লোকাল ট্রেনের কী খবর বাহে

কৃষক যদি এক বস্তা মরিচসহ ট্রেনে চড়ে বিনা ভাড়ায়ও দিল্লিতে ঢোকেন, তবে একজন কৃষকের সঙ্গে এক বস্তা মরিচও দিল্লিতে ঢোকে, যা ট্রাকে আনতে গেলে রেল ভাড়ার চেয়ে অনেক বেশি পড়ে। ট্রাকের টায়ার বাঁচে, রাস্তা বাঁচে, ডিজেলের ভর্তুকিও বাঁচে। একজন চাকরিজীবী যদি ৫০ কিলোমিটার দূর থেকে ট্রেনে দিল্লিতে তাঁর অফিসে ঢোকেন, তবে তাঁর এনার্জি, বসবাসের খরচ দিল্লিতে থাকার চেয়ে অনেক বেশি বাঁচে, যা একদিক থেকে দেশের লাভ। একজন চাকরিপ্রার্থী যদি রেলে আসেন, তবে বাসে এসে ইন্টারভিউ দেওয়া ব্যক্তিদের চেয়ে অনেক বেশি ফ্রেশ মুডে ইন্টারভিউ দিতে পারেন। একজন ছাত্র যদি ট্রেনে কলেজ ধরতে পারেন, তবে তিনি অনেক বেশি মনোযোগী হতে পারেন—এমনটাই বলেছিলেন ভারতের সাবেক রেলমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদব। 

কিন্তু বিশাল বাঁধ, বিরাট সেতু আর সর্বোচ্চ ভবন শব্দগুলো আমাদের জাতীয় গর্ব। এই গর্বিত মনে তাই ছোট—লোকাল কিছু ঠাঁই নেয় না। 

সান্তাহার-বগুড়া-বোনারপাড়া রুটে চলত যে লোকাল ট্রেনটি, তার স্থানীয় নাম ছিল ‘ভিক্ষুক স্পেশাল’। প্রতি বৃহস্পতিবার ভোরে ছাদ ভর্তি হয়ে অসংখ্য ভিক্ষুক বগুড়ায় নামত। দুধ, দই, জ্বালানি কাঠ, শাকসবজি, বাঁশের ঝুড়ি, মাটির হাঁড়ি-পাতিল, সামান্য ধান-চাল বহন হতো এটিতে। পার্বতীপুর-সৈয়দপুর-চিলাহাটি সীমান্ত পর্যন্ত চলত যে লোকালটি, তার নাম কেউ বলত ‘চিনি ট্রেন’ কেউ ‘খড়ি ট্রেন’। এই ট্রেনে সীমান্তবর্তী গ্রাম থেকে শহরে আসত বিপুল পরিমাণ জ্বালানি কাঠ। নারীরা এই খড়ি বহন করতেন—কেউ ছাগলের জন্য কাঁঠাল পাতা, কেউ ভারতীয় ছাপা শাড়ি। 

‘হাটুয়া বেচায় জিনিস হাটোতে বসিয়া/ খদ্দের ঘুরেফিরে কিনিতে আসিয়া।/ এ হাট ঘুরিয়া ফেরে খদ্দেরের তরে,/ খদ্দের বসিয়া ঘরে জিনিস ক্রয় করে।’ ট্রেন নিয়ে এটি একটি বিখ্যাত ধাঁধা। ট্রেনের নামের এই হাটে হেন জিনিস নেই, যা বেচাকেনা হয় না। মৌসুমি ফল, মুখরোচক খাবার, গাছনা ওষুধ থেকে শুরু করে কাঁকই, পায়ের আলতা পর্যন্ত। দাঁতব্যথা থেকে ক্যানসারের ওষুধ পর্যন্ত যেখানে পাওয়া যায়, তার নাম লোকাল ট্রেন। এর যাত্রীরা প্রায় পরস্পরের চেনা। 

ট্রেন ঘোরে দু-তিনটি জেলার মধ্যে। মূলত অফিসের কর্মচারী, কারখানার শ্রমিক, মামলাক্রান্ত লোকজন, সবজিবিক্রেতা, ব্যাপারী, ঝি, হকার, ক্যানভাসারসহ সব ধরনের ডেইলি প্যাসেঞ্জার লোকাল ট্রেনের যাত্রী। শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, মূর্খ, বিদ্বান, ডাক্তার, চোর, পকেটমার, মাতাল, উকিল, শিল্পী, প্রেমিক, উদাস, ভণ্ড, বাউল ও ন্যাকা সবাই মিলে এক ইউনিট। রুমাল, ছাতা, ব্যাগ, খবরের কাগজ, দেশলাই—সবকিছুই জায়গা দখলের উপকরণ। দার্শনিক আলাপ থেকে ভাত সেদ্ধ হওয়া না–হওয়া পর্যন্ত কথার বিষয়। লোকাল ট্রেনকে দাঁড় করিয়ে রেখে আন্তনগরের চলে যাওয়া নিয়ে হা–হুতাশ, তাস খেলা, বিড়ি ধরানো—এই সবকিছু নিয়ে লোকাল ট্রেন। এমনকি চুলের গিঁট ছাড়াতে গিয়ে একই ছাতার তলে—সাক্ষী লোকাল ট্রেন। 

১৮৬৩ সালে মুনশি আজিমদ্দীন লিখেছিলেন, ‘কী মজার কলের গাড়ি’। সেখানে তিনি তাঁর প্রহসনধর্মী নাটকে রেল যোগাযোগের ফলে চাকরিজীবী মধ্যবিত্তদের পরিবারে জন্মহার বৃদ্ধির ইঙ্গিত করেছেন। 

লোকাল ট্রেনের মধ্যে পথ ও দুই পাশে চারখান করে বেঞ্চের মাঝারি কামরা নিজেই যেন এক সমাজ। ‘আটচল্লিশজন বসিবেক’ লেখা থাকলে ঠেলাঠেলি করে ৬০-৭০ জন নিয়ে জাত-পাতহীন ঐক্যবদ্ধ এক চেহারা। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র সংস্করণ। যদিও ট্রেন থেকে নামার পর চলে যায় নিজ নিজ সংকীর্ণ জগতে।

২.
আগে যেখানে চিলমারী থেকে ভোর ৪টায়, সকাল ১০টায়, বেলা ১টায় ও রাত ১০টায় মোট ৪টি লোকাল ট্রেন চলত, এখন চলে ১টি মাত্র ট্রেন। অথচ ওই ৪টি ট্রেন যে মাল পরিবহন করত, তা দিয়েই সেগুলো লাভজনক ছিল। তবু রাষ্ট্র যখন লোকাল ট্রেন উঠিয়ে দেয়, তখন জনগণের ঐক্যের বাঁধনই যেন ছিঁড়ে দেয়। এক জোড়া লাইনের পাশে আরেক জোড়া লাইন না বসিয়ে লোকাল ট্রেনগুলোকে রাষ্ট্রজুড়ে তুলে দেওয়া হচ্ছে। 

কার্ল মার্ক্স লিখেছিলেন, রেলব্যবস্থা থেকে উদ্ভূত আধুনিক শিল্পের ফলে শ্রমের বংশানুক্রমিক যে ভাগাভাগির ওপর ভারতের জাতিভেদ প্রথার ভিত্তি, ভারতীয় প্রগতি ও ভারতীয় ক্ষমতার সেই চূড়ান্ত প্রতিবন্ধক ভেঙে পড়বে। কিন্তু ভেঙে পড়ল কই? আন্তনগর আর লোকাল ট্রেনের নামে সেই বিভক্তি তো রয়েই গেল। ‘জাত মারল তিন সেনে/ কেশব সেনে, ইস্টিশনে আর উইলসনে’—কই জাত গেল? মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে ধনবৈষম্য তো বাড়ছেই। জনগণের জীবনটাই আজ লোকাল ট্রেন! 

নাহিদ হাসান রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভাপতি
[email protected]