সুন্দরবন, বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু

সুন্দরবন। প্রথম আলো ফাইল ছবি
সুন্দরবন। প্রথম আলো ফাইল ছবি

এবারও নিজের বুক পেতে সব আঘাতকে ধারণ করে, সাইক্লোনের তীব্রতাকে মন্থর করে দিয়ে সুন্দরবন বাঁচাল বাংলাদেশকে। ২০১৯ সালের ৯ ও ১০ নভেম্বর ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেখানো হয়েছিল বাংলাদেশের উপকূলে, শঙ্কা করা হয়েছিল প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ধেয়ে আসছে। তবে আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সুন্দরবনই এবারও রক্ষা করেছে বাংলাদেশকে। সুন্দরবনের গাছের বাধায় কমে এসেছে বাতাসের বেগ।

এর আগে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা একইভাবে সুন্দরবনে বাধা পেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিল।

২০০৭ সালের সিডরে সুন্দরবনের প্রায় ২৫ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন প্রথম আলোয় সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ইফতেখার মাহমুদের লেখা সিরিজের একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল: বিরক্ত না করলেই বাঁচবে সুন্দরবন। সুন্দরবনে গাছ না কাটার সিদ্ধান্ত নেয় বন বিভাগ। এক বছরের মধ্যেই আবার মাথা তুলে দাঁড়ায় সুন্দরবন।


অনেক দিন আগে একটা কবিতা লিখেছিলাম, নাম ছিল ‘সুন্দরবন।’ প্রথম আলোয় সেটা প্রকাশিত হলে একটা ই-মেইল পেয়েছিলাম। লিখেছিলেন জিয়া জিয়াবুল করিম। তিনি তখন ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্র।

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল দিন। এক দিন আগেও জিয়ারা ছিলেন বাঁশখালীতে, তাঁর নানাবাড়িতে। মৃত্যু যেন তাঁদের টেনে আনল নিজেদের বাড়িতে, কুতুবদিয়ায়।

সকাল থেকেই আকাশ ছিল মেঘলা, আবহাওয়া ছিল গুমোট আর বৃষ্টি হচ্ছিল গুঁড়ি গুঁড়ি। সন্ধ্যার পর বাতাসের বেগ গেল বেড়ে। ভয়ংকর হয়ে উঠল প্রকৃতি। যেন ইস্রাফিলের শিঙা বাজছে। ভয়ে জড়সড় সাড়ে চার বছরের জিয়া আর তাঁর আরও দুই ভাই দুই বোন আশ্রয় নেন মায়ের আঁচলের তলায়। হঠাৎ বক্ষবিদারী আওয়াজ, পানি আসছে, পানি। বাবা তাঁদের সবাইকে ঘরের চালের ওপরে তুলে দেন। নিজেও আশ্রয় নেন অ্যাসবাস্টাসের চালে। জিয়া আমাকে ই-মেইলে লিখেছিলেন, ‘মায়ের কোলে তখন আমি আর আমার দেড় বছরের ভাই রবিউল আর তিন বছরের বোন রহিমা। আমার আর দুই ভাই বাবার সঙ্গে আমাদের পাশে।’ ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে, সুচের মতো বৃষ্টি এসে লাগছে গায়ে, পানি ধেয়ে আসছে, বাঁকা জল, ক্রূর জল। ভয়ানক আওয়াজ হচ্ছে। বজ্রবৃষ্টি হচ্ছে ভীষণ! সাগর থেকে ধেয়ে আসছে পাহাড়ের সমান ঢেউ। পানি বাড়ছে। চালে-জলে একাকার। অনেকেই চালের পাশের গাছে উঠে যেতে সক্ষম হলো। জিয়া লিখেছেন, ‘আমরা গাছে উঠতে পারিনি। আমাদের অ্যাসবাস্টাসের চাল ভেঙে যায় সহজেই। কিন্তু কাঠের তৈরি খিলানি ধরে আমরা টিকে থাকার চেষ্টা করছি। জলে ডুবছি আর ভাসছি। একটা ভাসমান ট্রাংকের মধ্যে বাবা আমার ছোট ভাইবোন দুটোকে রেখে সেটা আঁকড়ে ধরে আছেন। আমি চালের খিলানি ধরে আছি ভেসে। আমার একটা জ্যাঠাতো বোন মাকে ধরে আছে বাঁচার শেষ চেষ্টায়। একটা প্রচণ্ড ঢেউ এল। আমার বড় ভাই দুটোকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল। দূরে কয়েকটা গাছ দেখা যাচ্ছে। ভাবছি সেটায় উঠে পড়া যায় কি না। কিন্তু কোত্থেকে একটা বাঁশের বেড়া এসে পড়ল আমাদের ওপর। সবকিছু ভেঙে পড়ল হুড়মুড়িয়ে। মনে হলো, সব শেষ। মিনিট কুড়ি পরে বাবা আবিষ্কার করলেন, আমি তাঁর গলা ধরে আছি। তিনি তখন একটা গাছে উঠে পড়লেন আমাকে নিয়ে। ভীষণ শীতে আমার সমস্ত শরীর অবশ। বাবার পরনে ছিল একটা সোয়েটার। বাবা সেই সোয়েটারের ভেতরে আমাকে ঢুকিয়ে দিলেন। তিনি গাছ ধরে প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন। আর আমি তাঁর পেটের সঙ্গে সোয়েটারঘেরা হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালবেলা ঘুম ভাঙল।

‘পরে আমার বড় দুই ভাইকে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু ছোট ভাই, বোন আর মাকে আর কোনো দিনও খুঁজে পাওয়া গেল না। বড় হয়ে শুনেছি, তিনি প্রেগন্যান্ট ছিলেন তখন। মাকে আমার মনে পড়ে, আবার মনে পড়েও না। মনে না পড়ার সুবিধা হলো, আমার মনে হয়, আমার মা ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে মমতাময়ী মুখের অধিকারিণী।

