আসাদউদ্দিন ওয়াইসি কার লোক?

ভারতীয় মুসলমানের জাতীয় নেতা হয়ে উঠতে চাইছেন সাবেক ক্রিকেটার, হায়দরাবাদের অভিজাত রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান, লোকসভা সদস্য আসাদউদ্দিন ওয়াইসি। ছবি: এএফপি
ভারতীয় মুসলমানের জাতীয় নেতা হয়ে উঠতে চাইছেন সাবেক ক্রিকেটার, হায়দরাবাদের অভিজাত রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান, লোকসভা সদস্য আসাদউদ্দিন ওয়াইসি। ছবি: এএফপি

বিশ্বের সর্বমোট মুসলমানের ১০-১১ শতাংশ থাকে ভারতে। এই সংখ্যা প্রায় ২০ কোটি। সংখ্যাটা বিশাল। ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের পরই কোনো দেশে এত বেশি মুসলমান আছে। তবে জনসংখ্যায় ১৪ ভাগ হলেও ৫৪৫ সদস্যের ভারতীয় লোকসভায় মুসলমান সদস্য মাত্র ২৭ জন—অর্থাৎ ৫ শতাংশের কম।

ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের ফল হিসেবে ভারতে প্রভাবশালী মুসলিমপ্রধান কোনো রাজনৈতিক দল নেই এখন আর। কেরালা, আসাম, কাশ্মীর ও তেলেঙ্গানায় চারটি ছোট আঞ্চলিক দল রয়েছে। অনেকে এদের ‘এক এমপি’ ‘দুই এমপি’র দল বলেন। এসব দলের ২৯ রাজ্যের মুসলমানদের কণ্ঠ হওয়া দুরূহ। তাই জাতীয় পর্যায়ে এই সম্প্রদায়ে নেতৃত্বের সংকট আছে। পুরো জনগোষ্ঠী নানান উপদলে বিভক্ত। এর মধ্যে আসাদউদ্দিন ওয়াইসি কিছুটা ব্যতিক্রম।

লোকসভার পুরোনো এক মুসলমান সদস্য তিনি। চারবার জিতলেন। নিখিল ভারত মজলিস-এ-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের (এআইএমআইএম) প্রধান তিনি। সংক্ষেপে এই দলকে ‘মীম’ বলা হয়। মীমের লোকসভায় সদস্য মাত্র দুজন—ওয়াইসি ও ইমতিয়াজ জলিল (মহারাষ্ট্র)। তবে আসাদউদ্দিন ওয়াইসি মাঝেমধ্যেই ভারতজুড়ে মুসলমানদের স্বার্থের জায়গা থেকে বিতর্ক তোলেন। ২০ কোটি মানুষের হতাশাকে ভাষা দেন তিনি। ভারতীয় সংবিধানের চৌহদ্দিতেই তাঁর চলাচল। তবে আসাদউদ্দিনের ভঙ্গি, সাহস ও উচ্চাভিলাষ প্রতিনিয়ত আলোচনায় রাখে তাঁকে। এসব দেখে ভক্তরা তাঁকে বলেন ‘নকিব-ই-মিল্লাত’। অর্থাৎ ‘সম্প্রদায়ের জন্য ভবিষ্যতের বাহক’। কোনোভাবেই অতীতের অন্যদের মতো ভারতের ‘সরকারি মুসলমান নেতা’ নন তিনি।

ক্রিকেট থেকে রাজনীতিতে
তরুণ বয়সে ওয়াইসি ক্রিকেট খেলতেন। অসাধারণ দেহ গঠন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সাড়া জাগানো ফাস্ট বোলার ছিলেন। ক্রিকেট নিয়ে লেখেনও। উর্দু ও ইংরেজিতে দারুণ বাগ্মী। আইন শাস্ত্রে পড়েছেন লন্ডনে। ব্যারিস্টার হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। শেষ পর্যন্ত দাদা আবদুল ওয়াহেদ ওয়াইসির ধারাবাহিকতায় ‘ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’-এর দায়িত্ব নিয়েছেন পিতা সুলতান সালাউদ্দিন ওয়াইসির মৃত্যুর পর। ভাই আকবরউদ্দিনও ‘মীম’-এর বড় নেতা। অর্থ-সম্পদের জোর আছে এই পরিবারের।

দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক ডাইনেস্টির তালিকায় ওয়াইসিরাও আছেন। এ রকম পরিবারের ছেলেমেয়েরা বিদেশে উচ্চশিক্ষা শেষ করে পারিবারিক রাজনৈতিক ব্যবসার হাল ধরেন। আসাদউদ্দিনও তা-ই করেছেন। তবে আশরাফ-আতরাফের সীমানা পেরোতে ইচ্ছুক মনে হয় তাঁকে।

পশ্চিমবঙ্গে আসাদউদ্দিন ঝড়
স্বাধীনতার সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে ১৭৮ বছর হায়দরাবাদ ‘নিজাম’দের রাজধানী ছিল। এই শহরেই ৯৩ বছর আগে মীমের যাত্রা। শহরটিতে এখন মুসলমানেরা ৩০ শতাংশের কাছাকাছি। ২০০৮-এ মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত সুলতান উদ্দীন ওয়াইসি ছিলেন এখানকার সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। তাঁকে ‘সালার-এ-মিল্লাত’ (সম্প্রদায়ের অধিনায়ক) বলা হতো। তাঁর অঙ্গুলি হেলনে মুসলমান ভোটব্যাংক নড়াচড়া করত তখন। পুত্র আসাদউদ্দিন সেই প্রভাবকে হায়দরাবাদের বাইরে নিতে ইচ্ছুক।

পুরোনো অন্ধ্রপ্রদেশ ভেঙে ইতিমধ্যে তেলেঙ্গানা নামে আরেক রাজ্য হয়েছে এবং হায়দরাবাদ সেই রাজ্যে পড়ে গেছে। তবে আসাদউদ্দিন কেবল তেলেঙ্গানার রাজনীতিবিদ নেই আর। টুইটারে তাঁর অনুসারী সাত লাখ। সমগ্র ভারতের মুসলমান তরুণ-তরুণীরা অনেক বিষয়ে তাঁর মতামত জানতে উদগ্রীব থাকেন। ২০১৪ সালে বেসরকারি এক সংস্থা লোকসভায় ১২ জন শ্রেষ্ঠ পার্লামেন্টেরিয়ানের তালিকায় রেখেছে তাঁকে। সেখানে সংখ্যালঘুর ভরসা হলেও সংখ্যাগুরুর তরফ থেকে প্রায়ই আক্রান্ত হন তিনি। তাঁকে নিয়ে মুসলমান সমাজেও বিতর্ক আছে।

যেখানেই মুসলমান ভোট আছে, আসাদউদ্দিন সেখানেই মীমকে গড়তে চাইছেন। সর্বশেষ, ঝড় তুলেছেন পশ্চিমবঙ্গে। কেউ কেউ বলছেন, মীম ‘মুসলমান ভোট’ ভাগ করছে মাত্র, যা মুসলমানদের জন্যই আত্মঘাতী। এর প্রধান সুবিধাভোগী হচ্ছে বিজেপি। লোকসান হচ্ছে কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস ও বাম দলগুলোর।

প্রশ্ন উঠেছে, আসাদউদ্দিন তাহলে কার হয়ে খেলছেন? বিতর্ক তৈরি হয়েছে, আসাদউদ্দিনের পথ যদি ভুল হয়, তাহলে ভারতে সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ কী?

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনকে লক্ষ্য করে মীমকে নিয়ে আসাদউদ্দিনের আগমন হঠাৎ করেই। স্বভাবত সংখ্যালঘু ভোটব্যাংকের অতীত সুবিধাভোগী কংগ্রেস-সিপিএম এবং বর্তমান সুবিধাভোগী তৃণমূল ভালো চোখে দেখছে না বিষয়টা।

প্রায় ৩০ ভাগের মতো সংখ্যালঘু ভোট আছে পশ্চিমবঙ্গে, যার সামান্য অংশও যদি মীম নেয়, মমতার জন্য অনেক আসনে সেটা সমস্যা করবে। এই সহজ হিসাব থেকেই মমতা সম্প্রতি কোচবিহারে এক জনসভায় বলেছেন, আসাদউদ্দিন বিজেপির অর্থ নিয়ে সংখ্যালঘু ভোট ভাগ করতে এসেছেন। তিনি আসলে সংখ্যালঘু বিচ্ছিন্নতাবাদী। মমতার ভাষায়, ‘সংখ্যালঘুদের মধ্যে উগ্রপন্থার বিষ ঢোকানোর চেষ্টা করছে অনেকে। হায়দরাবাদ থেকে এ রাজ্যে এসে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। বিজেপির অর্থ নিয়ে এ রাজ্যে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে একজোট হোন। সংখ্যালঘু ভাইবোনদের অনুরোধ করব কারও উসকানিতে ভুল করবেন না।’

উত্তরে আসাদউদ্দিন ১৯ নভেম্বর টুইটারে লিখেছেন, ‘বাংলার মুসলিম সম্প্রদায় মানবতার সূচকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায়, এটা বলা ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতাবাদ সৃষ্টি করা নয়। ক্ষমতা মমতাকে অসহিষ্ণু করে তুলেছেন।’ একই দলের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যপ্রধান জামিরুল হাসান বলেছেন, ‘২০২১-এর নির্বাচনে মীম পশ্চিমবঙ্গে লড়বে। মমতা ভোটব্যাংক হারানোর ভয়ে রেগে যাচ্ছেন।’ এই জামিরুল হাসানও একদা তৃণমূলেই ছিলেন।

সংখ্যালঘুর রাজনৈতিক ক্ষমতা কোন পথে?
সন্দেহ নেই, আসাদউদ্দিনের সঙ্গে মমতার বিবাদে বিজেপি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। একই রকম ঘটে মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচনকালে। এভাবেই সেই পুরোনো বিতর্ক আবার ছড়িয়ে পড়ল, ভারতে মুসলমানদের রাজনৈতিক শক্তি অর্জনের পথ কী? কংগ্রেস ও সেক্যুলার বলে দাবিদার দলগুলোর ভোটব্যাংক হয়ে থাকাই কি তার নিয়তি? ওয়াইসি কি এর সমাধান দিতে সক্ষম?

আসাদউদ্দিন যেভাবে রাজনীতি করছেন, তাতে মুসলমানদের ইস্যুগুলো সামনে এলেও ক্ষমতার কাঠামোতে মুসলমানদের হিস্যা বাড়ছে না। বরং কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট দলগুলোতেও এই সম্প্রদায়ের দর-কষাকষির শক্তি কমে যাচ্ছে। বিজেপিও চাইছে ভোটাররা ধর্মীয় লাইনে বিভক্ত হোক। মীম এই কৌশলকে সাহায্য করছে।
এই অবস্থার একটাই বিকল্প, নির্বাচনপদ্ধতি পাল্টানো। যেমনটি দরকার বাংলাদেশেও। এই দুই দেশে ভোট ব্যবস্থায় সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে জনপ্রতিনিধি বাছাই করা হলেই কেবল পার্লামেন্টে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ত। অর্থাৎ কোনো দল বা জোট যে পরিমাণ ভোট পাবে, সেই অনুপাতে পার্লামেন্টে আসন পাবে। মার্কার ওপর ভোট হবে। ‘যার যত সংখ্যা তার তত ভাগ’। কিন্তু যত দিন এ রকম কিছু না হচ্ছে, তত দিন কি কথিত ‘সেক্যুলাররা’ই সংখ্যালঘুদের অভিভাবক থাকবে?

আসাদউদ্দিন এই সমীকরণ বদলাতে চান। তাঁর সমর্থকদের বক্তব্য: মীমের আগে দীর্ঘ কয়েক যুগ মুসলমানরা দল বেঁধে কংগ্রেস ও বামদের ভোট দিয়েছেন। গত নির্বাচনেও বিজেপির বিজয় ঠেকাতে বিরোধীদের সাহায্যে উত্তর প্রদেশে মীম প্রার্থী দেয়নি। তাতে সেখানে হিন্দুত্ববাদের উত্থান থামেনি। মুসলমানদেরও লাভ হয়নি। ‘বড় দলে’র ভেতর দিয়ে মুসলমান প্রতিনিধিত্বের ধারণা অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ‘নিরাপদ ও স্থায়ী ভোটব্যাংক’ ভেবে মুসলমান ও দলিতদের এলাকাতেও এসব দল বছরের পর বছর উচ্চবর্ণের হিন্দু কিংবা প্রধান নেতাদের অনুগত অজনপ্রিয় মুসলমানদের প্রার্থী দেয়। অনেকের ভাষায়, ‘এসব দলে মুসলমানদের ইজ্জত নাই।’ ফলে লোকসভা ও বিধানসভায় মুসলমান প্রতিনিধিত্ব কমছে তো কমেছেই। সংখ্যালঘুদের মাঝে নতুন নেতৃত্বও তৈরি হচ্ছে না।

পশ্চিমবঙ্গের উদাহরণ দিয়ে মীম বলে অন্তত ১৪টি মুসলমানপ্রধান লোকসভা আসন আছে। কিন্তু এই সম্প্রদায়ের জনপ্রতিনিধি চারজন মাত্র। সুতরাং বিজেপির উত্থানের ভয়ে মুসলমানদের রাজনৈতিক দল না করার যুক্তি ‘ব্ল্যাকমেল’-এর মতো। বরং উল্টো পথে সংখ্যালঘুদের জনপ্রতিনিধিত্ব বাড়বে। যেসব এলাকায় তারা বড় সংখ্যায় আছে, সেখানে এককাট্টা হয়ে ভোট দিলে না জেতার কারণ নেই। নজির মহারাষ্ট্রের নির্বাচন। সেখানে কংগ্রেস ও বিজেপি জোট করে নির্বাচন করা সত্ত্বেও মীম তাদের বিরুদ্ধে ২টি আসনে জিতেছে; ৪টিতে দ্বিতীয় হয়েছে।

এ রকম সফলতা বাড়াতে আসাদউদ্দিন মুসলমানদের সঙ্গে দলিতদেরও চাইছেন। মহারাষ্ট্রে তিনি আম্বেদকরের নাতি প্রকাশ আম্বেদকরের সঙ্গে মৈত্রী গড়তে ইচ্ছুক। সেখানে মীম এবার ৪৪টি মনোনয়নের মধ্যে ১২ জন দিয়েছে অমুসলিম সম্প্রদায় থেকে। হায়দরাবাদে তাদের মনোনীত অনেক মেয়র অমুসলিম। তবে নিজের পারিবারিক রাজনীতির অতীত আর দলের সম্প্রদায়গত নামের কারণে দলিতদের কাছে ভেড়ানো আসাদউদ্দিনের জন্য মুশকিল। তিনি যাতে দলিতদের কাছে টানতে না পারেন, সে জন্য বিজেপি তাঁকে ‘মুসলমানদের নেতা’ হিসেবেই নানান কৌশলে বিতর্কে ফেলে। সেই বিতর্কের জবাবও দিতে হয় তাঁকে।

মীম-বিজেপির এই দ্বন্দ্বে পশ্চিমবঙ্গসহ সমগ্র ভারতে বিজেপিবিরোধী ‘সেক্যুলার’রা মুশকিলে আছেন। তাঁদের অনুমান, পারস্পরিক যোগাযোগ না থাকলেও মীম আসলে বিজেপির রাজনৈতিক লাইনই বাস্তবায়ন করছে। ‘ওয়াইসিরা বিজেপিরই লোক’।

ওয়াইসি অবশ্য বলছেন, বিজেপি কিংবা ক্ষমতা কিছুই নয়; তিনি কেবল চাইছেন ‘ভারতের প্রতিটি রাজ্যে অন্তত একজন মুসলমান নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকুন, যিনি নিজের শক্তিতে জিতে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বড় দলগুলোর কাছে জানতে চাইবেন, ১৪ ভাগ সংখ্যালঘু মুসলমানের জন্য ৭০ বছরে তারা কে কী করেছে?

নিঃসন্দেহে ভারতীয় সেক্যুলারিজমের কাছে এ রকম প্রশ্নের উচ্চকণ্ঠে দেওয়ার মতো উত্তর নেই। আসাদউদ্দিন ওয়াইসি তাই আপাতত এক ক্রোধের প্রতীক। ফাস্ট বোলার জীবনের মতোই এখনো তিনি জোরে বল করছেন এটা জেনেই যে, ব্যাটিংয়ের সময় তাঁর রান পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক