পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য যান, উপাচার্য আসেন

বাংলাদেশে এখন স্বায়ত্তশাসিত ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪৯ টি। বর্তমানে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন চলছে। তার মধ্যে এগিয়ে আছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। তিন মাস ধরে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চলতে থাকা আন্দোলন শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণায় এসে ঠেকেছে। আরও যে কয়টা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন চলছে, তার মধ্যে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং প্রশাসনিক ভবনের কর্মকর্তাদের পদত্যাগ দাবি করে আন্দোলন। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন দফা দাবিতে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ চলছে। দুই হলের শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার কারণে বন্ধ হয়েছে কুয়েট। এর আগে গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। অন্যদিকে বুয়েটে আবরার হত্যার এক মাস পরেও এখনো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। শিক্ষার্থীরা এখনো ক্লাসে ফেরেননি।

কেন এমনটা হচ্ছে? কী সমস্যা আসলে উপাচার্যদের? উপাচার্যরা যেখানে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অভিভাবক, সেখানে শিক্ষার্থী আন্দোলন শেষতক উপাচার্য অপসারণ কিংবা পদত্যাগের দাবিতে ঠেকছে কেন? এই ৪৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য আছেন। এর মধ্যে মাত্র চারটি বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত বা ৭৩-এর অধ্যাদেশে পরিচালিত হয়। এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ হওয়ার বিধান। কিন্তু সবগুলোতে এই চর্চা এখন আর নেই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যদের নিয়োগ দেয় সরকার। সরকার সরাসরি দলীয়ভাবে যাচাই-বাছাই করে নিয়োগ দেয়। এ কারণে এই নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যদের কাজই হয়ে পড়ে সরকারের সব অবস্থানের সঙ্গে একমত পোষণ করা। যার ফলে সরকারের কথামতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চালাতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উপাচার্যদের মতপার্থক্য তৈরি হচ্ছে। এগুলো প্রভাব ফেলছে শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্কের ওপর। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সঙ্গে তাঁদের এই আস্থার সম্পর্কটির ওপর আর নির্ভর করতে পারছেন না। এই অস্বস্তি, বনিবনা না হওয়া একটা পর্যায়ে এসে আন্দোলনে রূপ নেয়।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকার সরাসরি উপাচার্য নিয়োগ দেয়। ছয় মাস শূন্য থাকার পর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে চার মাস শূন্য থাকার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি উপাচার্য নিয়োগ দিয়েছে সরকার। এর সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও পেল অস্থায়ী থেকে চার বছর মেয়াদি স্থায়ী উপাচার্য। বর্তমানে গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ শূন্য রয়েছে এক মাস ধরে। এ ছাড়া সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ২৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহ-উপাচার্য পদ এবং ১৮ টিতে ট্রেজারার পদ শূন্য আছে। পদ শূন্য থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজে যে বিঘ্ন ঘটছে, তা সহজেই অনুমেয়।

এটা খুব বেশি বাড়িয়ে বলা হবে না যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্যরা প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কার্যত একক ক্ষমতার অধিকারী। তাঁদের কেউ কেউ কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেন না এবং তাঁদের একক সিদ্ধান্তেই বিশ্ববিদ্যালয় চলছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ হলো যে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন উপাচার্য আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেছেন, কয়েকজনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তাঁদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার, নিয়মবহির্ভূতভাবে নিয়োগসহ নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। কথা হলো, এই উপাচার্যরা কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। শিক্ষক হিসেবে অনেকেরই হয়তো ব্যক্তিগত সুনাম আছে। কিন্তু যখনই উপাচার্য হচ্ছেন, তখনই একে একে বিকিয়ে দিচ্ছেন দীর্ঘদিনের অর্জিত সুনাম-মানসম্মান।

এখন কথা হলো, কেন এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় দরকার? আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক কাঠামোতেই যেখানে এতটা দুর্বলতা রয়েছে কিংবা দাঁড়িয়ে আছে এক ব্যক্তির শাসনের ওপর, তখন সেগুলোকে কি আসলে বিশ্ববিদ্যালয় বলা যাবে? এখন যদি আমরা হিসাব করি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদ উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, ট্রেজারার, সেভাবে ৫৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪৭টি পদ। অনেকেই তো উপাচার্য হতে চান। আবার উপাচার্যের পদ ছেড়ে যুবলীগের দায়িত্ব নিতে চাওয়া উপাচার্যও আছেন। এই ১৪৭টি পদে যেতে বিভিন্নভাবে তদবির করেন হাজারখানেক শিক্ষক। উপাচার্য পদের আশায় তাঁরা তদবিরে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কাছে যান, সচিবদের কাছে যান, আবার কখনো কখনো তাঁরা ছাত্রনেতাদের মুখাপেক্ষীও হন। এই পদগুলো কার্যত রাজনৈতিক বিবেচনায় নিলামে তোলা হয়। যদি তা করা না হতো, তাহলে হয়তো এই চিত্র মিলত না।

আর কী কী করেন এই সরকারি উপাচার্যরা? বিভিন্ন অনিয়মের কারণে যখন তাঁকে ঘিরে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়, তখনো তিনি নির্ভয়ে থাকেন। বারবার বলতে থাকনে, সরকার না বললে তিনি কিছুই করবেন না, এমনকি আবরার মারা যাওয়ার পরও বুয়েটের উপাচার্য তাঁকে দেখতে আসতে দেরি করেন, কারণ, অভিযোগ আছে তিনি নাকি তখন ওপরের মহলের সঙ্গে যোগাযোগে ব্যস্ত ছিলেন। ক্ষমতা এমন এক বিষয় যে সেটি ধরে রাখতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করাতে কিংবা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দিতে উপাচার্যরা যথেষ্ট মুনশিয়ানার পরিচয় দেন। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক ও কার্যকর আন্দোলনের সামনে কোনো উপাচার্যের টিকে থাকার ইতিহাস নেই। কিন্তু তারপরও উপাচার্যরা শেষ দিন পর্যন্ত বিভিন্নভাবে চেয়ারের পায়ায় ক্ষমতার নানামুখী পেরেক ঠুকে ক্ষমতাকে ধরে রাখতে চান। কারণ, তাঁরা মনে করেন তাঁদের ক্ষমতার ভিত্তি দল ও সরকার, শিক্ষার্থী নয়। সরকারের ইচ্ছায় উপাচার্যদের এই আসা-যাওয়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কার্যক্রমের বড় সর্বনাশ করে চলেছে।

জোবাইদা নাসরীন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
ZOBAIDANASREEN@GMAIL. COM