‘মায়ের কোনো ছবি নেই আমার, মায়ের কোনো উল্লেখযোগ্য স্মৃতি নেই। আমি জানি না, মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে কেমন লাগে, কেমন লাগে মা মা বলে ডেকে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে। ২৯ এপ্রিল এলেই এই সব কথা বড় বেশি মনে বাজে, আর সারাটি ক্ষণই যে মায়ের মুখ আমি মনেও করতে পারি না, তাঁকে খুব মনে পড়ে।’

জিয়ার এই চিঠিটা আমি তুলে ধরেছিলাম প্রথম আলোয় ১৯ ডিসেম্বর ২০১৪।

সুন্দরবন কিন্তু আমাদের মায়ের মতোই। নিজে আঘাত সয়ে আমাদের বাঁচায়।


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুন্দরবনের এই অসাধারণ ভূমিকার কথা জানতেন, উপলব্ধি করতেন, আমাদেরও এ ব্যাপারে সচেতন করে গেছেন।

১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই তিনি বৃক্ষরোপণ সপ্তাহের উদ্বোধন করেন রেসকোর্স ময়দানে। সেখানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন:
‘আমার মনে আছে, একবার ১৯৬৭-৬৮ সালে তদানীন্তন সরকার যাঁরা ছিলেন, আমি বলেছিলাম, আলাপ হয়েছিল চিঠির মাধ্যমে, আলাপ হয়েছিল যে সুন্দরবনকে রক্ষা করেন। না হলে বাংলাদেশ থাকবে না। তাঁরা বললেন, আমাদের রেভিনিউ নষ্ট হয়ে যায়, প্রায় দেড় কোটি টাকার মতো, কী করে গাছ কাটা বন্ধ করে দিই? তাহলে চলবে কী করে? আমি তখন বললাম, আমরা গাছ লাগাইয়া সুন্দরবন পয়দা করি নাই। স্বাভাবিক অবস্থায় প্রকৃতি এটাকে করে দিয়েছে বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য। বঙ্গোপসাগরের পাশ দিয়ে যে সুন্দরবনটা রয়েছে, এইটা হলো বেরিয়ার। এটা যদি রক্ষা করা না হয় তাহলে একদিন খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, কুমিল্লার কিছু অংশ, ঢাকার কিছু অংশ এ পর্যন্ত সমস্ত এরিয়া সমুদ্রের মধ্যে চলে যাবে এবং এগুলো হাতিয়া, সন্দ্বীপের মতো আইল্যান্ড হয়ে যাবে। একবার যদি সুন্দরবন শেষ হয়ে যায়—তো সমুদ্র যে ভাঙন সৃষ্টি করবে, সেই ভাঙন থেকে রক্ষা করার কোনো উপায় আর নাই। মেহেরবানি করে দেড় কোটি টাকার জন্য আমার এই বাংলার সর্বনাশ আপনারা করবেন না। কিন্তু কানে দেয় নাই এ কথা। কারণ তারা দরদ নিয়া আসে নাই। কারণ তাদের প্রয়োজন ছিল বাংলার গাছ, বাংলার সম্পদ, বাংলার র ম্যাটেরিয়াল। লুট করে নিয়া যাওয়াই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল।’

বঙ্গবন্ধু সেই ভাষণে সাত কোটি মানুষের অর্ধেক মানুষ, যারা সাবালক, সাড়ে তিন কোটি—তাদের প্রত্যেককে একটা করে গাছ লাগাতে আহ্বান জানান। তিনি ফলের গাছ লাগাতে বলেন। গাছের যত্ন নিতে বলেন। এবং তিনি তাঁর পর্যবেক্ষণের কথাও জানান। তিনি বলেন, ছোটরা তাঁর কথা বেশি শোনে, বড়রা তেমন শুনতে চায় না।

বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ভাষণটা অনলাইনে শুনতে পাওয়া যায়। শুনলে কেমন মায়া লাগে। মায়া বোধ হয় সুন্দরবনের জন্য, বঙ্গবন্ধুর জন্য, দেশের জন্য। এ কথাটাও মনে দাগ কাটে, ছোটরা কথা শোনে, বড়রা তেমন শুনতে চায় না।

বেঁচে থাকুক সুন্দরবন, আর বাঁচিয়ে রাখুক বাংলাদেশকে। খুব ঘন ঘন সাইক্লোন হচ্ছে, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের অবস্থা বিপন্ন, এটা আর বৈজ্ঞানিক পূর্বাভাস নয়, এটা এখন দৈনন্দিন বাস্তবতা। জলবায়ুর পরিবর্তনে বাংলাদেশের দায় সবচেয়ে কম, কিন্তু এর ফলে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে কিংবা ঘন ঘন ঝড়-বৃষ্টি, সাইক্লোন, অনাবৃষ্টি হলে তার সবচেয়ে বড় শিকারে পরিণত হবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ অবশ্য জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে নানা রকমের প্রস্তুতিও নিচ্ছে। যেমন সুন্দরবন, তেমনি বাংলাদেশের মানুষের টিকে থাকার ক্ষমতা, ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা অসাধারণ। প্রকৃতি, নদ-নদী, পরিবেশ, বন, পাহাড়, কৃষিজমি সবকিছু রক্ষা করেই উন্নয়নের পথে এগোতে হবে, যেমনটা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু, ‘সুন্দরবনকে রক্ষা করেন। না হলে বাংলাদেশ থাকবে না।’

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক