গুজব, পেঁয়াজ, লবণ ও সিন্ডিকেট

মঙ্গলবার বিকেলে অফিসে বসে কাজ করছি, এমন সময় টেলিফোন এল। একের পর এক টেলিফোন। সবার উদ্বিগ্ন কণ্ঠ। বাজারে নাকি লবণ পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষ লবণের জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে।

শুধু ঢাকা নয়, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে স্বজন-পরিচিত সবাই উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে জানতে চাইছেন, বাজারে নাকি লবণ পাওয়া যাচ্ছে না। কেউ কেউ দোকানে লবণ কেনার জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন, এমন ছবিও পাঠিয়েছেন। আমাদের এক সহকর্মী সাততলা থেকে নেমে কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখেন, একটি দোকানের সামনে বেশ ভিড়। সবাই লবণ কেনার জন্য দাঁড়িয়েছেন। এর মধ্যে টেলিভিশনের ক্যামেরাও চলে এসেছে। দোকানদার ক্যামেরার সামনে বললেন, লবণের কোনো সমস্যা নেই। নির্ধারিত দামেই সবাই লবণ পেয়ে যাবেন। দোকানে যথেষ্ট লবণ আছে।

কিন্তু ক্যামেরা চলে যেতেই দোকানদারের গলার স্বর বদলে গেল। বললেন, মোটা লবণ শেষ। এসিআইয়ের এক বস্তা লবণ আছে। ক্রেতারা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। কিছুক্ষণ আগে দোকানদার কী বললেন। এখন কী বলছেন। এঁরা ক্যামেরার সামনে এক কথা বলেন, ক্যামেরা চলে গেলে আরেক কথা।

গুজবের কারণে শুধু রাজধানী নয়, দেশের বিভিন্ন জেলায় লবণ কেনার হিড়িক পড়ে যায়। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, লবণের দাম বাড়াতে একশ্রেণির ব্যবসায়ী গুজবের সুযোগ নিচ্ছেন। যাঁকে জেল দেওয়ার দরকার, তাঁকে জেল দিন, যাঁকে জরিমানা করা দরকার, তাঁকে জরিমানা করুন। লবণের দাম যেন ঠিক থাকে।

শিল্প মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশে বর্তমানে সাড়ে ছয় লাখ মেট্রিক টনের বেশি ভোজ্য লবণ মজুত আছে। এর মধ্যে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের লবণচাষিদের কাছে ৪ লাখ ৫ হাজার মেট্রিক টন এবং বিভিন্ন লবণ মিলের গুদামে ২ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন লবণ মজুত রয়েছে। লবণ বিপণনকারী কোম্পানিগুলোও বলেছে, লবণের কোনো ঘাটতি নেই।

তথ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো এক প্রেস নোটে বলা হয়: একটি মহল পরিকল্পিতভাবে দেশে গুজব ছড়াচ্ছে। সম্প্রতি দেশে লবণ নিয়েও গুজব ছড়ানোর অপচেষ্টা চলছে। শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে গণমাধ্যমে জানানো হয়েছে যে দেশে লবণের পর্যাপ্ত মজুত আছে। ডিসেম্বর মাসেই দেশে নতুন লবণ উৎপাদিত হয়ে বাজারে আসবে। বর্তমান মজুতের সঙ্গে যোগ হবে নতুন উৎপাদিত লবণ। ফলে দেশে লবণের কোনো সংকট নেই বা এমন কোনো আশঙ্কাও নেই।

স্বস্তির কথা লবণের গুজব রাতেই স্তিমিত হতে থাকে। গুজব ছড়িয়ে দাম বাড়ানোর জন্য কয়েকজন ক্রেতাকে ভ্রাম্যমাণ আদালত শাস্তিও দিয়েছেন।

কিন্তু কারা গুজব ছড়ালেন, মন্ত্রীরা তা বলতে পারেননি। সরকারি প্রেস নোটেও তার ইঙ্গিত নেই। মন্ত্রীরা সিন্ডিকেট খুঁজছেন। আমলারা সিন্ডিকেট খুঁজছেন। পেঁয়াজের দাম বাড়ছে, মন্ত্রীরা বলছেন, সিন্ডিকেট করছে। লবণের দাম বাড়ছে, আমলারা বলছেন, সিন্ডিকেট করছে। পরিবহনমালিক ও শ্রমিকেরা রাস্তায় নেমেছেন, সরকার বলছে, সিন্ডিকেট করছে।

কিন্তু সেই সিন্ডিকেটের চেহারা কেমন, চরিত্র কী, তা কেউ বলছেন না। যে দেশে সরকারের অনুমতি ছাড়া প্রধান বিরোধী দল রাস্তায় নামতে পারে না, সে দেশে সিন্ডিকেট এত সাহস কোথায় পেল? এই সিন্ডিকেট কি অন্য গ্রহ থেকে আসা কোনো প্রাণী? যদি তা না হয়, তাহলে তারা ধরা পড়ছে না কেন?

সব সরকারের আমলেই আমরা সিন্ডিকেটের কথা শুনে এসেছি। কিন্তু কেউ তাদের ধরতে পারছে না। সব সরকারই মুখ সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার বুলন্দ আওয়াজ তোলে। কিন্তু বাস্তবে তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারে না। পেঁয়াজের অগ্নিমূল্যের সময় দেখলাম, মন্ত্রীরা সিন্ডিকেট ভাঙার কথা বললেন। কিন্তু সিন্ডিকেট বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ক্রেতা সাধারণের পকেট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তারা এতটাই ক্ষমতাবান যে মন্ত্রীর কথাকে পাত্তা দেয় না। আমলার কথা গ্রাহ্য করে না!

সরকার আসে, সরকার যায়। মন্ত্রী আসেন, মন্ত্রী যান। আমলা আসেন, আমলা যান। কিন্তু সিন্ডিকেট থেকে যায়। তারা অবিনশ্বর। সিন্ডিকেটের কথা উঠলে মিরপুরের প্রয়াত সাংসদ আবদুল খালেকের কথা মনে পড়ে। তিনি ডান-মধ্য সামরিক-গণতান্ত্রিক সব সরকারের সঙ্গেই ছিলেন। এ নিয়ে একজন তাঁকে প্রশ্ন করলে খালেক বলেছিলেন, আমি তো দল বদলাই না। সব সময় সরকারি দলে থাকি। সরকার বদলালে আমার কী করার আছে।

সিন্ডিকেটও হলো এমন এক অদৃশ্য শক্তি, যা সব সরকারের সঙ্গে থাকে। বিএনপি আমলে বিএনপির সিন্ডিকেট। জাতীয় পার্টির আমলে জাতীয় পার্টির সিন্ডিকেট। আওয়ামী লীগ আমলে তারা আওয়ামী সিন্ডিকেট। তবে গত ১১ বছরে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সিন্ডিকেট একাকার হয়ে গেছে।

এই যে গুজব ছড়িয়ে, বাজারে কারসাজি করে একের পর এক পণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছে সিন্ডিকেট, কিন্তু অতি ক্ষমতাধর সরকারও তাদের খুঁজে বের করতে পারে না। আগে কারসাজির বিষয়টি শেয়ারবাজারের মধ্যে সীমিত ছিল। এখন শেয়ারবাজার ছাড়িয়ে সেই কারসাজি কাঁচাবাজার পর্যন্ত এসে ঠেকেছে। শেয়ারবাজারের কারসাজি হলে যাঁরা এর বিনিয়োগকারী শুধু তাঁরাই ক্ষতিগ্রস্ত হন। যাঁরা শেয়ারবাজারের ধারেকাছে যান না, তাঁরা নিরাপদ থাকেন। কিন্তু সিন্ডিকেটের কারসাজি যখন কাঁচাবাজার পর্যন্ত গড়ায়, তখন পথের ভিখারি থেকে ফুটপাতের ক্যানভাসার—সবার গায়ে লাগে। কেউ রেহাই পায় না।

সরকার বিদেশ থেকে বিমানে পেঁয়াজ আনায় দাম কমেছে বলে কৃতিত্ব নিতে পারে। লবণের গুজব বেশি ছড়াতে পারেনি বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে পারে। কিন্তু এরই মধ্যে যে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে সিন্ডিকেট নামের অদৃশ্য শক্তিটি হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে নিল, তার জবাব কী।

বুধবারের পত্রিকায় পূবালী ব্যাংক লিমিটেড ‘ধরিয়ে দিন’ শিরোনামে একটি বিজ্ঞাপন দিয়ে এটিএম কার্ড চোরদের ধরার জন্য সরকার ও জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু যারা গুজব ছড়িয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে লাখ লাখ ক্রেতার পকেট কেটেছে, তাদের ধরার উপায় কী।

সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]