নতুন আইন ও ধর্মঘট

সড়ক পরিবহন আইনের বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার পর তিন সপ্তাহ না পেরোতেই এর বিরুদ্ধে এই খাতের মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর ধর্মঘটের ঘটনায় 

আবারও প্রতীয়মান হচ্ছে, এই মহল আইনকানুনের অধীনে চলতে কতটা অনাগ্রহী। কিন্তু আইন ছাড়া একটি রাষ্ট্রে সড়ক-মহাসড়কে চলাচলের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। বাংলাদেশে এই খাতের বিশৃঙ্খলা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও অপরাধ সংঘটনের পর অপরাধীদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ও কার্যকর আইনি কাঠামোর অভাবে দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি-অঙ্গহানির হার অত্যন্ত বেশি। সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে চলেছে, অথচ একটি মহলের চাপের কারণে আইন প্রণয়নের পরও তা কার্যকর হতে পারছে না—এই বাস্তবতা যারপরনাই দুর্ভাগ্যজনক।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে একটি যুগোপযোগী সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নের চেষ্টা চলেছে। সেই চেষ্টার শুরু থেকেই একটি মহল বাধা সৃষ্টি করে এসেছে। একের পর এক আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে, কিন্তু সড়ক পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিকদের সংগঠনগুলোর অন্যায্য বাধার মুখে সেগুলো চূড়ান্ত করার উদ্যোগ বারবার স্থগিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম মেয়াদে কিছুই করতে পারেনি; ২০১৪ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পরও তিন বছর পেরিয়ে যায় আইনটির একটি খসড়া মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদন পেতে। ২০১৭ সালের মার্চে খসড়াটি মন্ত্রিসভার অনুমোদন পাওয়ার পর আবারও সেই মহল সেটি সংশোধন করার দাবিতে ধর্মঘট-আন্দোলন শুরু করে; তাদের প্রবল বাধার মুখে গ্রহণ ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ আটকে যায়। তারপর বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। কিন্তু পরের বছর, ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই ঢাকায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু ও তার প্রতিক্রিয়ায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রবল বিক্ষোভে সরকারের টনক নড়ে; বিক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য ১৯ সেপ্টেম্বর সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ সংসদে পাস করা হয়।

কিন্তু পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিকদের সংগঠনগুলোর বাধার কারণে সে আইনের বাস্তবায়ন শুরু করতে এক বছরের বেশি সময় লেগে যায়। অবশেষে ১ নভেম্বর আইনের আনুষ্ঠানিক বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার পর তিন সপ্তাহ না পেরোতেই তারা আবার পরিবহন ধর্মঘট ডেকে জনগণের সীমাহীন দুর্ভোগ ডেকে এনেছে। তারা দেশের বিভিন্ন জেলায় ধর্মঘট করছে, কোথাও তাদের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে সড়ক পরিবহন আইন বাতিলের দাবি; কোথাও দাবি করা হচ্ছে আইনটি সংশোধন করতে হবে। ধর্মঘটী শ্রমিকেরা বিআরটিসির বাস চলাচলে বাধা দিচ্ছেন, অটোরিকশা–জাতীয় ছোট যানবাহনের চালকদের ওপর বল প্রয়োগ করার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। বুধবার রাতে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের নেতারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছেন, তাঁদের তোলা দাবিগুলোর মধ্যে যেগুলোকে সরকারের যৌক্তিক মনে হবে, সরকার সেগুলো বিবেচনা করবে—এমন আশ্বাস পাওয়ার পর পণ্য পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিকেরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছেন—এমন খবর বেরিয়েছে। কিন্তু যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে জেলায় জেলায় ধর্মঘট ও কোনো কোনো স্থানে ধর্মঘটীদের জবরদস্তিমূলক আচরণের খবর পাওয়া যাচ্ছে।

পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো দাবি করছে, সড়ক পরিবহন আইনটির বিভিন্ন ধারা সংশোধন করে শাস্তির মাত্রা কমাতে হবে; এ আইনের সব ধারাকে জামিনযোগ্য করতে হবে; সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী শ্রমিকের অর্থদণ্ড ২৫ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে পাঁচ লাখ টাকা করতে হবে; ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি থেকে কমিয়ে পঞ্চম শ্রেণি করতে হবে ইত্যাদি। দাবিগুলোর মধ্যে ন্যায্য কিছু থেকে থাকলে তা বিবেচনায় নেওয়াই সমীচীন। তবে পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতাদেরও বুঝতে হবে, আইনকানুন মেনেই সবাইকে চলতে হবে।