ঘূর্ণিঝড় বুলবুল: বিপন্ন মানুষের প্রতি সহায়তার হাত বাড়ান

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে বসতঘর পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে বসতঘর পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে

থেমে গেছে বুলবুল। ফের শান্ত ও স্নিগ্ধ হতে শুরু করেছে উপকূলীয় অঞ্চল। কিছুদিন পর হয়তো আবারও স্বাভাবিক হতে শুরু করবে এসব অঞ্চলে মানুষের জীবনধারা। তারা হয়তো আবারও সোজা হয়ে দাঁড়াবে। ভেঙে পড়া, হেলে পড়া কুঁড়েঘরগুলো নতুন করে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবেন তাঁরা। আবারও ছন্দময়, গতিশীল ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে এখানকার জনজীবন।

বুলবুলের তাণ্ডব চলে যেতেই ঘরে ফিরেছে সর্বস্ব হারানো মানুষজন। তাই ভরা পূর্ণিমায়ও তাদের চোখে অমাবস্যার অন্ধকার। এবার বুলবুলের আঘাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাতক্ষীরা। জেলার শ্যামনগর উপজেলায় ক্ষতির পরিমাণটা সবচেয়ে বেশি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

আলাপ প্রসঙ্গে বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ভবতোষ মণ্ডল বললেন, তাঁর ইউনিয়নে মাটির একটি ঘরবাড়িও আর অবশিষ্ট নেই। ঝড়ে সব লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। মাছের ঘের ভেসে গেছে। পুরো ইউনিয়ন এখন ধ্বংসস্তূপের রাজ্য। জেলার শ্যামনগর, কালীগঞ্জ, আশাশুনি উপজেলার অসংখ্য ঘের অতিবৃষ্টিতে একাকার অবস্থা। জীবিকার শেষ সম্বল ঘের ডুবে যাওয়ায় হাজার হাজার মানুষ এখন দিশেহারা। কী করবেন, কিছুই বুঝতে পারছেন না তাঁরা।

ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে সাতক্ষীরার মানুষের জীবন যেন একই সুতোয় গাঁথা। সিডর ধ্বংসের ছাপ না মুছতেই এল আইলা। আইলার ক্ষত না শুকাতেই ফণী। তারপর ফণীর শোক কাটিয়ে না উঠতেই এল বুলবুল। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে এখানকার জনজীবন বারবার বিপন্ন হচ্ছে। কিন্তু দুর্যোগ মোকাবিলায় টেকসই কোনো পদক্ষেপ নেই। এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান জীবিকা চিংড়ি চাষ। কেউ চিংড়ি চাষ করেন, আবার কেউ পোনা বিক্রি করেন। চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহনসহ নানা কাজেও অনেকে নিয়োজিত। তাঁরা জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করলেও ২৪ ঘণ্টায় ১৪৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে সাতক্ষীরা জেলার প্রায় ৬ হাজার ঘের তলিয়ে গেছে। আয়তনে প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর জমি।

ভয়াবহ বুলবুল দক্ষিণাঞ্চলের অন্তত ১০টি জেলায় তাণ্ডব চালিয়েছে। সাতক্ষীরা জেলায় রেখে গেছে গভীর ক্ষত। প্রাথমিক হিসাবে গাবুরা, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী ও মুন্সিগঞ্জের বেশ
কয়েকটি ইউনিয়নে ৫০-৬০ শতাংশ কাঁচাঘর ধসে পড়েছে। পুরো জেলায় প্রায় ৪৫ হাজার ঘর সম্পূর্ণÿ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও প্রায় ২০ হাজার ঘরবাড়ি। অন্যদিকে প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমির উঠতি আমন ফসল সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় ২১ জেলায় ৯৫ হাজার কিলোমিটার বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাতক্ষীরা জেলার অনেক এলাকা টানা কয়েক দিন ছিল বিদ্যুৎহীন। কোনো কোনো এলাকার বিদ্যুৎব্যবস্থা স্বাভাবিক হতে আরও কয়েক দিন সময় লাগবে। বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যমতে, জেলায় ১২১টি বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে গেছে, ২০০টি হেলে গেছে এবং ৫৫৬টি কেন্দ্রে বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। জেলায় বিদ্যুৎ লাইনের ক্ষতির পরিমাণ কয়েক কোটি টাকা। বিদ্যুৎব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ায় বিপাকে পড়েছে চিংড়ি খাত। বরফ উৎপাদন বন্ধ থাকায় চিংড়ি সংরক্ষণ ব্যাহত হচ্ছে, ফলে ক্ষতির মুখে পড়েছেন মৎস্যচাষিরা।

অন্যদিকে, বেশ কিছু এলাকায় যোগাযোগব্যবস্থাও নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। ফসলের খেতে আধা পাকা ধান বিনষ্ট হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে এলাকার বেড়িবাঁধ। অন্যদিকে, শ্যামনগর উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে কয়েক শ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এই এলাকার ১৭ হাজার ৫০০ হেক্টর ঘেরের মধ্যে ৫ হাজার হেক্টর ঘেরের প্রায় ৫০০ মেট্রিক টন মাছ ভেসে গেছে। একই সঙ্গে পুরো জেলায় পশুসম্পদেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

বুলবুল ঝড়কে মোকাবিলা করতে সরকার প্রায় ২১ লাখ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়েছিল। প্রস্তুত ছিল ১০টি যুদ্ধজাহাজ। প্রস্তুত ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও। অনেক এলাকায় জোর করেও মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। এটি সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু এত সব প্রস্তুতি সত্ত্বেও কিছু প্রাণহানি ঘটেছে।

ঝড়-পরবর্তী সময়ে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য চাল, শুকনা খাবার, কাপড়, টিন ও স্বল্প পরিমাণ নগদ অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে। প্রশাসনের উচিত হবে দ্রুত বুলবুলের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া। এই মুহূর্তে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি মেরামত করা জরুরি। যাঁদের ঘরের খাবার নষ্ট হয়েছে, তাঁদের কাছে খাবার পৌঁছাতে হবে। সুপেয় পানি সরবরাহ করতে হবে। এসব অসহায় মানুষের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। তাই পুনর্বাসন কার্যক্রম হতে হবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি। ঘূর্ণিদুর্গত এলাকায় যাঁরা ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতা, তাঁদের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে সমস্যা হবে। অতএব, ঋণের কিস্তি গ্রহণ আপাতত বন্ধ রাখতে হবে।

ঘূর্ণিঝড়ে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, দ্রুত সেগুলো অবিলম্বে মেরামত করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতি না হয়। এই অঞ্চলের মানুষের জীবন–জীবিকা যেহেতু বেড়িবাঁধের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল, সেহেতু বেড়িবাঁধ টেকসই হওয়া আবশ্যক।

প্রতিবারের মতো এবারও সুন্দরবন মায়ের মতো আমাদের আগলে রেখেছে। সুন্দরবন না থাকলে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হতো। এই সবুজ বেষ্টনী রক্ষায় আমাদের আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। উন্নয়নের নামে সুন্দরবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না।

শুধু সাতক্ষীরা নয়, বুলবুলের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও কয়েকটি জেলার মানুষ। তাদের সবার জন্য সহায়তার হাত বাড়াতে হবে।

উমর ফারুক: রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষক
[email protected]