ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের পর

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে প্রকৃতি ও মানুষের যে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হয়েছিল, বাস্তবে ততটা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে কত ক্ষতি হয়েছে, তা নিরূপণের উদ্যোগের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে সুন্দরবনের দিকে। যেহেতু সুন্দরবনের বাধার কারণেই বুলবুল প্রলয়ংকরী রূপ ধারণ করতে পারেনি, সেহেতু ওই বনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করাই সমীচীন। কারণ, সুন্দরবন মানুষের ক্ষয়ক্ষতি লাঘব করেছে বটে, কিন্তু নিজে তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রচুর গাছপালা ভেঙেছে, জীবকুলের স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়েছে; বনের ভেতরের মিঠাপানির উৎসগুলোতে লোনাপানি মিশেছে। এসব ক্ষয়ক্ষতির সামগ্রিক চিত্র পাওয়ার লক্ষ্যে সমীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সুন্দরবনের যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ করার সামর্থ্য মানুষের নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবন নিজেই তার সব ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার সামর্থ্য রাখে। আমাদের যা করণীয়, তা হলো বনটিকে বিরক্ত না করা, সেখানে মানুষের আনাগোনা কিছু সময় বন্ধ রাখা। পর্যটকসহ অন্যদের এক সপ্তাহ সুন্দরবনে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল; সেই পর্ব শেষ হয়েছে। তবু আমরা বলব, বনটিতে মানুষের আনাগোনা সব সময়ই সীমার মধ্যে রাখা উচিত। এখন ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত সুন্দরবন দেখতে যেন কৌতূহলী জনতার ভিড় লেগে না যায়।

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের পর সুন্দরবন যতটা মনোযোগ কেড়েছে, মানুষ ততটা পায়নি বলে আমাদের মনে হয়। এর একটা কারণ হলো, বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেনি। এ দেশে অনেক মানুষ একসঙ্গে মারা না গেলে খুব একটা শোরগোল ওঠে না। উপরন্তু ঘূর্ণিঝড় বুলবুল মানুষের বেশি ক্ষতি করতে পারেনি—এ রকম খবর প্রচারিত হওয়ার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের দুরবস্থা যতটা গুরুত্ব পাওয়া উচিত, ততটা পায়নি। তা ছাড়া ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতি যতটা দৃশ্যমান হয়, তার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ততটা দৃশ্যমান হয় না। বিপুলসংখ্যক ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জীবন-জীবিকার সংগ্রাম ও দুঃখকষ্ট চোখে দেখা যায় না।

অবশ্য ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের দৃশ্যমান ক্ষয়ক্ষতি এখনো মিলিয়ে যায়নি। বিপুলসংখ্যক মানুষের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে বা আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নতুন করে ঘরবাড়ি বানানো কিংবা মেরামত করার সংগ্রাম প্রাণান্তকর; কারণ, অধিকাংশ মানুষের হাতে নগদ টাকা নেই। যাদের ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে, তারা এখনো খোলা আকাশের নিচে কোনোমতে ছাউনি তুলে দিনাতিপাত করছে। সাতক্ষীরা জেলায় এ সংখ্যা অনেক।

বুলবুলের আঘাতে আমন ফসল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে চিংড়িঘেরগুলো। দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান হয় এই দুটি খাতে। বুলবুলের আঘাতে তারা বেকার হয়ে পড়েছে। যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতে কোনো জমানো অর্থ থাকে না, যারা দিন আনে দিন খায় এবং যাদের পরিবারগুলোর বেশির ভাগ সদস্যের অন্নের সংস্থান করতে হয় একজন বা দুজন উপার্জনক্ষম সদস্যকে, তাদের জীবনে প্রায় অনাহারী দশা ডেকে এনেছে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। এসব পরিবারের নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যহানির বিরাট ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। স্বাভাবিক সময়েই যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নারী-শিশুদের মধ্যে পুষ্টির ঘাটতি প্রকট, এ রকম দুর্যোগের পর তাদের পুষ্টি পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা সৃষ্টি হয়।

সুতরাং ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য সরকারের অনেক কর্তব্য আছে। প্রথমত, সম্পূর্ণভাবে ভেঙে যাওয়া ঘরবাড়ির মালিকদের নতুন ঘরবাড়ি তৈরির জন্য আর্থিক সহযোগিতার ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয়ত, যাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ নষ্ট হয়েছে, তাদের জন্য অন্তত আগামী দু-তিন মাস বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করা। তৃতীয়ত, শিশু, নারী, বিশেষত গর্ভবতী নারী ও প্রসূতিদের স্বাস্থ্যঝুঁকি লাঘবের জন্য প্রয়োজন পদক্ষেপ নেওয়া।