বলিভিয়ায় অস্থিরতা দূর হবে কি

এএফপি ফাইল ছবি।
এএফপি ফাইল ছবি।

যখন কোনো দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হন, কারণ সেনাপ্রধান তাঁকে পদ ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, তখন এ ঘটনাকে অভ্যুত্থান না বলাটা অন্যায্য হবে। কয়েক সপ্তাহের সহিংস বিক্ষোভের পর গত রোববার নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিষয়ে রাজি হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই মোরালেস পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। 

২০ অক্টোবর বলিভিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরপরই দেশটিতে বিক্ষোভ শুরু হয়। প্রথম দফার ভোটে বিজয়ী হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ভোটের চেয়ে ১০ শতাংশ কম ভোট পেয়েছিলেন মোরালেস। তারপর ভোট গণনা হঠাৎ স্থগিত করা হয় এবং যখন পুনরায় গণনা শুরু হয়, তখন দেখা যায় মোরালেস বেশি ভোট পেয়ে এগিয়ে রয়েছেন। এটি অবশ্যই সন্দেহজনক ছিল, যদিও এর বিকল্প ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে যেমন শেষের গণনা করা ভোটগুলো ছিল গ্রামাঞ্চলের, যেখানে মোরালেসের জনপ্রিয়তা শহুরে অঞ্চলের চেয়ে বেশি।

যাহোক, অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটস (ওএএস) একটি নিরীক্ষায় সুস্পষ্ট জালিয়াতির কথা প্রকাশ করে এবং ভোট বাতিল করার আহ্বান জানায়। মোরালেসও এ ব্যাপারে একমত হয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি পদত্যাগ করেন।

চতুর্থ মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হয়ে মোরালেস জনগণের ক্ষোভ কুড়িয়েছেন। দেশটির সংবিধান অনুযায়ী তিনবারের বেশি রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার বিধান না থাকায় ২০১৬ সালে গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেন মোরালেস। কিন্তু সেই গণভোটে তিনি সামান্য ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। তখন তিনি বলেছিলেন যে তিনি রায় মেনে নিয়েছেন। কিন্তু পরে তিনি একটি সাংবিধানিক আদালতকে প্রভাবিত করে ক্ষমতায় থাকার এই মেয়াদসীমাকে খারিজ করিয়ে নেন। এর ফলে মোরালেসের পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ ঘটে। এতে করে তাঁর জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছিল, তবে এখনো তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয়। 

২০০৬ সালে মোরালেস বলিভিয়ার ক্ষমতায় আসেন। তাঁর নিন্দুকেরাও স্বীকার করেছেন যে মোরালেস বৈষম্য এবং চরম দারিদ্র্য হ্রাসে অসামান্যভাবে সফল হয়েছেন। অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রেও তিনি দারুণ সফল। ২০০৬ সালের পর দেশটিতে গড় প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ৫ শতাংশে। সেখানে দৃশ্যমান বিকাশ হয়েছে, নিরক্ষরতার হার হ্রাস পেয়েছে এবং স্বাস্থ্যসেবার যথেষ্ট উন্নতি করেছে। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে তিনি কোকোচাষিদের একটি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ২০০৬ সালে তিনি নির্বাচিত হওয়ার আগে দেশটির দুই–তৃতীয়াংশ আদিবাসী নাগরিক ক্ষমতার কাঠামোর বাইরে ছিল। 

এটি স্বীকার করতেই হবে যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মোরালেসের প্রশাসন সম্পর্কে কিছু অভিযোগ বামদের কাছ থেকেও এসেছে।
যেমন কিছু কৃষি ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্বার্থে মোরালেস গ্রামীণ জনগণ ও পরিবেশের ক্ষতিসাধন করেছেন। কয়েক মাস আগে যখন বলিভিয়ার গ্রামাঞ্চলে
আগুন লেগেছিল, তখন এ জন্য সরকারকে দায়ী করা হয়েছিল। 

তাঁর কাজগুলো অসমাপ্ত রয়ে গেছে—এমন উদ্বেগ থেকে আরও বেশি দিন ধরে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার জন্য মোরালেস তাঁর ক্ষমতার মেয়াদ বাড়াতে চেয়েছিলেন কি না, এটা এখনো পরিষ্কার নয়। এই কলাম যখন লিখছিলাম, তখন এটা আমার কাছে অস্পষ্ট ছিল যে বলিভিয়ার ক্ষমতায় যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তা কীভাবে পূরণ হবে। সেনাবাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণের কোনো ইচ্ছা প্রদর্শন করেনি, যারা কিনা চে গুয়েভারা হত্যাকাণ্ডের পর থেকে এ ধরনের সুযোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়নি। দুই বছর আগে মোরালেস সরকার চের ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী বড় করে উদ্‌যাপনের সিদ্ধান্ত নিলে সেনাবাহিনী যে বাজেভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল, তা–ও খুব একটা অপ্রত্যাশিত ছিল না।

মোরালেসের পাশাপাশি ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং সিনেটের প্রধান পদত্যাগ করায় সিনেটের উপনেতা, বিরোধী রাজনীতিবিদ জিনাইন আনেজ অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন। এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হচ্ছে ভবিষ্যতে কী ঘটবে। শিগগিরই কি আরও একটি নির্বাচন হবে? মোরালেসকে কি ফের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়ানোর অনুমতি দেওয়া হবে? উল্লেখ্য, পার্লামেন্টের উভয় কক্ষেই মোরালেসের দল মুভমেন্ট ফর সোশ্যালিজমের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। 

লা পাজে গত কয়েক সপ্তাহে যা ঘটে গেল, সেই একই রকম ঘটনা ঘটেছিল পাকিস্তানের ইসলামাবাদে ৪২ বছর আগে। সাধারণ নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির ঘটনা ব্যাপক উত্তেজনা তৈরি করেছিল এবং সারা দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। এরপর সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছানোর ব্যাপারে সেনাবাহিনী মধ্যস্থতা করেছিল। কিন্তু এরপর শুরু হয় দুঃস্বপ্নের যুগ, জারি হয় সামরিক শাসন; যার পরিণতি পাকিস্তান এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে। আমি আশা করছি, বলিভিয়ায় এ রকম কিছু ঘটবে না। 

ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত


মাহির আলী ডন পত্রিকার সাংবাদিক ও কলাম লেখক