পিএসসির মাধ্যমে সব চাকরি নয়

সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) একটি সাংবিধানিক সংস্থা। প্রজাতন্ত্রের গেজেটেড অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য সুপারিশের এখতিয়ার তাদের। আবার এ-সংক্রান্ত আইনে বিশেষ কোনো পদকে পিএসসির আওতাবহির্ভূত করার ক্ষমতা সরকারের রয়েছে। তা ক্ষেত্রবিশেষে করাও হয়। যেমন পুলিশের সাব–ইন্সপেক্টর পদটি দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড হলেও এদের নিয়োগ পুলিশ সদর দপ্তর থেকেই করা হয়। একাধিক কমিশন করার বিধানও সংবিধানে রয়েছে। স্বাধীনতার পরপর দুটি কর্ম কমিশন ছিল। ১ নম্বর পিএসসি গেজেটেড এবং ২ নম্বর পিএসসি নন-গেজেটেড পদে নিয়োগের সুপারিশ করত। পরে ২ নম্বর পিএসসি বিলুপ্ত হয়। তবে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ কখনো পিএসসির আওতায় ছিল না।

সম্প্রতি গণমাধ্যমে একটি খবর এসেছে এখন থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর ও সংস্থার ১৩ থেকে ২০তম (সাবেক তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি) গ্রেডে নিয়োগে সুপারিশ করবে পিএসসি। এ জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পিএসসিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং অর্থ বিভাগ চিঠি দিয়েছে বলেও খবরে উল্লেখ রয়েছে। পিএসসির চেয়ারম্যানও বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করেছেন বলে সে খবরেই জানা যায়। এমনটা করতে তাঁরা একটি পৃথক অনুবিভাগ করতে চান। তার জন্য জনবল কতটা প্রয়োজন হতে পারে, এর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।

এর আগে অর্থ বিভাগ একটি পরিপত্র জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর ও সংস্থার বেতন গ্রেড ১৩ থেকে ২০ পর্যন্ত পদে কর্মচারী নিয়োগের জন্য সরকারি কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাছাই কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ কার্যক্রমের জন্য রাখা যাবে না কোনো বরাদ্দ। অর্থ বিভাগের এ সিদ্ধান্তটি সংগত। ইদানীং অনেক টাকা ব্যয় করে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কর্মচারী নিয়োগ অনেকটা প্রথায় দাঁড়িয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় বা এ ধরনের সংস্থা কোনো কর্তৃপক্ষের জনবলের নিয়োগের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আর এ ধরনের নিয়োগ কার্যক্রম তাদের সংশ্লিষ্ট কিছু শিক্ষকের অনেকটাই বাণিজ্যিক ধরনের। তবে এর ইতি ঘটাতে গিয়ে পিএসসির ঘাড়ে যে বোঝা চাপানো হচ্ছে তা কতটা সংগত, সেটা দেখা দরকার।

এমনিতেই পিএসসিতে নিয়োগজট লেগেই থাকে। তাদের প্রধান কাজ বিসিএস পরীক্ষা প্রতিবছর নেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করলেও প্রতিটি ব্যাচের জন্য (বিশেষ বিসিএস ব্যতীত) ন্যূনপক্ষে আড়াই থেকে তিন বছর সময় নেয়। এর পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য লাগে আরও বছরখানেক সময়। এভাবে বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ থেকে সফলকামদের নিয়োগপত্র পেতে প্রায় চার বছর সময় লাগে। এটা এ দেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে সংগতিহীন। উপমহাদেশের অপর দুটো দেশেই বছরের পরীক্ষা বছরেই শেষ করে নিয়োগ পান সফলরা। আমরা এমনিতেই পিএসসির কাজ জটিল করে ফেলেছি। সাধারণ ও বিশেষায়িত ক্যাডারের একসঙ্গে পরীক্ষা অনেক বেশি সময় নেয়।

বর্তমান সরকারের ২০০৮-এর নির্বাচনে অঙ্গীকার ছিল একাধিক পিএসসি গঠনের। শিক্ষক নিয়োগের জন্য পৃথক পিএসসি গঠন করা হবে বলে তখনকার শিক্ষামন্ত্রী কয়েকবার বললেও এগোতে পারেননি। পিএসসির কাজের চাপের সঙ্গে সংগতি রাখতে সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই বোর্ড হয় অনেকগুলো। তারা মৌখিক পরীক্ষায় মোটামুটি সমভাবে মূল্যায়ন করতে পারে কি না, এ বিষয়ে সংশয় থাকে। বিশেষায়িত ক্যাডারগুলোর জন্য যদি একটি পৃথক পিএসসি হতো, তাহলে বর্তমান পিএসসিতে এত সদস্য থাকতেন না। কমিশনের সদস্যসংখ্যা যত কম হয়, তত সহজতর হয় মূল্যায়ন-প্রক্রিয়া।

১২০ কোটি লোকের দেশ ভারতে ইউনিয়ন পাবলিক কমিশনের সদস্যসংখ্যা চেয়ারম্যানসহ ৯ থেকে ১১। আমাদের এর থেকে কয়েকজন বেশি। অবশ্য ভারতে রাজ্যগুলোতে পৃথক পিএসসি রয়েছে। এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় আমাদের অঞ্চলভিত্তিক পিএসসি হবে না। তবে চাকরির ধরন হিসেবে একাধিক পিএসসি গঠন করলে অধিকতর সহজ হতো। ন্যূনপক্ষে বিশেষায়িত ক্যাডারের জন্য বর্তমান পিএসসিই প্রিলিমিনারি ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ-প্রক্রিয়া চালু করলে চাপ বেশ কমে যাবে। এমনটা কিন্তু ডাক্তার নিয়োগের জন্য করা হচ্ছে। উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক, বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে প্রায় ৮০টি বিষয় আছে। আর প্রতিটির মূল্যায়ন ব্যবস্থা পৃথক।

এসব কিছুই তো হলো না, এখন ১৩ থেকে ২০তম গ্রেডে নিয়োগ কার্যক্রম একই পিএসসির ওপর আসছে। হয়তো বাড়বে কয়েকজন সদস্য। আর উল্লিখিত উইংটির জনবল নেহাত কম হবে না। নতুন সংযোজন কাজ দেখার জন্য পৃথক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি থাকলেও মৌলিকভাবে একই কমিশনের আওতায় আসবে। আর সাবেক তৃতীয় শ্রেণির চাকরির ধরন অনেক ক্ষেত্রেই পৃথকধর্মী। একটিমাত্র পরীক্ষার মাধ্যমে হবে না এঁদের মূল্যায়ন। বারবার নিতে হবে অনেক ধরনের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা। স্বাস্থ্য সহকারী, ধাত্রী, ইউনিয়ন কৃষি কর্মকর্তা কিংবা জরিপ বিভাগের লোকজনই শুধু পৃথকধর্মী, এমন নন। এ ধরনের বহু পদে নিয়োগ প্রস্তাব আসবে। রয়েছে পৃথক নিয়োগবিধি। প্রশ্নপত্র তৈরি, পরীক্ষা গ্রহণ, উত্তরপত্র মূল্যায়ন ও মৌখিক পরীক্ষার জন্য নিতে হবে পৃথক ব্যবস্থা। এ সিদ্ধান্তে পিএসসির কর্মকাণ্ডকে অকারণ জটিল করা হচ্ছে।

তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর নিজেদের কাজটা নিজেরা করতে পারা উচিত। কিছুদিন আগেও তা-ই হতো। হয়তোবা মনে করা হচ্ছে এতে অবাঞ্ছিত তদবির হয়, চলে নিয়োগ-বাণিজ্য। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে পরিবেশ চাপ ও দুর্নীতিমুক্ত রাখা মোটামুটি সম্ভব। কিছু ক্ষেত্রে তা হচ্ছেও। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ একটি ব্যাপক ও জটিল প্রক্রিয়া। ৮০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা ও মূল্যায়ন নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। ২০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষায় তদবির সম্পর্কে ক্ষেত্রবিশেষে কিছু অভিযোগ আছে। তবে ব্যবস্থাটি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ভয় হচ্ছে এদেরও পিএসসির হাতে তুলে দেওয়া হবে কি না? আর যা কোনো দিনও ছিল না, সে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ কেন পিএসসিকে দেওয়া হচ্ছে, এটা দুর্বোধ্য। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এতটুকু চাপ সামাল দিতে না পারলে তাদের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন করা যায়।

তবে পিএসসি বিষয়টি চেয়ে নেয়নি। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এটা তাদের ওপর অর্পণ করতে চাইছে। বিভিন্ন সংস্থা নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করলে দুর্নীতির যে ভয়, সে ভয় তো তাদের ওপর অর্পিত অন্য অনেক কাজ নিয়েও করা যায়। সেগুলোতেও রয়েছে দুর্নীতির সুযোগ। তা তো আর অন্য কোনো সংস্থার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া যাবে না। পিএসসিতে ইদানীং দুর্নীতির অভিযোগ কম আসে, এটা সত্যি। তবে এর অতীত কিন্তু অনেক সময়েই কলঙ্কযুক্ত ছিল। ভবিষ্যতে আবার হবে না, এমন কি কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবেন? বিশেষ করে অতিরিক্ত এবং অনেকের বিবেচনায় অপ্রয়োজনীয় কাজে পিএসসিকে ভারাক্রান্ত করলে একপর্যায়ে সে ব্যাধি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।

শুধু মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের বিধি যেখানে রয়েছে, সেখানে পিএসসিতেও জোরদার তদবির হবে। আর সে তদবিরগুলো একেবারে সোজাসাপ্টাও নয়। আমাদের রাষ্ট্রকাঠামোয় টাকা নিয়ে তদবির-বাণিজ্যে প্রভাবশালী মহলই জড়িত থাকে সব সরকারের সময়। পিএসসিকে এ দায়িত্বটি দেওয়ার আগে ব্যাপকভাবে পর্যালোচনা হয়েছে কি না, এটা বোধগম্য নয়। আর করা হলেও তারা নির্বাহী বিভাগের যুগবাহিত দায়িত্ব কোন বিবেচনায় পিএসসির ওপর চাপাচ্ছে, তা বোধগম্য হলেও গ্রহণযোগ্য নয়। এতে পিএসসিতে নতুন জনবল যুক্ত হলেও চাপ পড়বে তাদের সক্ষমতায়। এমনকি কাজের মানেও। নিয়োগপর্বে এখন যেটুকু সময় লাগে, আশঙ্কা হয় এমনটা হলে আরও অনেক বেশি লাগবে।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]