মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যু ২৫-এর মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। ২০১৮ সালের এক জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে এই হার ৩০। সুতরাং এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন খুব কঠিন কিছু না। শিশু জন্মের পরপর কয়েক ঘণ্টা মায়ের ত্বকের সংস্পর্শে রাখতে হবে। প্রথম ছয় মাস পর্যন্ত শিশু শুধু মায়ের বুকের দুধ খাবে। এ জন্য অপারেশনের মাধ্যমে শিশু জন্মের হার ১০ থেকে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা দরকার। স্বাভাবিক জন্মের শিশু অনেক বেশি রোগপ্রতিরোধ শক্তির অধিকারী। অন্তত পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পুষ্টি চাই। এসব ব্যবস্থা শিশুদের নিউমোনিয়া রোধে খুব দরকার। 

আব্দুল কাইয়ুম প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক