লিবিয়ায় পশ্চিমাদের ছায়াযুদ্ধ ও বাংলাদেশি প্রাণ

গত ১৮ নভেম্বর এই বিস্কুট কারখানায় বিমান হামলা হলে নতুন করে নিহত হন আরও এক বাংলাদেশি। ছবি এএফপি
গত ১৮ নভেম্বর এই বিস্কুট কারখানায় বিমান হামলা হলে নতুন করে নিহত হন আরও এক বাংলাদেশি। ছবি এএফপি

লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। জাতিসংঘের হিসাবে গত সাড়ে সাত মাসের যুদ্ধে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন অন্তত ১,১০০ মানুষ। আহত হয়েছেন আরও প্রায় ৬,০০০ এবং বাস্তুচ্যুত হয়েছেন প্রায় ১ লাখ ২৮ হাজার মানুষ। নিহত লোকজনের মধ্যে অন্তত ২০০ জন বেসামরিক, পত্রপত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী যাঁদের একটা বড় অংশই বিদেশি। আর ত্রিপোলির বাংলাদেশ দূতাবাসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী নিহত লোকজনের মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা অন্তত ১০ জন। ১৮ নভেম্বরে মৃত্যু হলো আরও এক বাংলাদেশির।

বিদেশিদের ওপর আক্রমণের সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে ১৮ নভেম্বর, সোমবার। ত্রিপোলির অদূরে ফ্রন্টলাইনের কাছাকাছি ‘ওয়াদি রাবিয়া’ নামের এলাকায় একটি বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে শতাধিক বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের কয়েক শ শ্রমিক কাজ করতেন। সেদিন সকালে প্রথমে ফ্যাক্টরির পাশেই অবস্থিত একটি সামরিক স্থাপনার ওপর ড্রোন হামলা চালানো হয়। আতঙ্কিত শ্রমিকেরা যখন ছুটোছুটি করতে শুরু করেন, তখন তাঁদের ওপর একের পর এক মিসাইল এসে পড়তে থাকে। প্রত্যক্ষদর্শী লোকজনের বিবরণ অনুযায়ী, তাঁরা যখন বাঁচার জন্য দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করছিলেন, তখন মূল ঘটনাস্থাল থেকে বেশ কিছু দূরে চলে যাওয়ার পরও ড্রোনগুলো তাদের অনুসরণ করে তাদের ওপর মিসাইল নিক্ষেপ করছিল।

সোমবারের এই হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৭ জন, যাঁদের মধ্যে ১ জন বাংলাদেশি এবং আরও ৪ জন আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের। এ ছাড়াও আহত হয়েছেন আরও ৩৫ জন, যাঁদের মধ্যে ১৫ জনই বাংলাদেশি। দূতাবাসের সূত্র অনুযায়ী, এঁদের মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁদের ত্রিপোলির একটি হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়েছে।

এর আগে গত ৩ জুলাই ঘটেছিল প্রবাসীদের ওপর সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনাটি। ওই ঘটনায় ত্রিপোলির অদূরের তাজুরা নামক এলাকার একটি অভিবাসী আটককেন্দ্রের ওপর চালানো বিমান হামলায় ৬ জন বাংলাদেশি নিহত এবং আরও ৭ জন আহত হয়েছিলেন। নিহত দুজনের শরীর এমনভাবে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল যে তাঁদের লাশ চিহ্নিত করাও সম্ভব হয়নি।

যুদ্ধটা লিবিয়ার হলেও বাংলাদেশিদের নিহত হওয়ার ঘটনাগুলোর অধিকাংশই ঘটেছে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর চালানো বিমান কিংবা ড্রোন হামলায়। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, তাজুরার অভিবাসী আটককেন্দ্রটিতে হামলা চালিয়েছিল ‘একটি বিদেশি রাষ্ট্র’। যদিও নাম উল্লেখ করা হয়নি, কিন্তু অধিকাংশ প্রতিবেদনেই এই হামলাটিকে আরব আমিরাতের বিমান হামলা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সোমবারের ওয়াদি রাবিয়ার হামলাটির পরও জিএনএ সরকারের পক্ষ থেকে আরব আমিরাতকে দায়ী করা হয়েছে।

এর আগে গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সরকারের পক্ষের একটি বিমান হামলায়ও একজন বাংলাদেশি নিহত হয়েছিলেন। এখন পর্যন্ত নিহত ১০ জন বাংলাদেশির মধ্যে ৭ জনই যে বিমান হামলায় মারা গেছেন, সেটাও মূলত লিবিয়ার এই প্রক্সি ড্রোনযুদ্ধের চরিত্রটাকেই তুলে ধরে।

রাজধানী ত্রিপোলি নিয়ন্ত্রণের জন্য এ বছরের এপ্রিলের ৪ তারিখে শুরু হওয়া এ যুদ্ধ শুরু থেকেই ছিল মূলত আন্তর্জাতিক ছায়াযুদ্ধ বা প্রক্সি যুদ্ধ। গত সাড়ে সাত মাসে এর আন্তর্জাতিক রূপটি কেবল আরও প্রকট হয়েছে; অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্য দিয়েও, নিহত বেসামরিক জনগণের মধ্য দিয়েও।

লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে এই মুহূর্তে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছে অন্তত ৯টি দেশ। একদিকে পূর্বাঞ্চলীয় সরকারের সেনাপ্রধান মার্শাল খালিফা হাফতারকে সাহায্য করছে প্রধানত আরব আমিরাত, কিন্তু তার সঙ্গে আরও আছে মিসর, সৌদি আরব, ফ্রান্স, সুদান, জর্ডান ও রাশিয়া। অন্যদিকে জাতিসংঘ-সমর্থিত সরকার জিএনএর (গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল অ্যাকর্ড) পক্ষে আছে প্রধানত তুরস্ক, এবং সেই সঙ্গে সীমিত আকারে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছে কাতার। আর এসব দেশের অর্থায়নে এবং এদের দেওয়া অস্ত্রের এলোপাতাড়ি গোলাগুলি এবং বিমান হামলায় নিহত হচ্ছে দুই পক্ষের লিবিয়ান যোদ্ধাদের পাশাপাশি প্রায় এক ডজন দেশের নাগরিক।

যুদ্ধ চলছে ত্রিপোলি শহরের কেন্দ্র থেকে ২৫-৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দুই-তিনটি ফ্রন্টলাইনে, কয়েক কিলোমিটারের সীমিত কিছু এলাকায়। কিন্তু জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী এই ছোট এলাকাতেই গত সাড়ে সাত মাসে হাজারের বেশি ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে। এর মধ্যে হাফতারের পক্ষে আরব আমিরাত চালিয়েছে প্রায় ৮০০ হামলা এবং জিএনএ সরকারের পক্ষে তুরস্ক চালিয়েছে প্রায় ২৪০টি হামলা।

লিবিয়ার এই প্রক্সি যুদ্ধটি মূলত ২০১৪ সালে শুরু হওয়া দেশটির দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধেরই বিলম্বিত ধারাবাহিকতা, কিন্তু এর মূল নিহিত আছে ২০১১ সালের গাদ্দাফিবিরোধী গৃহযুদ্ধে। জটিল এই প্রক্সি যুদ্ধের অনেক বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা যেতে পারে, কিন্তু সংক্ষেপে বলতে গেলে একদিকে এটা হচ্ছে মিসরের জেনারেল সিসি স্টাইলের পুরোনো সামরিক কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী মার্শাল হাফতারের সঙ্গে তথাকথিত গণতান্ত্রিক শক্তির বা সংস্কারপন্থীদের লড়াই। একই সঙ্গে এটা হচ্ছে কাতার ও তুরস্ক সমর্থিত রাজনৈতিক ইসলামি শক্তির বিরুদ্ধে সৌদি আরব ও আমিরাত সমর্থিত নন-ইসলামিস্ট শক্তির লড়াই, যারা এই অঞ্চলে গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক ইসলাম উভয়ের বিস্তারকেই নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে গণ্য করে।

এর বাইরে ফ্রান্স, রাশিয়াসহ অন্যান্য রাষ্ট্র এই যুদ্ধে যোগ দিয়েছে নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে, অথবা নিজেদের আঞ্চলিক মিত্রদের অনুরোধে। আমেরিকা ২০১২ সালের পর থেকে লিবিয়া থেকে নিজেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে রেখেছিল। কিন্তু প্রকাশ্যে তাদের অবস্থান জাতিসংঘ-সমর্থিত সরকারের প্রতি হলেও তাদের প্রধান দুই আঞ্চলিক মিত্র সৌদি আরব ও আরব আমিরাত যেহেতু হাফতারের প্রধান পৃষ্ঠপোষক, তাই হাফতারের বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠলেও আমেরিকাকে নীরব ভূমিকা পালন করতেই দেখা গেছে। ইয়েমেনের মতোই লিবিয়াতেও মূলত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মৌন সমর্থনই আরব আমিরাতকে বেপরোয়া বিমান হামলা চালিয়ে বেসামরিক জনগণকে হত্যার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে।

লিবিয়ার এই গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটার কোনো সম্ভাবনা শিগগির দেখা যাচ্ছে না। বরং দিনে দিনে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে। বিশেষ করে গত সেপ্টেম্বর থেকে হাফতারের পক্ষে রুশ প্রাইভেট মিলিটারি বাহিনী ওয়াগনারের ২০০ সৈন্য যোগ দেওয়ার পর যুদ্ধটা নতুন মাত্রা পেয়েছে। ইয়েমেনের মতোই লিবিয়ার এই যুদ্ধও গড়াতে পারে কয়েক বছর পর্যন্ত, বাড়তে পারে বেসামরিক জনগণের হতাহতের ঘটনা, নিশ্চিত হতে পারে লিবিয়ার চিরস্থায়ী ধ্বংস।

তবে এখনো লিবিয়ার এই যুদ্ধ ত্রিপোলির নির্দিষ্ট কিছু এলাকার মধ্যেই সীমিত আছে। অধিকাংশ সময়ই দেখা যায়, বিদেশে বাংলাদেশিদের এ ধরনের মৃত্যুর সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে সেই দেশে বৈধভাবে মানুষের আসা-যাওয়াও বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু লিবিয়াতে এখনো সে রকম কিছু করার সময় আসেনি। ত্রিপোলির বাইরে লিবিয়ার বিভিন্ন শহর, এমনকি ত্রিপোলিতেও যুদ্ধের প্রভাবের বাইরে বিভিন্ন এলাকায় বাংলাদেশিরা মোটামুটি ভালো আছেন। তাঁরা নিয়মিত রেমিট্যান্সও পাঠাতে পারছেন।

বরং যেটা করা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে, ফ্রন্টলাইনের আশপাশের এলাকাগুলো থেকে বাংলাদেশিদের সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে, কিংবা সরে যেতে শ্রমিকদের উৎসাহিত করার ব্যাপারে সরকারের এবং দূতাবাসের আরও জোরালো ভূমিকা। সেই সঙ্গে অবৈধভাবে দুবাই কিংবা সুদান হয়ে টুরিস্ট ভিসা নিয়ে লিবিয়ায় প্রবেশ বন্ধ করার ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। কারণ লিবিয়ায় যারা আগে থেকেই বসবাস করছেন, তাঁরা ইতালিতে না গেলেও নতুন করে যাঁরা আসছেন, তাঁদের অনেকেই ইতালিতে যাওয়ার জন্যই আসছেন এবং সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করছেন কিংবা বন্দী হয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। এভাবে সমুদ্রপথে মৃত্যুর সংখ্যা যুদ্ধের কারণে মৃত্যুর সংখ্যার চেয়ে অনেকগুণ বেশি।

লেখক: লিবিয়ায় কর্মরত পুরপ্রকৌশলী।
[email protected]