সড়কের আগে বিআরটিএতে অভিযান চালান

>
সামছুল হক
সামছুল হক
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন দেশের নতুন সড়ক পরিবহন আইন ও তা কার্যকরের ক্ষেত্রে বিভিন্নমুখী সমস্যা নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া।

প্রথম আলো: নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর করার শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে। কেন? আইনটিকে বাস্তবসম্মত বলে মনে করেন কি?
সামছুল হক: নতুন আইনের প্রয়োগ নিয়ে যা হচ্ছে বা যে প্রতিক্রিয়া আমরা পেলাম, তা নতুন কিছু নয়। দীর্ঘদিন ধরে যেভাবে চলছে, তাতে সবকিছুই অবৈধ হয়ে গেছে। চালক অবৈধ, যানবাহন অবৈধ, রুট অবৈধ। সমস্যাটা একটা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এখন আইন কার্যকর করতে গেলে দেখা যাচ্ছে যে বৈধ জিনিসের সংখ্যা খুবই সামান্য। বৈধ টার্মিনাল নেই, বৈধ পার্কিং নেই, যানবাহনের সংখ্যার সঙ্গে মিলিয়ে প্রয়োজনীয় চালকও নেই। যাঁরা চালাচ্ছেন তাঁদের অনেকেরই বৈধ লাইসেন্স নেই। এই যে পরিস্থিতি এখানে এসে ঠেকেছে তার জন্য সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ বা কেউ কোনো দিন জবাবদিহির মুখে পড়েনি। অতীতে যেকোনো আইন প্রয়োগ বা কার্যকর কারার ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি পরিবহনমালিক ও শ্রমিকেরা গাড়ি বন্ধ করে দিয়েছেন। এরপর সরকার সরে এসেছে। এবারও দেখলাম আইন কার্যকর করার দিন গাড়ি উধাও। অঘোষিত ধর্মঘট। 

প্রথম আলো: এটা সত্যিই যে সড়কে শৃঙ্খলা আনতে বিভিন্ন সময়ে ট্রাফিক পুলিশ, সিটি করপোরেশন বা বিআরটিএ নানা উদ্যোগ নিয়েছিল এবং এর একটিও কার্যকর করতে পারেনি। কেন পারেনি বা পারছে না। 

সামছুল হক: আপনার এবং পাঠকদের অনেকেরই মনে থাকার কথা যে গত এক বছরে নানা কিছু কার্যকর করার চেষ্টা হয়েছে। ভাড়া–নৈরাজ্য বন্ধে বিআরটিএ অভিযান চালিয়েছে, পুলিশ বলেছিল বাসের দরজা বন্ধ থাকতে হবে, লেগুনা চলতে দেওয়া হবে না। কিছু রাস্তায় রিকশা বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এমন আরও কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল এবং এর একটিও কার্যকর করা যায়নি। এবার সড়ক আইন কার্যকর করার শুরুতে সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল কাভার্ড ভ্যানের মালিক-শ্রমিকদের তরফে। এই বাহনগুলো পুরো অবৈধ। বিআরটিএর রেজিস্ট্রেশন ছাড়া এগুলোর কোনো বৈধতা নেই। কারণ মূল বাহনটিকে অবৈধভাবে পরিবর্তন করে এগুলো বানানো হয়েছে। এই অবৈধ বাহনগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে দীর্ঘদিন বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। দেশে এ ধরনের কাভার্ড ভ্যানের সংখ্যা এখন প্রায় ২২ হাজারে এসে ঠেকেছে। এর সঙ্গে এখন আমদানি-রপ্তানি জড়িয়ে গেছে। অনেক অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে এই খাতে। এখন এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন কীভাবে? এ জন্য তো বিআরটিএ–কে ধরা উচিত। দায় তো তাদের। ঢাকা শহরের কথা যদি বিবেচনায় নিই, একটি শহরে যথাযথ পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলতে যা যা দরকার, অনেক কিছুই নেই। শহরে বাস টার্মিনাল থাকার কথা তা নেই, লে ওভার টার্মিনাল থাকার কথা, তা নেই। শহরে ট্রাক প্রবেশ করে, কিন্তু কোনো ট্রাক টার্মিনাল নেই। রাজউক এগুলো রাখেনি। নতুন শহর পূর্বাচল হচ্ছে সেখানেও নেই। এ রকম একটি অবস্থায় আপনি কোনো আইন কার্যকর করবেন কীভাবে। সিটি বাস শহরের বিভিন্ন রাস্তায় পার্ক করা থাকে, আপনি যদি সেই বাসকে আটক করতে যান এবং চালক বা মালিক যদি জিজ্ঞেস করেন বাস রাখব কোথায়। তখন আপনি কী জবাব দেবেন। 

প্রথম আলো: নতুন সড়ক আইনের কোনো ধারাকে অবাস্তব বলে মনে হয় কি?
সামছুল হক: আইনটি যুগোপযোগী। আইনের কোথাও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ব্যবস্থার মধ্যে অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে। দেশে ভারী যানবাহনের সংখ্যার তুলনায় চালক নেই। বিআরটিএ গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দিয়েছে কিন্তু চালক আছে কি না, সেদিকে তাঁর নজর নেই। দুটো দেখার দায়িত্বই তাদের। সড়ক আইন কার্যকর করার পাশাপাশি বিআরটিএকে ধরা উচিত চালকের সংখ্যা বিবেচনায় না নিয়ে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার জন্য। হালকা বাহনের লাইসেন্স নিয়ে চালকদের ভারী গাড়ি চালাতে হচ্ছে। ফলে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। লাইসেন্স হালনাগাদ করার জন্য এখন আগামী বছরের জুন পর্যন্ত সময় দেওয়া হচ্ছে। বিআরটিএর কাছে যানবাহনের সংখ্যার যেমন হিসাব আছে, তেমনি চালকদের সংখ্যাও জানা। এর মধ্যে সমন্বয়ের কোনো উদ্যোগ কেন তারা নেয়নি? প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বাস-ট্রাকে বাহনপ্রতি দুজন চালক থাকতে হবে। তা কার্যকর করতে উদ্যোগ কই। সড়কে অভিযান চালানোর আগে তো বিআরটিএতে অভিযান চালানো উচিত। 

প্রথম আলো: পরিবহনমালিক-শ্রমিকের পক্ষ থেকে দুর্ঘটনার মামলা জামিনযোগ্য করা, তদন্তে মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধি ও দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করার দাবি তোলা হয়েছে। এগুলো কতটা যৌক্তিক?
সামছুল হক: আমাদের দেশে চালকেরা অনেক ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালান। দুর্ঘটনার মামলার তদন্ত অবশ্যই নিরপেক্ষভাবে করা উচিত। এখানে পুলিশ বা মালিক-শ্রমিক কোনো পক্ষের যুক্ততাই যথাযথ নয়। দুর্ঘটনার তদন্ত একটি জটিল প্রক্রিয়া। ধরুন একজন চালক নিয়ম মেনে তাঁর বাস বা ট্রাক চালাচ্ছেন, সামনে হুট করে একটি নছিমনের মতো বাহন এসে পড়ল বা একজন পথচারী নিয়ম না মেনে রাস্তায় এসে পড়ল এবং একটি দুর্ঘটনা ঘটল। এর দায় কোনোভাবেই চালকের নয়। কিন্তু সাধারণভাবে দায়টি চালকের ওপর এসে পড়ে এবং চালক অন্যায়ের শিকার হন। 

প্রথম আলো: আপনি বিআরটিএর ব্যর্থতার কথা বললেন। কিন্তু এর যা লোকবল তা দিয়ে কি পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব?
সামছুল হক: বিআরটিএর বর্তমান লোকবল ও তাদের যে দক্ষতা তা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। বিআরটিএর বড় প্রাতিষ্ঠানিক ঘাটতি রয়েছে। এর লোকবল ও সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। একটি গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট দিতে হলে সেই গাড়ির ৪০ থেকে ৬০টি জিনিস দেখতে হয়। বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ কি তা আদৌ দেখতে পারে? আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি যে ফিটনেস সার্টিফিকেট আছে এমন অনেক গাড়ির মাইলো মিটার ঠিক নেই। সারা দেশে মাত্র ১০০ জন ইন্সপেক্টর আছে। এই লোকবল দিয়ে এত যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা কীভাবে সম্ভব? আন্তর্জাতিক নিয়ম হচ্ছে একজন চালককে লাইসেন্স দেওয়ার আগে অন্তত ৩৫ মিনিট টানা গাড়ি চালিয়ে সক্ষমতার প্রমাণ দিতে হয়। অথচ আমাদের দেশে যে পদ্ধতিতে ছোট জায়গায় পরীক্ষা নেওয়া হয়, তা চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক। এই প্রতিষ্ঠানের লোকবল বৃদ্ধি ও দক্ষতা–যোগ্যতা বাড়ানোর জন্য জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নেওয়া উচিত। 

প্রথম আলো: নতুন সড়ক আইন বাস্তবায়ন কি তবে অকার্যকরই থেকে যাচ্ছে?
সামছুল হক: বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা দেখছি সরকার পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে সমঝোতার পথ ধরছে। আর সরকারের কর্তাব্যক্তিরা তো আইনের ঊর্ধ্বে। তঁারা উল্টো পথে গাড়ি চালালেও কিছু হয় না। ট্রেড ইউনিয়নের বাইরে যাঁরা আছেন, অর্থাৎ সাধারণ জনগণ, তাদের ওপর আইন প্রয়োগের চেষ্টা হবে। প্রাইভেট গাড়ির মালিক-চালক বা পথচারীর ওপর প্রয়োগের চেষ্টা হবে। কিন্তু সেটাও টেকসই হবে না। রাস্তার ফুটপাত ঠিক না থাকলে বা জেব্রাক্রসিং না থাকলে লোকজন বিশৃঙ্খলভাবে চলাচল ও রাস্তা পার হবেই। 

প্রথম আলো: কিন্তু শুরুটা তো করতে হবে। কোথা থেকে বা কীভাবে শুরু করা যায়?
সামছুল হক: শুরু করতে হলে ঘর থেকে শুরু করতে হবে। আগে বিআরটিসির বাসগুলোকে ধরুক। এই বাসগুলোর ফিটনেস আছে কি না, সেগুলো আগে দেখা হোক। চালকদের লাইসেন্স ঠিক করা হোক। বিআরটিসির বাস লিজে দেওয়ার সুযোগ নেই। সেগুলো বন্ধ করা হোক। সরকারি গাড়িগুলোকে নিয়মকানুনের মধ্যে আনা হোক। অবৈধ পার্কিংয়ের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা রয়েছে, তা সব সরকারি অফিসের সামনে পার্ক করা কর্মকর্তাদের গাড়ির বিরুদ্ধে নেওয়া হোক। কোনো আমলা বা ভিআইপি যাতে উল্টো পথে চলতে না পারে তা নিশ্চিত করা হোক। নতুন আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে এটা একটা পথ হতে পারে। একই সঙ্গে অন্য যে কাজগুলো করতে হবে তা হচ্ছে জরুরি ভিত্তিতে সিটি বাস টার্মিনাল ও ট্রাক টার্মিনাল তৈরির উদ্যোগ নেওয়া, বাস রুটে শৃঙ্খলা এনে ফ্র্যাঞ্চাইজির মাধ্যমে তা পরিচালনা করা, সিগন্যাল ব্যবস্থা ঠিক করার উদ্যোগ নেওয়া ও ফুটপাতগুলোকে চলার উপযোগী করা। এগুলো খুব বড় ও কঠিন কাজ নয়। 

প্রথম আলো: দেশের পরিবহন খাত নিয়ে সামগ্রিকভাবে সরকারের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
সামছুল হক: কোনো কিছু অবৈধ হলে তার বিরুদ্ধে শুরু থেকেই ব্যবস্থা নিতে হয়। সেটা করতে না পারলে জনগণ এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে, তখন ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়। আমরা তা করতে পারিনি, পরিস্থিতি এখন এই জায়গায় এসে পৌঁছেছে। যেকোনো দেশেই পরিবহনব্যবস্থা একটি জটিল বিষয় এবং অব্যাহতভাবে এই খাতে কাজ করে যেতে হয়। রাজনৈতিকভাবে আমাদের প্রাধান্য ঠিক করতে হবে। বড় বড় প্রজেক্ট নয়, এই খাতে সংস্কার দরকার। একে জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখতে হবে। বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান অনেকটাই করা গেছে কারণ, বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছে। সড়ক পরিবহনব্যবস্থা ও খাতকেও এখন সেভাবেই দেখতে হবে। সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন। তাঁর কাঁধে সাংগঠনিক গুরুদায়িত্ব রয়েছে। এত বড় একটি দলের দায়িত্ব সামলে এই মন্ত্রণালয় চালানো কঠিন কাজ। এই মন্ত্রণালয় পুরো অখণ্ড মনোযোগ দাবি করে। এই অবস্থায় এই মন্ত্রণালয়ে একজন প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়ার কথা সরকার বিবেচনা করে দেখতে পারে। 

প্রথম আলো: ধন্যবাদ।
সামছুল হক: ধন্যবাদ।