পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অনুষঙ্গ ক্যাসিনো

>
লেবাননে মধ্যপ্রাচে্যর সবচেয়ে পুরোনো ক্যাসিনো ‘ক্যাসিনো দে লিবান’
লেবাননে মধ্যপ্রাচে্যর সবচেয়ে পুরোনো ক্যাসিনো ‘ক্যাসিনো দে লিবান’
সাম্প্রতিক ক্যাসিনো-কাণ্ড দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এ দেশে আধুনিক ও পূর্ণাঙ্গ ক্যাসিনো গড়ে উঠেছে, তা প্রায় অজানা ছিল। বিশ্বের অনেক দেশে ক্যাসিনো বৈধ, কিন্তু বাংলাদেশে পুরোপুরি অবৈধ। সরকারি দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু প্রভাবশালী লোকের ছত্রচ্ছায়ায় বিভিন্ন ক্লাবে গড়ে ওঠা ক্যাসিনোগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে উচ্ছেদ করেছে। আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্যতম অনুষঙ্গ ক্যাসিনো। আবার মানবসভ্যতার বিকাশের শুরু থেকেই মানুষের মধ্যে জুয়া বা ঝুঁকি গ্রহণের প্রবণতা লক্ষণীয়। ‘জুয়া, আধুনিক পুঁজিবাদ ও রাষ্ট্র: ঝুঁকিপূর্ণ সমাজমুখী যাত্রা’ শিরোনামের একটি লেখার তিন পর্বের ধারাবাহিকের দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হচ্ছে আজ। লিখেছেন কথাসাহিত্যিক ও যুক্তরাজ্যের নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক আফসানা বেগম।

ক্যাসিনো শিল্প নাকি বিজ্ঞান?
(বাকি অংশ)

একইভাবে, জেমস বন্ড সিরিজের ২০০৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ক্যাসিনো রয়্যাল দেখলে মনে হয় ড্যানিয়েল ক্রেগের টানটান স্যুট পরা আভিজাত্য, নির্লিপ্ত মুখভঙ্গি কিংবা অবলীলায় পকেট থেকে পিস্তল বের করে পোকার গেমের টেবিলে রাখা—এ সবই যেন ক্যাসিনোর জুয়ায় জেতার মন্ত্র। সাহিত্যের কথা বলতে গেলে ফিয়োদর দস্তয়েভস্কির জুয়ায় আসক্ত ব্যক্তিগত জীবনের ছায়া অবলম্বনে তাঁরই লেখা দ্য গ্যাম্বলার নামের ছোট উপন্যাসটির কথা বলতেই হয়। অ্যালেক্সি ইভানোভিচ নামের তরুণ শিক্ষক জুয়ায় জিতে ধনী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা লালন করেন। তিনি যাঁকে ভালোবাসেন তাঁর উপস্থিতি, এমনকি তাঁকে নিয়ে ভাবনার উপস্থিতিও ইভানোভিচকে খেলায় জিতিয়ে দেয় বা জিতে যাওয়ার পেছনে এটাই কারণ বলে ইভানোভিচের ধারণা। আত্মকথনের মাধ্যমে বর্ণনা এগিয়ে চললেও পাঠক দ্রুত ইভানোভিচের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে পারে। তাই পাঠকের কাছেও তখন খেলায় জেতার কারণটি স্বাভাবিক লাগে। তার মনে হয়তো দস্তয়েভস্কির লেখা সেই বাক্য অনুরণিত হতে থাকে, ‘আমাকে শুধু একবার নিজেকে প্রকাশ করতে দাও, আমি রাতারাতি আমার ভাগ্য বদলে দেব। আমার আমিই এখানে সব।’ আর তাই শেষ দৃশ্য পর্যন্ত পাঠককে সেই চিন্তাই বয়ে বেড়াতে হয়। হতাশ ও অবসাদগ্রস্ত ইভানোভিচ যখন হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার মানুষের ঠিকানা পায় আর হাতে পায় সামান্য কিছু অর্থ, মনে মনে পরদিনই তার কাছে ছুটে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে আর অতীতে যে কারণে জুয়ায় জিতেছিল, সেই স্মৃতি রোমন্থনে ব্যস্ত হয়।

অথচ জুয়ার প্রক্রিয়াটি অনেকটাই নির্ভর করে গণিতের একটি শাখা, পরিসংখ্যানের প্রবাবিলিটি থিওরির ওপর, জুয়ার ক্ষেত্রে যা গেম থিওরি। সাধারণ সম্ভাবনাকে হিসাব করে বের করার ক্ষেত্রে প্রবাবিলিটি থিওরি ব্যবহৃত হয়। দুটো ভিন্ন ধরনের সম্ভাবনার ক্ষেত্রে প্রতিটির পৃথকভাবে এবং দুটোর একই সঙ্গে উপস্থিত হওয়ার সম্ভাবনা এই থিওরির মাধ্যমে গাণিতিকভাবে হিসাব করা সম্ভব। প্রতিটি অবস্থাকে একেকটি ইভেন্ট বলে। 

প্রবাবিলিটি থিওরির মূল ধারণা হলো নানা রকম পরিবর্তনশীল অবস্থা একেক সম্ভাবনার ফলাফলে একেক রকম চেহারায় ধরা দেয়, যা কিছু সাধারণ গাণিতিক নিয়মে হিসাব করা অসম্ভব, এমন বিষয় প্রবাবিলিটি থিওরি কাজে লাগিয়ে সমাধান করা সম্ভব। জুয়া খেলায় সম্ভাবনার সূত্র হিসেবে একে কাজে লাগানো যায়, যা সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে অনির্ধারিত সম্ভাবনাকে হিসাব করে বের করতে পারে। কিন্তু কোনো জুয়াড়ির পক্ষে গেম থিওরির হিসাব করে চাল দেওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ, চিন্তাটা মাথার ভেতরে গুছিয়ে আনতে একজন সাধারণ মানুষের যতটা সময় লাগবে, পরবর্তী চাল দেওয়ার জন্য ততটা সময় তাকে দেওয়া হয় না।

ইলেকট্রনিক স্লট মেশিন থেকে শুরু করে রুলেট, পোকার বা ব্ল্যাকজ্যাক, এমনকি লটারির ক্ষেত্রেও সম্ভাবনাকে হিসাব করে বের করা সম্ভব। সে কারণে ইলেকট্রনিক মেশিনগুলোতে নিজেদের ইচ্ছেমতো বানানো সফটওয়্যারের সাহায্যে ‘পে ব্যাক’ ও ‘পে আউট’ এমনভাবে সাজানো আছে যে কয়েক দানে জুয়াড়ির লাভ হলেও লম্বা সময়ে লাভ হবে ক্যাসিনোর। জুয়াড়িরা যত টাকা সেখানে লগ্নি করবে, একটা লম্বা সময়ের মধ্যে তারা সে টাকার ৯০ শতাংশ ফেরত পাবে। অর্থাৎ লাভের অংশীদার বরাবর ক্যাসিনোই। আপাতদৃষ্টে মানুষের কাছে যা অনিশ্চিত বা ভাগ্যের যোগ, ক্যাসিনোর মেশিনের কাছে তা হতে পারে নিশ্চিত গাণিতিক সমাধান। তাই বলা যায়, এক বা দুই সপ্তাহে একজন জুয়াড়ি প্রচুর লাভ করতে পারে, যা তাকে আরও বেশি জুয়া খেলায় উদ্বুদ্ধ করবে। কিন্তু বছরজুড়ে প্রতি সপ্তাহে যদি সে একই ক্যাসিনোতে যায় তবে ধীরে ধীরে তার লাভ কমতে কমতে শেষে শূন্য হয়ে একসময় ক্ষতির দিকে গড়াতে পারে।

বিজ্ঞান দূরত্ব ঘুচিয়েছে। স্মার্টফোনের আবির্ভাবে অনেকের জন্য জুয়া খেলায় অংশ নিতে ক্যাসিনোতে উপস্থিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। জাত জুয়াড়ি ছাড়াও যে মানুষেরা নিয়মিত ক্যাসিনোর চৌকাঠ মাড়াত না, তারাও এখন দিনে বারবার অনলাইন ক্যাসিনোর বাজিতে অংশগ্রহণ করতে পারে। এখন কথা হলো, অনলাইনে পোকার বা ব্ল্যাকজ্যাক খেলতে খেলতে প্রবাবিলিটি সূত্র ব্যবহার করে খেলার পদ্ধতি আর কৌশল সম্পর্কে তাদের বিস্তারিত ধারণা গড়ে উঠতে পারে, সত্যিকারের ক্যাসিনোয় উপস্থিত হয়ে অচেনা পরিবেশ আর খেলার রহস্যের প্রতি ভয়ও কেটে যেতে পারে, কিন্তু সেই জ্ঞান আর স্মার্টফোন তাকে পল নিউম্যানের মতো পোকার ফেস তৈরি করতে সাহায্য করবে না, ড্যানিয়েল ক্রেগের মতো নির্লিপ্ত চোখে তাকাতে শেখাবে না, যা আসলে শিল্পই, গণিত বা বিজ্ঞান নয়। 

অনলাইনে জুয়া
ভাবা হয়েছিল অনলাইন গেমিং সাইটের জনপ্রিয়তা হয়তো সত্যিকারের ক্যাসিনোয় মানুষের উপস্থিতি কমিয়ে দেবে। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য, নিউইয়র্ক টাইমস ও গার্ডিয়ান পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে ইউরোপ, আমেরিকা আর হংকং, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের ক্যাসিনোয় উপস্থিতি ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে। 

ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের ছোট্ট দুই দ্বীপরাষ্ট্র অ্যান্টিগা ও বারবুডা ১৯৯০ সালে প্রথম উন্মুক্ত ব্যবসায়িক এলাকা হিসেবে অনলাইনে জুয়ার ব্যবস্থা চালু করে। তাদের বানানো সাইটে প্রধানত আমেরিকার নাগরিকেরা ঘোড়দৌড়ের ওপরে বাজি ধরত। এরপর ১৯৯৪ সালে মাইক্রো গেমিং কোম্পানি জুয়ার জন্য উপযুক্ত সফটওয়্যার তৈরি করে। ১৯৯৫ সালে সারা পৃথিবীতে গোপনে এবং নির্বিঘ্নে অর্থ চালান করার জন্য ক্রিপটোলজিক কোম্পানি মানি ট্রানজেকশন সফটওয়্যার বানায়। অনলাইন গেমিংয়ের বাজারে দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। প্রতিদিন নতুন নতুন ধরনের জুয়ার সফটওয়্যার ও সাইট তৈরি হতে থাকে। সারা পৃথিবীতে এখন তিন হাজারের বেশি অনলাইন জুয়ার সাইট রয়েছে। অন্তত ৫০০ কোম্পানির মাধ্যমে সাইটগুলো পরিচালিত হয়। এদের মধ্যে কিছু কিছু পাবলিক কোম্পানি, যাদের শেয়ার কেনাবেচাও চলে। ছয় বছর ধরে অনলাইন জুয়ার মার্কেটের বৃদ্ধির হার প্রায় ২০ শতাংশ।

অনলাইন জুয়া সমাজে উল্লেখ করার মতো যে পরিবর্তন এনেছে তা হলো, যে মানুষ কোনো দিন ক্যাসিনোয় যেত না, সে-ও বাড়িতে বসে জুয়া
খেলতে পারছে। টাইম ম্যাগাজিনের রিপোর্ট অনুযায়ী, গত দশকে এশিয়ায় নারী জুয়াড়ির সংখ্যা উচ্চ হারে বেড়েছে। 

জুয়ার নেশা
পুঁজিবাদের অবাধ বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের কিছুসংখ্যক মানুষের হাতে বৈধ এবং অবৈধ উপায়ে যে অঢেল অর্থ এসে পড়ছে, তা ব্যবহার করার জন্য ক্যাসিনো উপযুক্ত স্থান। কিছু মানুষের মধ্যে তাই জুয়ার ব্যাপারে একরকমের ঘোর তৈরি হয়েছে, যাকে সরাসরি ক্যাসিনো সংস্কৃতির ফল বলে চিহ্নিত করা যায়।

আমেরিকান সোশিওলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের একসময়ের প্রেসিডেন্ট ও সমাজবিজ্ঞানী আরভিং গফম্যান জুয়া খেলায় জড়িত মানুষের মনস্তত্ত্ব এবং ব্যবসার সামাজিক অবস্থান নিয়ে হয়্যার দ্য অ্যাকশন ইজ (১৯৬৭) বইটি লেখার জন্য ছদ্মবেশে লাস ভেগাসে ক্যাসিনো ডিলার হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। তাঁর লেখা বইয়ে এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, দোতলা ক্যাসিনোর নিচের তলায় সরগরম পরিস্থিতির মধ্যে ওপরের তলায় আগুন লেগেছে। ওপর তলার মানুষেরা ছোটাছুটি করে নিচে নেমে পড়েছে, কেউ জানালা দিয়ে দিয়েছে ঝাঁপ, ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা এসে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে, একপর্যায়ে সিঁড়ি বেয়ে আগুন নিচে নেমে আসছে অথচ নিচের তলায় রুলেট বা ব্ল্যাকজ্যাকের চারদিকে ঘিরে থাকা মানুষেরা এতটুকু নড়েনি। উত্তেজিত এবং দৌড়াতে থাকা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের দিকে সামান্য তাকিয়ে নিয়েই তারা খেলায় মনোযোগী হয়েছে। এই দৃশ্যের বর্ণনার মধ্য দিয়ে জুয়ার টেবিলে খেলোয়াড়ের ঘোরের মাত্রাটা টের পাওয়া যায় এবং তা চমকে দেওয়ার মতো। আমাদের সমাজেও ক্যাসিনো–সম্পর্কিত যে ঘোর দেখা যায় তা নতুন নয়, অনেক পুরোনো।

বহু ঘটনা থেকে বলা যায়, জুয়ার নেশা যাকে আঁকড়ে ধরে তার জন্য সেটা ছাড়া কঠিন। জিতলে মনে হয় আবার বাজি ধরলেও সে সহজেই জিতবে। ফলে সেই সৌভাগ্যকে সে নিজের করে পেতে চাইবে না কেন। আর হারলে মনের মধ্যে পরেরবার জেতার জন্য সংকল্প তৈরি হয়। সংকল্প থেকে তৈরি হয় জেদ এবং এর পেছনে কোনো যুক্তি থাকে না। নেশাগ্রস্ত জুয়াড়ি এভাবে সর্বস্বান্ত হয়ে গেলেও জুয়ার টেবিলে বসা ছাড়তে পারে না। জিতে গিয়ে ভাগ্য খুলে যাওয়ার ক্ষীণ আশা থেকে সে কখনো মুক্ত হতে পারে না। এভাবেই ‘প্যাথলজিক্যাল গ্যাম্বলার’ হয়ে ওঠে। 

একসময় আমাদের সমাজে মাদকের উপস্থিতি এত ব্যাপক হারে এবং এত বিচিত্র উপায়ে বিস্তৃত ছিল না। তাই তখন মাদকে আসক্তির কথাও শোনা যেত কম। সমাজ বদলেছে, মাদকের সহজলভ্যতায় নেশায় আক্রান্ত হয়েছে বহু মানুষ। পরবর্তীকালে নেশাগ্রস্ত মানুষকে জীবনের দিকে ফিরিয়ে আনার জন্য তৈরি হয়েছে চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা। জুয়ার ক্ষেত্রেও একই বিষয় হতে পারে। একসময় হয়তো প্যাথলজিক্যাল গ্যাম্বলারদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র চালু হবে। 

জেমস বন্ড সিরিজের ছবি ক্যাসিনো রয়্যাল–এর একটি দৃশ্য
জেমস বন্ড সিরিজের ছবি ক্যাসিনো রয়্যাল–এর একটি দৃশ্য

জুয়ার আয়-ব্যয়
সরকারি এবং বেসরকারি বহু হিসাবেই এটা স্পষ্ট যে ক্যাসিনো ব্যবসা লাভজনক, তা আমেরিকা, এশিয়া বা অস্ট্রেলিয়ায় যেখানেই হোক না কেন। অর্থনীতিবিদ ও টেক্সাসের বেইলর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর্ল এল গ্রিনোলস তাঁর লেখা গ্যাম্বলিং ইন আমেরিকা: কস্ট অ্যান্ড বেনিফিট (২০০৪) বইয়ে ক্যাসিনো বা জুয়ায় খরচ এবং আয়ের এক তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। সেখানে তিনি বার্ষিক হিসাবে মাথাপিছু সামাজিক খরচের তালিকা তুলে এনেছেন; বিবাহবিচ্ছেদ, ফেলে যাওয়া সন্তানের ভরণপোষণ, মানসিক চাপের কারণে কাজে অনুপস্থিতিজনিত ও চিকিৎসা ব্যয় এবং চাকরিচ্যুত হওয়া থেকে শুরু করে আত্মহত্যাজনিত ব্যয় এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত। তাঁর গবেষণায় দেখা গেছে, নেভাদা অঞ্চলে কোনো এক নির্দিষ্ট সময়ে ক্যাসিনোতে জুয়া খেলে একজন যে অর্থ খরচ করেছে, তার তুলনায় আয় করেছে অনেক কম। বছরে ক্যাসিনো থেকে প্রাপ্তবয়স্কদের মাথাপিছু আয় হয়েছে যেখানে ৩৪ ডলার, সেখানে খরচ হয়েছে ১৮০ থেকে ২৮৯ ডলার। তাই ক্যাসিনো যে সব সময় রাষ্ট্রের জন্য লাভজনক ব্যবসা, তা বলা কঠিন।

পুঁজিবাদের অনুষঙ্গ ক্যাসিনো
ক্যাসিনোকে চমৎকার হোটেল বা স্পোর্টস ক্লাবের আদলে সাজানো সম্ভব, কিন্তু ক্যাসিনো তো ক্যাসিনোই, যা মানুষের মনে জ্যাকপট জয়ের ক্ষীণ আশা জোগাবে, মানুষকে কর্মবিমুখ করে তুলবে, মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার পরিশ্রমের সঙ্গে সম্পর্কহীন হয়ে পড়বে আর হারিয়ে যাবে সামাজিক মূল্যবোধ। আর্ল এল গ্রিনেলস সফলভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতি চিহ্নিত করেছেন কিন্তু ক্যাসিনোতে মানুষ যা হারায় তা কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং নৈতিক। যেখানে মানুষ নীতি হারিয়ে নীতিভ্রষ্ট ও জীবনযাপনের দিকনিশানা হারিয়ে মূল্যবোধহীন হয়ে পড়ে। ইনডিসেন্ট প্রপোজাল চলচ্চিত্রে আমরা দেখেছি, ক্যাসিনোর খেলায় বাজি ধরতে ধরতে সর্বস্ব হারিয়ে একজন নিজের স্ত্রীকে বাজিতে চড়ায় এবং সেই খেলায় হারে। তবে এত কিছুর পরও ক্যাসিনো কিছুতেই সামাজিক বা অর্থনৈতিক দুর্নীতিচর্চার উল্লেখযোগ্য স্থান বা উপায় নয়।

বাংলাদেশের জন্য ক্যাসিনো কেবল একটি ক্ষেত্র, যার মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের দেশের নাগরিকদের শিকারে পরিণত করা সম্ভব। এখানে দুর্নীতিকে যদি একটি ব্যাধি হিসেবে ভাবা হয়, তবে ক্যাসিনো তার উপসর্গমাত্র। ক্যাসিনোর উপস্থিতি এটুকুই নিশ্চিত করে যে দেশটিতে অবৈধ উপায়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয়ের পথ উন্মুক্ত আছে। প্রাসঙ্গিকভাবে এটা বলা যায় যে সারা পৃথিবীতে যখন বিশ্বায়নের সংস্কৃতি অগ্রগণ্য, প্রযুক্তির উৎকর্ষ প্রত্যাশিত, সেখানে তারই অংশ এবং অনুসরণকারী হয়ে বাংলাদেশের পক্ষে এর বাইরে থাকা সম্ভব নয়। তাই নব্য পুঁজিবাদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক, দুটো দিকই বাংলাদেশের নাগরিকদের ক্রমে প্রত্যক্ষ করতে হবে বলে ধারণা করা যায়। সমাজে যখন বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ আয়ের বিশাল অঙ্ক গুটিকতক সুবিধাভোগী এবং ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা মানুষের কাছে কেন্দ্রীভূত হয়, তখন ক্যাসিনোর মতো ব্যবসার উদ্ভব স্বাভাবিক ঘটনা। কারণ, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করা তাদের অঢেল অর্থ খরচ করা তথা বিনোদনের জন্য সুনির্দিষ্ট খাতের প্রয়োজন পড়ে। তাই যত দিন রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় দুর্নীতির বিস্তার ঠেকানো না যাবে, তত দিন ক্যাসিনোর মতো ব্যবসাকেও কিছু অভিযানের ভয় দেখিয়ে ধামাচাপা দিয়ে রাখা অসম্ভব। উপরন্তু, দুর্নীতিবাজ ও নব্য ধনী এই শ্রেণির ব্যবসা ও বিনোদন কেড়ে নিলে গোপনে নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে কিংবা সময়ে সমাজে বৃহত্তর অরাজকতার ঝুঁকি বাড়বে। 

বাংলাদেশের সমাজ পরিবর্তনশীল সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন রকম সামাজিক, নৈতিক কিংবা রাজনৈতিক পরিবর্তন দ্রুত হলেও বিবর্তনের এই ধাপগুলো সাধারণত দীর্ঘ হয়। এই প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী তার অতীতের মূল্যবোধ প্রতিস্থাপন করে নতুন মূল্যবোধের সঙ্গে জীবন যাপন করতে শেখে। এই বিবর্তনে প্রজন্মের পর প্রজন্মও পেরিয়ে যেতে পারে। পৃথিবীর ইতিহাসে বহু স্থানে পরিবর্তনশীল এই সময়টিতে নানা রকমের দুর্নীতির আবির্ভাব, ব্যক্তিগত অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি, দেহব্যবসা ও মাদকের প্রসার, জুয়ার সংস্কৃতি এবং জাতির ভেতরে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে সম্মিলিতভাবে অপরাধপ্রবণতার সমস্যা দেখা যায়। যেহেতু সমাজে বহু বছরের লালিত মূল্যবোধের উপস্থিতি তখনো ক্ষেত্রবিশেষে প্রকট থাকে, তাই এ রকম সময়ে মানুষ সহজে অপরাধে জড়িয়ে পড়লেও সামাজিকভাবে তা প্রকাশ করতে পারে না। অপরাধবিজ্ঞানের ধারণা অনুযায়ী, একটি অপরাধ ঢাকতে গিয়ে সে নতুন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের মতো ছোট এবং অর্থনৈতিকভাবে অসামঞ্জস্যপূর্ণ জনগোষ্ঠীর দেশে তাই সংগত কারণেই ক্যাসিনোর উদ্ভব হয়েছে, যেখানে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ সহজে ওড়ানো যায়। 

তবে প্রাথমিক আলোচনায় ফিরে গিয়ে এই প্রশ্ন আবারও তোলা যায় যে পুঁজিবাদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে কি সাধারণভাবে ঝুঁকিকে পুঁজি করে ব্যবসার আয়োজন কখনো বন্ধ ছিল? পৃথিবীর নানা দেশের মতো বিমা পলিসি এখানে জনপ্রিয় ব্যবসা। বিমা আরম্ভ হয়েছিল আগুনে পোড়া এবং পানিতে ডুবে যাওয়ার ক্ষতিপূরণের ধারণা থেকে। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই ব্যবসা প্রতিটি জিনিসের, এমনকি মানুষের জীবনেরও মূল্য নির্ধারণ করেছে। বহু বছর ধরে এখানে সরকারিভাবে লটারি এবং প্রাইজবন্ডের চল আছে। আমেরিকা যেমন ক্যাসিনোর আয় দাতব্য প্রতিষ্ঠানে ব্যয় করে, লটারির টিকিট বিক্রির অর্থও তেমনি চক্ষু হাসপাতাল গড়ার মতো জাতীয় কাজে ব্যয় হয়েছে। এ ছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিভিন্ন মেলায় ছোটখাটো জুয়ার আয়োজন থাকে। অন্যদিকে বড় প্যান্ডেল খাটিয়ে হাউজি খেলা আশির দশকে সাধারণ ব্যাপার ছিল। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে ১৮৬৭ সালের প্রাচীন জুয়াবিরোধী আইনটি সামান্য পরিবর্তন করে ১৯৭৬ সালে ঢাকা এবং পরে ১৯৭৮ সালে দেশের সব বড় শহরকে এর আওতামুক্ত করা হয় এবং এর ফলে নির্বিঘ্নে হাউজি খেলার সুযোগ তৈরি হয়। জেলা শহরগুলোতে তখন সরকারি অফিসারদের ক্লাবে নিয়মিত হাউজির আয়োজন হতো, যা একটি বিশেষ সংস্কৃতি তৈরি করেছিল। আনন্দ ও বিনোদনের অংশ হিসেবে তারা পরিবারসহ অংশগ্রহণ করত।

পরিবর্তনশীল সমাজে প্রতিযোগিতার প্রভাব সমাজের প্রতিটি স্তরেই এই মানসিকতার বিস্তৃতি ঘটে। তাই রাস্তায় রাস্তায় জুয়ার ছোট ছোট আসর বা জটলা রাজধানীসহ প্রায় সারা দেশেই দেখতে পাওয়া যায়। দিনমজুর বা রিকশাওয়ালাদেরও গত ক্রিকেট বিশ্বকাপের সময়ে বনানী, গুলশান এলাকায় রাস্তার ধারে ধারে জটলা করে খেলা নিয়ে বাজি ধরতে দেখা গেছে। 

মুসলিম দেশে জুয়া
পৃথিবীতে অনেক মুসলিম দেশে এবং যে দেশের ট্যুরিস্ট হিসেবে মুসলিমরা প্রধান, এমন অনেক দেশে জুয়া জনপ্রিয় ও লাভজনক ব্যবসা। সরকারি নীতিমালা অনুসারে এগুলো পরিচালিত হয়। গ্লোবাল গেমিং বিজনেস ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ষাট ও সত্তরের দশকে লন্ডনের সবচেয়ে অভিজাত ক্যাসিনোগুলোর মূল খদ্দের ছিল নতুন পেট্রোডলার হাতে পাওয়া আরবের লোকজন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত লন্ডনের ক্যাসিনোগুলোর সবচেয়ে নামকরা জুয়াড়িরা আরবের মুসলিম। মিসরে ১৪টি বড় ক্যাসিনো আছে, এগুলোর মোট বার্ষিক আয় ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। এই ক্যাসিনোগুলো বিভিন্ন পাঁচ তারকাবিশিষ্ট হোটেলে অবস্থিত। এসব ক্যাসিনোতে মিসরের জনগণের ঢোকার অনুমতি নেই। ক্যাসিনোতে প্রবেশের জন্য বিদেশি পাসপোর্ট উপস্থাপন করতে হয়। তবে মিসরীয়দের মধ্যে যাঁদের দ্বিতীয় দেশের জাতীয়তা এবং পাসপোর্ট আছে, তঁারা প্রবেশ করতে পারেন। ধর্ম সেখানে ক্যাসিনো পরিচালনা এবং খেলায় অংশগ্রহণের পথে কোনো বাধা নয়। তবে জুয়াড়ি খেলার মাধ্যমে যে অর্থ উপার্জন করে, দিন শেষে তার ওপরে ৫০ শতাংশ কর হিসেবে দিতে বাধ্য।

মরক্কোতে সাতটি এবং তিউনিসিয়ায় তিনটি ক্যাসিনো আছে। সেখানেও মিসরের মতোই বিদেশি পাসপোর্ট থাকলেই কেবল প্রবেশ করা যায়। তবে করের বিষয়টি নির্ভর করে উপার্জিত আয়ের পরিমাণের ওপর। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে পুরোনো ক্যাসিনোর নাম ‘ক্যাসিনো দে লিবান’, ১৯৫৯ সালে লেবাননের রাজধানী বৈরুতের ২০ কিলোমিটার উত্তরে এই ক্যাসিনো গড়ে ওঠে। মাঝে নানা কারণে ১০ বছর ক্যাসিনোটি বন্ধ ছিল। ১৯৯৬ সালে এটি আবার চালু হয়েছে। ২০১৭ সালে এর আয় ছিল ১৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার ৫০ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হয়েছে। এটি একটি পাবলিক কোম্পানি এবং এখানে ১ হাজার ৪০০ কর্মচারী রয়েছে। শুধু বেতন খাতেই এই ক্যাসিনো ৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে। 

সাইপ্রাস, যাকে বলে টার্কিশ রিপাবলিক অব নর্দান সাইপ্রাস বা জর্জিয়া, সেখানে ক্যাসিনো আছে ২৫টি। প্রধানত তুরস্ক, আজারবাইজান ও ইরানের পর্যটকেরা এই ক্যাসিনোগুলোতে নিয়মিত হাজির হয়। তুরস্কে ১৯৯০ সালে প্রথম ক্যাসিনো স্থাপিত হয়। তা ছাড়া প্রায় প্রতিটি রেস্তোরাঁয় ইলেকট্রনিক স্লট মেশিন ছিল। সাবেক প্রেসিডেন্ট সুলেমান ডেমিরেল লটারি ছাড়া যাবতীয় জুয়ার আড্ডা নিষিদ্ধ করেন। তাই তুরস্কের লোকেরা এখন জুয়ায় অংশ নিতে চাইলে সাইপ্রাসে চলে যান।

ভূমধ্যসাগরীয় যুদ্ধের আগে ইরাকে ক্যাসিনোর রমরমা ব্যবসা ছিল। বাগদাদের শেরাটন হোটেলে ছিল সবচেয়ে বড় ক্যাসিনো এবং বিদেশি ও ইরাকি সবারই প্রবেশাধিকার ছিল। যুদ্ধের পর ক্যাসিনোটি এখন বন্ধ হয়ে গেছে। ইরানের তেহরানে শাহ রেজা পাহলভির আমলে ক্যাসিনো স্থাপিত হয়েছিল। বিদেশি এবং ইরানিদেরও সেখানে খেলার অনুমতি ছিল। ক্যাসিনোটি সেই সময়ে অত্যন্ত লাভজনক এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ১৯৭৮-এর ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে ক্যাসিনোটি বন্ধ আছে।

মালয়েশিয়ার জেনটিং হাইল্যান্ডস মূলত ক্যাসিনো ব্যবসার জন্য বিখ্যাত। সেখানে প্রচুর ক্যাসিনো রয়েছে, যা মালয়েশিয়ার আয়ের বড় উৎস। এই ক্যাসিনোগুলো সারা পৃথিবীর সব ধর্মের এবং জাতীয়তার লোকের জন্য উন্মুক্ত। তবে মালয়েশিয়ার মুসলিমরা এখানে প্রবেশাধিকার পান না। মালয়েশীয় মুসলিম ছাড়া অন্য জাতীয়তার মুসলিমদের প্রবেশে কোনো বাধা নেই। এখানে মূলত চীনা, এশিয়ার অন্যান্য দেশের অধিবাসী এবং মধ্যপ্রাচ্যের জুয়াড়িদের খেলতে দেখা যায়। জুয়ার আয়ের ওপরে উচ্চ হারে কর ধরা হয়। 

আফসানা বেগম: কথাসাহিত্যিক ও যুক্তরাজ্যের নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক

আগামীকাল: জুয়ার আর্থিক ও সামাজিক লাভ-ক্ষতি