'সুন্দরবনের গুরুত্ব আবারও বুঝতে পেরেছি'

প্রধান বন সংরক্ষক সফিউল আলম চৌধুরী।
প্রধান বন সংরক্ষক সফিউল আলম চৌধুরী।
>

সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় বুলবুল বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হেনেছিল। যে তীব্রতায় তা আঘাত হেনেছে, সুন্দরবন না থাকলে জানমালের আরও ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। বিশেষজ্ঞদের তরফে বলা হচ্ছে যে সুন্দরবনের কারণে বাংলাদেশ ঝড়ের এই বিপদ থেকে অনেকটাই বেঁচে গেছে। সুন্দরবনের গুরুত্ব ও একে রক্ষার বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন দেশের বর্তমান প্রধান বন সংরক্ষক সফিউল আলম চৌধুরীর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইফতেখার মাহমুদ

প্রথম আলো: ঘূর্ণিঝড় বুলবুল তো প্রথমে সুন্দরবনে আঘাত করেছে, সেখানে কেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে?

সফিউল আলম চৌধুরী: ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের আঘাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষায় সুন্দরবন সব সময় মায়ের ভূমিকা পালন করে। ঘূর্ণিঝড় বুলবুল প্রথমে সুন্দরবনে আঘাত করার পর বাতাসের গতি ও জলোচ্ছ্বাসের ঢেউয়ের উচ্চতা কমে গেছে। ফলে মানুষের বসতি এলাকায় ক্ষতি বেশ কম হয়েছে। সুন্দরবনের এই গুরুত্ব এই ঝড়ের মাধ্যমে আবারও বোঝা গেল। কিন্তু এ রকম ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবনের নিজের বেশ ক্ষতি হয়। এবারও চাঁদপাই, শরণখোলা ও সাতক্ষীরা বন ফাঁড়ি এলাকায় বেশ ক্ষতি হয়েছে। অনেক গাছ পড়ে গেছে, ডালপালা ভেঙেছে। ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক হিসাব আমরা করেছি। তবে এ ব্যাপারে বিস্তারিত সমীক্ষা চলছে। আশা করি, আমরা সপ্তাহখানেকের মধ্যে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করতে পারব। ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা পাওয়ার পর তা কাটিয়ে ওঠার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

প্রথম আলো: এখন ভাঙা গাছপালাগুলো নিয়ে কী করা হবে? ঝড়ের ধাক্কা সামলানোর জন্য সুন্দরবনের ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্ত কী?

সফিউল আলম চৌধুরী: ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবনের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়, তা মোকাবিলা করার সামর্থ্য সুন্দরবনের নিজেরই রয়েছে। সিডরের পরে অনেকে সুন্দরবনের ভাঙা গাছপালা কেটে বাইরে নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা তা করিনি। কারণ, তা করা হলে সুন্দরবনের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হয়ে যেত। আমরা সুন্দরবনকে বিরক্ত না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তার ফলে সুন্দরবন নিজেই এক বছরের মাথায় ক্ষতি কাটিয়ে আবারও জেগে উঠেছে। এবারও অনেকে সুন্দরবনের ভাঙা গাছপালা কেটে বাইরে এনে বিক্রি করার পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু আমরা তাতে কান দিচ্ছি না, সুন্দরবনে যেসব গাছ ভেঙে গেছে, সেগুলো যেভাবে পড়ে আছে সেভাবেই থাকবে। গাছগুলো সুন্দরবনের পরিবেশের সঙ্গে মিশে গিয়ে অন্য প্রাণী ও বৃক্ষের খাদ্য জোগাবে।

প্রথম আলো: সুন্দরবনের ওপরে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ আছে। সেখানকার জীববৈচিত্র্য এখন কী অবস্থায় আছে?

সফিউল আলম চৌধুরী: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুন্দরবনে আগের চেয়ে বিপদ বেড়েছে। তবে সুন্দরবন সুরক্ষায় সরকার আগের চেয়ে অনেক বেশি তৎপর। যেমন সুন্দরবনের বন্য প্রাণী রক্ষায় আমরা স্থানীয় জনগোষ্ঠী, বন বিভাগের কর্মী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মিলে স্মার্ট প্যাট্রলিং শুরু করেছি। এর সফলতা পাওয়া গেছে। আগে বাঘ সুন্দরবনের পাশের গ্রামগুলোতে চলে আসত। মানুষ বাঘ পিটিয়ে মেরে ফেলত। কয়েক বছর ধরে তা আর ঘটছে না। বাঘের প্রধান খাবার হরিণের সংখ্যাও বেড়ে ১০ লাখ হয়েছে। এর ফলে গত তিন বছরে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। গাছের ঘনত্ব ও জীববৈচিত্র্য আগের চেয়ে বেড়েছে। সুন্দরবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জলজ প্রাণী ডলফিনের সংখ্যাও বেড়েছে। আমরা সুন্দরবনের ডাংমারি, দুধমুখী ও চাঁদপাই এলাকার জলাশয়গুলোকে ডলফিনের অভয়াশ্রম ঘোষণা করেছিলাম। পানখালি, শিবসা ও ভদ্রা এলাকাকে অভয়াশ্রম ঘোষণার জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছি। সুপতি, পুটনি, শিবসা, পশুর ও বলেশ্বর নদকে ডলফিনের হটস্পট বা গুরুত্বপূর্ণ বসতি এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছি। সেখানে ডলফিন রক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছি। ডলফিন রক্ষায় সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছর ঢাকা ও সুন্দরবন এলাকায় ডলফিন মেলা করছি। এসব কর্মকাণ্ডের ফলে সুন্দরবনে ডলফিনের সংখ্যাও বাড়ছে।

প্রথম আলো: সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এত উদ্যোগের সফলতার কথা বলছেন। কিন্তু এর মধ্যেও আমরা শুনি, বনে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করা হচ্ছে।

সফিউল আলম চৌধুরী: হ্যাঁ, বিষ দিয়ে মাছ শিকার করার কথা আমাদের কানেও এসেছে। সুন্দরবন অনেক বড় এলাকা। অনেক স্থানে এ ধরনের অপরাধ হচ্ছে। যারা বিষ দিয়ে মাছ শিকার করছে, আমরা তাদের তালিকা তৈরি করছি। কিছুদিন আগে আমরা বাগেরহাটের মোংলা এলাকা থেকে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের অভিযোগে ১৬ জন জেলেকে আটক করেছি। এ ধরনের অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থাও করতে হবে।

প্রথম আলো: সুন্দরবনের চারপাশে নানা ধরনের শিল্পকারখানা গড়ে তোলা হচ্ছে। এসবের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সুন্দরবনকে রক্ষার জন্য সরকার কী করছে?

সফিউল আলম চৌধুরী: সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে সরকার প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করেছে। সুন্দরবনসহ সবগুলো ইসিএর তদারকির দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। তারা পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমরা বন বিভাগ থেকে সুন্দরবনের সীমানার সুরক্ষা দেখার দায়িত্বপ্রাপ্ত।

প্রথম আলো: ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর সুন্দরবনে এক বছর পর্যটকসহ সব ধরনের মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এবার মাত্র কয়েক দিনের জন্য নিষিদ্ধ হলো...

সফিউল আলম চৌধুরী: সিডরে বাতাসের গতিবেগ বুলবুলের প্রায় দ্বিগুণ ছিল। ফলে সিডরে সুন্দরবনের ক্ষতি বেশি হয়েছিল। তাই আমাদের অনেক বেশি সাবধান হতে হয়েছিল। বুলবুলের আঘাতে আমাদের অংশের সুন্দরবনের ক্ষতি খুব বেশি হয়নি। তবু আমরা পর্যটক ও জেলেদের পাস দেওয়া কমিয়ে দিয়েছি। নিয়ন্ত্রিত পর্যটনের ব্যবস্থা করছি।

প্রথম আলো: সুন্দরবনে বছরে কত পর্যটক যাওয়া উচিত, তার কোনো হিসাব আপনাদের কাছে আছে? বনের মধ্যে পর্যটকেরা জোরে মাইক বাজায়, পলিথিন-প্লাস্টিক ফেলে বনের ক্ষতি করে।

সফিউল আলম চৌধুরী: আমরা সুন্দরবনের পর্যটনব্যবস্থা নিয়ে ৩০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছি। চারপাশের অধিবাসীদের সুন্দরবনের সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে তাদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সরকারি অর্থায়নে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এই উদ্যোগগুলো সুন্দরবনের দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষায় ভূমিকা রাখবে। আর সুন্দরবন শুধু জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলা করে এটি আমাদের জনপদকে রক্ষা করছে, এখান থেকে আমরা বিপুল পরিমাণ মাছ ও পোনা আহরণ করছি। এখান থেকে আহরণ করা গোলপাতা ওই অঞ্চলের মানুষের জ্বালানি ও ঘরবাড়ি নির্মাণের প্রধান উপকরণ। এটি বিপুল পরিমাণ কার্বন ধরে রেখে বিশ্বের অন্যতম ফুসফুসের ভূমিকা পালন করছে। এই বনটির সামগ্রিক অবদানের একটি অর্থনৈতিক হিসাব আমরা করছি; সেটা প্রকাশ করে আমরা এই বনটি রক্ষার গুরুত্বকে আরও সামনে নিয়ে আসতে চাই।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

সফিউল আলম চৌধুরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।