পতনের সীমা ও সত্যিকার নায়ক

ইলিয়াস কাঞ্চন। ছবি: ইউএনবি
ইলিয়াস কাঞ্চন। ছবি: ইউএনবি

‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ও ইলিয়াস কাঞ্চন। ঢাকাই সিনেমার দুটি আলোচিত নাম। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ চলচ্চিত্রে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করে আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন। বিশেষত মফস্বলে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা ছিল উল্লেখ করার মতো। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র ‘বেদের মেয়ে জোসনা’। বিষয়টি এমন নয় যে ইলিয়াস কাঞ্চন ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র থেকে ভালো কোনো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেননি। বরং ইলিয়াস কাঞ্চনের বেশ কিছু চলচ্চিত্র শিল্পের বিবেচনায় যোজন যোজন এগিয়ে থাকবে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র থেকে। কিন্তু এর পরও তিনি ‘বেদের মেয়ের জোসনা’র নায়ক হিসেবেই বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অধিক পরিচিত।

পরিচয় সৃষ্টি ও ভাঙা-গড়ার একটি প্রক্রিয়া আছে। লোকগাথা-নির্ভর চলচ্চিত্র ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র নায়ক এখন বাস্তবে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেরও নায়ক। নায়কের পরিচিতি থেকে বেরিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন নতুন এক পরিচয় সৃষ্টি করেছেন। চলচ্চিত্রের নায়ক হতে পারেন অনেকেই। কিন্তু গণমানুষের নায়ক হওয়া অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তারকাদের নানা ধরনের দাতব্য কাজে সম্পৃক্ত থাকতে দেখা যায়। তবে আমাদের দেশে তারকাদের তেমন সামাজিক কাজে সম্পৃক্ত হতে দেখা যায় না। কেউ কেউ ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত হন বড়জোর। ওই পর্যন্তই। এর বাইরে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কাজ করতে দেখা যায় না। অবশ্য নির্বাচনের মনোনয়নের জন্য তারকাদের দৌড়ঝাঁপ দেখার মতো। ইলিয়াস কাঞ্চন এখানে ব্যতিক্রম। তাঁকে নিয়ে বিস্তর আলোচনা, সমালোচনা হতে পারে। তিনি ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে নন। তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শও নিশ্চয়ই আছে। কখনো কখনো তিনি বিতর্কিতও হয়েছেন। কিন্তু এসব আলোচনা, সমালোচনা, বিতর্ককে ছাপিয়ে চলচ্চিত্রের নায়ক থেকে ইলিয়াস কাঞ্চন নিরাপদ সড়কের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।

সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন নিহত হওয়ার পর ইলিয়াস কাঞ্চন নিরাপদ সড়কের দাবিতে পথে নামেন। ইলিয়াস কাঞ্চন কতটুকু সফল হয়েছেন বা কী করতে পেরেছেন, এসব নিয়ে তর্কবিতর্ক করা যাবে। কিন্তু তাঁর কাজের প্রয়োজনীয়তা বোঝা যায় স্কুলের বাচ্চাদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, প্রতিদিন গড়ে ৫৫ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। বছরে মোট মৃত্যুর পরিমাণ ১২ হাজার। কমপক্ষে ৩৫ হাজার মানুষ আহত হয়ে থাকেন বিভিন্ন ধরনের সড়ক দুর্ঘটনায়। ঘর থেকে বের হয়ে এখন আর কেউ নিরাপদ না। নগরীর ব্যস্ত সড়কে কখন কার গায়ে গাড়ি উঠে আসবে, কখন কোন বাস কাকে পিষে ফেলবে, এ নিয়ে শঙ্কায় থাকতে হয়। সড়ক থেকে ছিটকে পড়া বা মুখোমুখি সংঘর্ষের কথা না হয় বাদই দিলাম।

মূলত এই অনিশ্চয়তা, ভয় ও শঙ্কার পরিবেশ থেকে মুক্তির জন্যই ইলিয়াস কাঞ্চন দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করছেন।

সাম্প্রতিক সড়ক পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের ধর্মঘটে নতুন করে আলোচনায় এসেছেন ইলিয়াস কাঞ্চন। ধর্মঘট চলাকালে ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবিতে জুতার মালা পরিয়ে বিভিন্ন জায়গা বিশেষ করে বাস টার্মিনালগুলোতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। মনে হচ্ছে, পরিবহনশ্রমিকেরা ইলিয়াস কাঞ্চনের প্রতি প্রচণ্ড রকম খেপে আছেন। সড়ক দুর্ঘটনায় কঠোর শাস্তির বিধান রেখে তৈরি আইনের জন্য পরিবহন মালিক ও শ্রমিকেরা ইলিয়াস কাঞ্চনকেই দায়ী করছেন। কিন্তু এই আইন তো কেবল পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের জন্য না। দেশের সব নাগরিকদের জন্য। চালক-পথচারী সবার জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য। ট্রাক-বাসের চালক যেমন কোনো ভুল করলে শাস্তি ভোগ করবেন, তেমনি কোনো ব্যক্তিগত গাড়ির চালক, পথচারী ভুল করলেও সমান শাস্তি ভোগ করবেন।

মূল বিষয় হচ্ছে, দেশের অধিকাংশ যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের গাড়ি ত্রুটিযুক্ত। মালিক ও শ্রমিকেরা ভালো করেই জানেন অদক্ষ চালক দিয়ে এসব লক্করঝক্কর মার্কা যানবাহন পরিচালনা করলে দুর্ঘটনা ঘটতে বাধ্য। এ ক্ষেত্রে আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে শাস্তি এড়ানো কঠিন হবে। আইনের যে সঠিক প্রয়োগ হবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে এত দিন যেহেতু এ রকম কোনো আইন ছিল না তাই মহামারি আকারে দুর্ঘটনার পরও চালকেরা পার পেয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এখন নতুন আইন হওয়াতে জনগণের চাপের মুখে অপরাধ করে পার পাওয়া সহজ হবে না। তাই পরিবহনমালিক ও শ্রমিকেরা এই আইনের বিপক্ষে নেমেছেন। শুধু তা-ই নয়, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করা ইলিয়াস কাঞ্চনেরও বিরুদ্ধাচরণও করছেন। মালিক-শ্রমিকেরা কি হলপ করে বলতে পারেন তাঁদের কেউ দুর্ঘটনার শিকার হবেন না?

দেশের পরিবহন খাত এখন বেপরোয়া মাফিয়াদের দখলে। পরিবহন ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক পরিচয় থাকলেও এঁদের বড় পরিচয় গডফাদার হিসেবেই। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের গডফাদাররা পরিবহন খাতে একজোট হয়েছেন। জাতীয় রাজনীতিতে মতভিন্নতা দেখা গেলেও পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণে তাঁদের মধ্যে কোনো ভিন্নতা নেই। বিভিন্ন জেলা শহরের সন্ত্রাসী ও মাস্তান পোষেন, এমন লোকজনই পরিবহন খাতের সঙ্গে জড়িত। নিখাদ ব্যবসায়ী যে পরিবহন খাতে নেই, তা নয়। বরং প্রকৃত ব্যবসায়ীরা এসব গডফাদারদের কাছে জিম্মি। এঁরা এতটাই ক্ষমতাধর যে ইলিয়াস কাঞ্চন থেকে স্কুলের আন্দোলনকারী বাচ্চা, কারওই রেহাই নেই। যোগাযোগ খাতে সরকারি সেবাকে রীতিমতো পঙ্গু করে রেখেছেন। ইলিয়াস কাঞ্চন এখন এঁদের রোষানলে পড়ছেন। নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজপথে নামা বাচ্চারাও হেলমেট বাহিনীর রোষানলে পড়েছিল।

মাফিয়ানিয়ন্ত্রিত, গডফাদারনির্ভর পরিবর্তন খাতকে পর্যবেক্ষণ করলে এক ধরনের অবক্ষয় লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণির অবক্ষয়। এই শ্রমিক শ্রেণি লুটেরা, লুম্পেনদের প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু শ্রমিক-মজদুরদের তো বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া কথা। আধিকার আদায়ে সোচ্চার হওয়ার কথা। শ্রমিকদের আজ ইলিয়াস কাঞ্চনের পক্ষে থাকার কথা। নিরাপদ সড়কের দাবিতে পথে নামা লাখো বাচ্চার সঙ্গে যোগ দিয়ে আন্দোলনকে সফল করার কথা। কিন্তু সেই শ্রমিক শ্রেণির কিছু অপরিণামদর্শী লোক আজ ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবিতে জুতার মালা পরিয়ে দেন। হেলমেট পরে ছাত্রসংগঠনের ক্যাডারদের সঙ্গে মিলে হামলা করেন। আইন সংস্কার করে নির্বিচারে পথচারী, যাত্রী খুনের লাইসেন্স চান!

পতনের এটাও এক সীমা বটে।

ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন