জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন আন্দোলন হয়

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সংক্রান্ত ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ আমাদের স্বাধীনতার ফসল। এর লক্ষ্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারগুলো সেই চেতনাকে ঊর্ধ্বে রাখেনি, বরং নিজেদের দলীয় স্বার্থে শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের অনুগত বাহিনী তৈরিতে সচেষ্ট থেকেছে। ফলে আমরা প্রকৃত স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় পাইনি। স্বায়ত্তশাসনের মূলনীতি বিভিন্ন পর্ষদের মধ্যে দায়িত্বের বিন্যাস; সেটাকে পাশ কাটানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী উপাচার্য সিনেট দ্বারা নির্বাচিত হন সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্তির মাধ্যমে নয়, বরং নির্বাচিত তিনজনের প্যানেল থেকে রাষ্ট্রপতি একজনকে নিয়োগ দেন। সেই একজন সাধারণত সরকার ও সরকারি দলের অনুগত হয়ে থাকেন। তাঁর জ্ঞান, মেধা, যোগ্যতা গুরুত্ব পায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন চালাতে উপাচার্যদের সরকারের লেজুড় বাহিনীর প্রয়োজন হয়, এই বাহিনী বড় করা হয় শিক্ষক হিসেবে অনুগত লোকদের নিয়োগ দিয়ে। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের প্রধান নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্ব হয়েছে সামন্ত প্রভুর মতো; বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ হয়েছে জ্ঞানচর্চাহীন, যুক্তিতর্কবিহীন। বিভিন্ন পর্ষদের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে, তাদের সভাগুলো নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্যকে ২০১৮ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে সিনেট নির্বাচনকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। 

’৭৩–এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী সিনেট, সিন্ডিকেট, বোর্ড অব অ্যাডভান্স স্টাডিজ, একাডেমিক কাউন্সিল ইত্যাদি পর্ষদ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কর্তৃপক্ষ’। কোনো ব্যক্তির হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাগ্য ছেড়ে দেওয়া হয়নি। উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ সবাই ‘অফিসার’। তাঁরা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কাজ করবেন। অধ্যাদেশের ১২–এর ক ধারায় বলা আছে, ‘এমন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব যদি হয়, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাদেশের পরিধির মধ্যে নাই, সে ক্ষেত্রে উপাচার্য নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন কিন্তু তাঁকে সাত দিনের মধ্যে সিন্ডিকেটের অনুমতি নিতে হবে।’ সিন্ডিকেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত পরিচালনার সিদ্ধান্তগুলো নেয়, এর সদস্যদের প্রজ্ঞা–মেধা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নির্ধারণে বিশেষ ভূমিকা রাখার কথা। কিন্তু দলীয়করণের জন্য সরকারের মনোনীত সদস্যরাই সেখানে খুঁটি গেড়ে বসেছেন। কয়েক বছর ধরে এই পর্ষদের অন্য শিক্ষকদের প্রতিনিধি, প্রভোস্ট প্রতিনিধি ইত্যাদির কোনো নির্বাচন হচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত সিন্ডিকেট সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। জরুরি ও বিশেষ সিন্ডিকেট সভা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চলছে। অন্য অফিসগুলোও, এমনকি পরীক্ষা অফিসও আইনকানুন মেনে কাজকর্ম করছে না। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হলেন শিক্ষার্থীরা। পাকিস্তান আমলের আইয়ুব সরকারের লেজুড় ছাত্রসংগঠনের মতো এখানেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাতীয় রাজনৈতিক দলের লেজুড় বাহিনী তৈরি করা হয়েছে। তারা উপাচার্যের সহযোগী হিসেবে অন্য শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণের কাজ করে। অতীতে সরকার বদল হলে রাতারাতি আমরা সেই সব শিক্ষার্থীকেও দলবদল করতে দেখেছি। আবাসিক এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। আবাসিক ছাত্র হলগুলো সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সরকারের অনুগত ছাত্রসংগঠনের, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োজিত প্রভোস্ট ও হাউস টিউটররা সেখানে নামমাত্র দায়িত্ব পালন করেন। প্রাক্তন ছাত্ররা হল, দল উভয়ই নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁরাই হলগুলোর সিট দখলে রাখেন। নবীন শিক্ষার্থীদের হলের গণরুমে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। তাঁদের ওপর চলে ‘র‍্যাগিং’ নামের নিপীড়ন। বুয়েটে আবরার হত্যাকাণ্ডের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সরকারি ছাত্রসংগঠনের নিপীড়নমূলক ভূমিকা নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে, যা জাহাঙ্গীরনগরের জন্যও একইভাবে প্রযোজ্য। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা এই সব আধিপত্য ও অন্যায়কে বিনা প্রতিরোধে মানেননি, সম্মিলিত প্রতিবাদ করেছেন। তাঁরা ১৯৮৯, ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে ছাত্রশিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় দখল রুখে দিয়েছিলেন। ১৯৯৩–এ ছাত্রী নিপীড়নবিরোধী ও ছাত্রী হলগুলোতে সূর্যাস্ত আইনবিরোধী আন্দোলন করেছেন, ১৯৯৫–এ আবার ছাত্রী নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন, ১৯৯৮–এ ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, ২০০০–এ ধর্ষক প্রতিরোধ আন্দোলন করেছিলেন। আরও অনেক ছাত্রী আন্দোলন ও নারী শিক্ষক নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন হয়েছে এখানে। সেগুলোর কোনোটাই সরাসরি উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন ছিল না, কিন্তু সেগুলো উপাচার্যদের স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতাকে অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। 

কিছু আন্দোলনে দাবি আদায় হয়েছে, কিছু আন্দোলনে তা হয়নি। ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জোবায়ের সরকারি ছাত্রসংগঠনের সদস্যদের হাতে খুন হওয়ার পর তত্কালীন উপাচার্যের বিরুদ্ধে হত্যাকারীদের প্রশ্রয়দানের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে ২০১২ সালে। আরও একটি উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন হয়েছে ২০১৩-১৪ সালে। সেটি দেখিয়ে বলা হয় যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন হয়। অথচ বর্তমান উপাচার্য ২০১৪ সালে সিনেট কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১৫ সালে ছাত্রী নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন হয়েছে এবং ২০১৭
সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়–সংলগ্ন সড়কে দুর্ঘটনায় মারা গেলে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন হয়েছে। সেগুলো তখন উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়নি। উপরন্তু উপাচার্য তাঁর বাসভবন আক্রমণের অভিযোগে ৫৬ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করেন এবং রাতের অন্ধকারে ১৩ জন নারী শিক্ষার্থীকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরিকল্পিত ও ‘অস্বচ্ছ’ উন্নয়ন কার্যক্রমের বিরুদ্ধে তিন মাস ধরে শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ জারি রেখেছেন। একপর্যায়ে উপাচার্য ও সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠনের মধ্যে অর্থনৈতিক লেনদেনের অভিযোগ উঠলে এ বিষয়ে তদন্তের দাবি আন্দোলনে যুক্ত হয়। নানা টালবাহানা ও দমন–পীড়নের কারণে শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। সরকার যথাযথ পদক্ষেপ না নিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের ঢালাওভাবে ‘উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনকারী’ হিসেবে অভিহিত করেছে, এর মধ্যে উপাচার্যের মদদে সরকার–সমর্থিত ছাত্রসংগঠনের নেতা–কর্মীরা ৫ নভেম্বর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেন। শিক্ষকদের ওপর এমন সরাসরি হামলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এই প্রথম। উপাচার্য আক্রমণকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু মনে রাখা উচিত, নিপীড়ন চূড়ান্ত হলে, ন্যায্যতা হুমকির মুখে পড়লে শিক্ষক–শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়তে ও আন্দোলন করতে বাধ্য হন। কর্তৃপক্ষ হুমকি–ধমকি না দিয়ে যত দ্রুত তা বুঝবে ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বশাসন প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হবে, তত দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতির মঙ্গল হবে। 

মির্জা তাসলিমা সুলতানা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক