দুশ্চিন্তাহীন মন্ত্রী ও 'রেমিট্যান্স মেশিন'

আমাদের অজানা ছিল না কেন ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা ও নেপাল মধ্যপ্রাচ্যে তাদের নারী শ্রমিকদের পাঠাতে রাজি হচ্ছে না। জানা ছিল, সেসব দেশে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাওয়া নারীরা কী ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কথা উঠেছিল, নির্যাতনের কারণে যখন ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা তাদের নারীদের সৌদি আরবে পাঠানো বন্ধ করে দিচ্ছে, তখন কেন আমরা ঝুঁকি নেব? মনে রাখা দরকার, তখনকার বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, ‘নারীদের নিরাপত্তা বিধান করেই সৌদি আরবে গৃহকর্মী পাঠানো হবে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।’ টাকাটাই যখন মূল বিষয়, তখন নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি আর মুখ্য থাকে না। এ ক্ষেত্রেও থাকেনি; নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পরিণত হয়েছে কথার কথায়।

টগবগে তেজি বিদেশি মুদ্রা বাংলাদেশের জন্য খুব জরুরি। টরন্টো, নিউইয়র্কের বেগমপাড়ায় বাড়ি করতে, একশ্রেণির ব্যবসায়ীদের ওভার ইনভয়েসের পাওনা চুকাতে, এমনকি অসময়ে উড়োজাহাজে পেঁয়াজকে উড়িয়ে আনতে বিদেশি মুদ্রা লাগে। লাগে বড়লোকদের চিকিৎসায়, তাঁদের ছেলেমেয়ের লেখাপড়ায়, ভ্রমণে আর তীর্থদর্শনে। বিদেশি মুদ্রার কোনো ঘাটতি নেই আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। লুটপাট হওয়ার পরও রেমিট্যান্স মেশিন গরিব প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণে বিদেশি টাকায় ভরপুর কোষাগার। রেমিট্যান্স মেশিনে পরিণত হয়েছেন প্রবাসী নারীরাও।

সৌদি আরবের নারী গৃহকর্মীদের বাজার নিয়ন্ত্রণ করত ফিলিপাইন আর ইন্দোনেশিয়া। প্রবাসী নারী শ্রমিকদের ওপর অত্যাচার, হত্যা, শিরশ্ছেদের কথা প্রচারে এলে দেশ দুটিতে প্রবাসী গৃহকর্মীদের অধিকার আর নির্যাতন বন্ধের পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠে। দুই দেশ আলাদা আলাদাভাবে দর-কষাকষি করে সৌদি কর্তৃপক্ষকে কোনো কিছুই কবুল করাতে পারে না। এরপর দেশ দুটি এককাট্টা হলে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় শ্রীলঙ্কা আর নেপাল। বাংলাদেশকেও তারা আহ্বান জানিয়েছিল বলে জানা যায়। এই পরিস্থিতিতে সৌদিরা বাংলাদেশকে কাছে টানার চেষ্টা করে। সৌদি আরব আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১১ সালে বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে, তখনো পুরুষ কর্মীর ওপর সৌদিদের নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল। পাঠানো যাচ্ছিল না আমিরাতেও। ইরাক-লিবিয়ার ভিসাও বন্ধ।

বাংলাদেশ তখন মধ্যপ্রাচ্যের বন্ধ শ্রমবাজারের চাবির সন্ধানে বেচাইন। তখন বারবার চাপ আসে নারী গৃহকর্মী পাঠানোর। পুরুষ শ্রমিকের বাজার খুলে দেওয়ার মুলাও ঝোলানো হয়। বাংলাদেশকে নারী শ্রমিক দিতে হবে, নয়তো সে বাজার খুলবে না। সেই সঙ্গে সরকারঘনিষ্ঠ আদম ব্যবসায়ীদের চাপের পারদও বাড়তে থাকে। ব্যবসায়ীরা উঠেপড়ে লাগেন। একজন নারীকে কোনোমতে উড়োজাহাজে ওঠাতে পারলেই দুই হাজার ডলার মিলবে, দুজন পুরুষ পাঠানোর অনুমতি মিলবে—এসব ভাবনায় তাঁরা তখন বেহুঁশ। স্রেফ ব্যবসায়িক স্বার্থে, অন্য কথায় কেবল টাকার জন্যই সব জেনেবুঝে আমরা আমাদের নারীদের বিপদের মুখে কোরবানি দিলাম।

সৌদি আরবের শ্রম মন্ত্রণালয়ে উপমন্ত্রী আহমেদ আল ফাহাইদ ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় আসেন। একটা এসপার-ওসপার করেই তবে তিনি ফিরবেন। বাংলাদেশের আদম ব্যবসায়ী আর যেসব জানপহেচানদের ক্ষমতার অলিন্দে ঘোরাফেরার ইজাজত আছে, তাঁদের পাকড়াও করতে পারেন এমন ১৯ জন সৌদির এক মারকাটারি দল ছিল তাঁর সঙ্গে। এবার তাঁরা নারীদের নেবেনই। শ্রমবাজার চালুর জন্য ১২০০ থেকে ১৫০০ রিয়াল বেতনের কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত মাত্র ৮০০ রিয়ালেই (১৬ হাজার ৮০০ টাকা) রফা হয়ে যায়। বলে রাখা ভালো, নেপাল ১ হাজার ৬০০ রিয়াল আর ফিলিপাইন ১ হাজার ৮০০ বা ২ হাজার রিয়াল বেতনের নিচে কোনো নারী কর্মী পাঠায় না। তাতে কিনা সারা দেশে হারিকেন নিয়ে নেমে যান দালালেরা।

চুক্তির পর ২০১৫ সালে শ্রমিক হিসেবে গেলেন ২১ হাজার নারী। এরপর ২০১৬ সালে গেলেন ৬৮ হাজার; ২০১৭ ৮৩ হাজার আর ২০১৮ সালে ৭৩ হাজার। সরকারি হিসাব বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২ লাখ ৯৩ হাজার ৫৮৮ জন নারী সৌদি আরবে গেছেন। তারপর? সৌদিতে গিয়ে এই নারীরা কেমন থাকলেন? কে তার খবর রাখে?

যাওয়ার পর থেকেই প্রথমে একে একে তারপর দলে দলে নারী কর্মী ফিরে আসতে শুরু করেন। ফিরে আসার সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছেই। ফিরছেন খালি হাতে। ঘরে ফেরার রাহা খরচও থাকে না তাদের। চপ্পল আর পলিথিন ব্যাগ হাতে তাঁদের পথের ভিক্ষুকের থেকেও কাহিল দেখায়। বেসরকারি সংস্থার বদান্যতায় কেউ একটা জুস-পাউরুটি চিবুতে চিবুতে বাড়ি ফেরেন, কেউ ফেরেন আশ্রয়কেন্দ্রে মনোচিকিৎসার জন্য। এই চরম অসহায় মুহূর্তে যখন তাঁদের পাশে দরদি মন আর সহযোগিতার হাত নিয়ে দাঁড়ানোর কথা প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের, তখন সেই মন্ত্রণালয়ের সচিব বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দিলেন, ‘যারা ফিরছে তাদের পক্ষ থেকে করা শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ সত্য নয়; আমি নিজে সেটি জানি। অনেক সময় নারীরা বিদেশে যাওয়ার তিন মাস না পেরোতেই ফিরে আসার জন্যও এমন অভিযোগ করে থাকেন বলে জেরায় বেরিয়ে এসেছে।’ জানিয়েছিলেন, আমাদের মেয়েরা সৌদি খানায় অভ্যস্ত নয়, তাই ফিরে আসতে চান।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত কর্মরত অবস্থায় নিহত হয়েছেন ১৫২ জন। তবে সরকারি হিসাব অনুযায়ী নিহত হয়েছেন ১৩১ নারী। তাঁদের মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন ৯৮ জন, খুন হয়েছেন ৫ জন।

যথাসময়ে ব্যবস্থা নিলে এঁদের অনেককেই বাঁচানো যেত। সে চেষ্টা দূরে থাক, ২০১৮ সালের ৯ জুলাই সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি জানিয়েছিলেন, ‘সৌদি আরবে বাংলাদেশি নারী কর্মীরা ভালো আছেন। দেশটিতে গৃহকর্মী নির্যাতন বন্ধে সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সেসব পদক্ষেপের ফলে অনেক অত্যাচার-নির্যাতন কমেছে। নারী কর্মীরা অনেক ভালো আছেন। যাঁরা ফেরত এসেছেন, তাঁরা আবারও যেতে চান।’ সেদিন সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি প্রবাসী নারী কর্মীদের প্রকারান্তরে দোষারোপ করেছিলেন। বলেছিলেন, সৌদি আরবে নিগৃহীত নারী কর্মীদের মূল সমস্যা আরবি ভাষা বোঝা ও বলার অক্ষমতা। নারী কর্মীদের কেউ কেউ সৌদি আরবের পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে পালিয়ে সেফ হোমে আশ্রয় নেন। এ ছাড়া রমজান মাসে অত্যধিক চাপে পালিয়ে আসেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সৌদি সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে, ইত্যাদি।

এসব মনগড়া কথার কোনো প্রতিবাদ হয়নি। প্রতিবাদ না করা মানে যে মেনে নেওয়া নয়, সেটা বুঝতে পারছেন না মন্ত্রীরা। তাই হত্যার শিকার নারীদের লাশ তাঁদের কাছে সংখ্যা মাত্র। অনুপাতের পাটিগণিতে তাঁদের কাছে এটা নস্যি মাত্র। দেশে ফেরা নারীরা বলছেন, এখনো শত শত নারী দেশে ফেরার পথ খুঁজছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, ২ লাখ ৭০ হাজার শ্রমিকের মধ্যে ৫৩ জনের মৃত্যু শতকরা হিসাবে খুবই কম। তিনি বলেন, ৯৯ শতাংশ নারী মেনে নিয়ে কাজও করছেন, দেশে টাকাও পাঠাচ্ছেন। টাকাটাই তাঁর কাছে মুখ্য! বৈষয়িক অর্জনের বাইরে ন্যায্য কিছু ভাবার সময় কি তাঁদের হবে? হলে ভালো, না হলে কিন্তু অসহায় মানুষের দীর্ঘশ্বাস ঝড় তোলার শক্তি রাখে।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
[email protected]