অগ্রহায়ণেই তাঁদের পৌষ মাস

গত ৫৫ বছরে অধীর আগ্রহে লাইনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে মানুষকে প্রতীক্ষা করতে দেখেছি আমি দুবার—প্রথমবার মধ্য ষাটের দশকে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত চলচ্চিত্র মহানগর-এর টিকিট ক্রেতাদের। স্টেডিয়ামের গেট থেকে লাইন চলে গিয়েছিল বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত। সম্ভবত শেষরাতে গিয়ে অনেকে টিকিট কাউন্টারে দাঁড়ান। তার ফলে সকালবেলা আমাকে গিয়ে দাঁড়াতে হয়েছিল নবাবপুর রথখোলার কাছে।

সে রকম দীর্ঘ লাইন একটি নয়, কয়েকটি দেখেছি সেদিন। এবারেরটি কোনো সিনেমার টিকিটের জন্য নয়, একটি কৃষিজাত পণ্যের জন্য। তার নাম পেঁয়াজ। পেঁয়াজ এমন এক আনাজ, যা দুনিয়ার সব দেশের প্রায় সব শ্রেণির মানুষ কমবেশি খায়। বাংলাদেশের যারা আইড় বা চিতল কিংবা রুই-কাতলার দোপেঁয়াজি খেতে পছন্দ করেন এবং গরুর গোশত হোক বা খাসি-মুরগির কারি যারা ভালোবাসে, তাদেরই শুধু পেঁয়াজ প্রয়োজন নয়। যারা মাসের মধ্যে কুড়ি দিন আলু-বেগুনভর্তা খায়, তাদেরও প্রতিদিন কিছু না কিছু পেঁয়াজ প্রয়োজন। চার সদস্যবিশিষ্ট পরিবারে আলুভর্তার জন্য ৫ তোলা পেঁয়াজ অন্তত চাই। সেই ৫ তোলা পেঁয়াজের দাম ১৬-১৭ টাকা।

এলাচ, লবঙ্গ, গোলমরিচ প্রভৃতি গরমমসলা মানুষ তোলা হিসাবে কেনে। পেঁয়াজ নরম মসলা। কিছুদিন আগেও এক পাউন্ড পেঁয়াজের যে দাম ছিল, এখন এক আউন্সের সেই দাম। অথচ সীমিত আয়ের মানুষের এই সময়ে এক টাকাও আয় বাড়েনি।

সর্বকালের সর্বদেশের সর্বোচ্চ দামে আজ পেঁয়াজ কিনছে বাংলাদেশের মানুষ। সেটা যেমন-তেমন রেকর্ড নয়। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। বঙ্গীয় নেতারা ঘরের মধ্যে সোফায় বসে বলেন এক কথা, মঞ্চে দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোনে বলেন অন্য কথা। কিছু কিছু শব্দ তাঁদের খুব প্রিয়। সেসব মুখস্থ বলেন। যেমন বাংলাদেশ আজ খাদ্যে ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’। কথাটা শতভাগ সত্য বলে বিবেচনা করা যেত, যদি চালই হতো বাংলাদেশিদের একমাত্র খাদ্য। চাল চিবিয়ে হোক, সেদ্ধ করে হোক, তা খেয়ে যদি আমরা বাঁচতাম, আমাদের কোনো কিছুই আমদানি করতে হতো না। কিন্তু চালের বাইরে আরও কিছু দানাদার শস্য এবং তরিতরকারি, মসলা ছাড়া আমাদের চলে না। সেগুলো আমদানি করতে হয়।

পৃথিবীর কোনো দেশই সব ধরনের খাদ্যশস্যে ও ভোজ্যদ্রব্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। কোনো না কোনো দ্রব্য প্রতিটি দেশকেই আমদানি করতে হয়। কিন্তু তার ফলে হঠাৎ কোনো জিনিসের দাম রাতারাতি মগডালে ওঠে না। কোনো দিন শোনা যায়নি যে কোনো দেশে কোনো জিনিসের দাম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৮-৯ গুণ বেড়ে গেছে। দ্বিগুণ হওয়ার ঘটনাই বিরল।

কোনো জিনিসের দাম বাড়ার একটা প্রচলিত রীতি চলে আসছে শত শত বছর যাবৎ। উৎপাদন ও সরবরাহ চাহিদার তুলনায় কম হলে জিনিসের দাম কিছু বাড়া স্বাভাবিক। বিক্রেতা সেই সুযোগটি নেন। কিন্তু যে মুহূর্তে শোনা গেল, একটি দেশ তার অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করেছে, মুহূর্তের মধ্যে সেই জিনিসের দাম পাঁচ-সাত গুণ বেড়ে যাওয়া অকল্পনীয়। খুচরা বিক্রেতাদের দোষ দেওয়া যাবে না। আমদানিকারক ও পাইকারি বিক্রেতারা নাটের গুরু। তাঁদের সঙ্গে সরকারের উচ্চতর পর্যায়ের ব্যক্তিদের বন্ধুত্ব নেই, এ কথা কেউ বিশ্বাস করে না। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে অক্লেশে বিনা বাধায় হাজার কোটি টাকা ডাকাতি হবে, কিন্তু তার ভাগ কেউ পাবে না, তা অবিশ্বাস্য।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর ৪৭ পেঁয়াজওয়ালাকে তাঁদের কার্যালয়ে পদধূলি দেওয়ার সবিনয় অনুরোধ করেছে। ৩৪১ জন নাকি তাদের দৃষ্টির সীমানায় রয়েছেন। এ খবর পেঁয়াজভোক্তাদের জন্য কম খুশির কথা নয়। এই পদধূলি ও নজরদারির পর পেঁয়াজের তোলা কত হবে, তা বাণিজ্যমন্ত্রী ২৪ নভেম্বর বলে দিয়েছেন। তিনি আমাদের মতো পেঁয়াজখেকোদের বলে দিয়েছেন, ‘আগামী ১০ দিনের মধ্যে পেঁয়াজ ৬০-৭০ টাকায় খুচরা বাজারে পাওয়া যাবে।’ কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সদয় ব্যবসায়ীরা বললেন, ‘আরও কম দামে মিলবে’ (এ কথা শুনে সাধারণ মানুষ বলছে, তাঁদের মুখে ফুল-চন্দন পড়ুক)। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী বললেন, ‘আমি ভয়ে ভয়ে একটু বাড়িয়ে বললাম।’

২৪ নভেম্বর থেকে ১০ দিন শেষ হবে ৫ ডিসেম্বর। আশা করি, বাংলার মানুষ ১০ দিন শেষ হওয়ার আগেই ৩২ টাকায় আমদানি করা পেঁয়াজ ৫০ টাকায় কিনতে পারবে। উঁচু আসনে যাঁরা বসেন, তাঁরা অসত্য কথা বলতে পারেন না। তাঁদের কথায় আস্থা ও বিশ্বাস না রাখা পাপ।

পেঁয়াজওয়ালাদের গোয়েন্দা দপ্তরে ডাকাডাকি ও নজরদারি প্রসঙ্গে একটি পুরোনো প্রবচন মনে পড়ল। এককালে আমাদের গ্রামগুলোর মাটির ঘরে সিঁধেল চুরি হতো। সিঁধ কেটে চোর ঘরে ঢুকলে গৃহকর্তা ঘুম থেকে জেগে চোরের ঠ্যাং ধরে ফেলতে চাইতেন। কিন্তু অনেক সময় দেখা যেত, ঠ্যাং না ধরে ধরেছেন চোরের লাঠি। ওদিকে চোর সিঁধ দিয়ে বেরিয়ে দৌড়ে পগারপার। পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র ঠ্যাং না ধরে ধরেছে লাঠি। ফলে জনগণের যত সর্বনাশই হোক, এই অগ্রহায়ণেই পেঁয়াজওয়ালাদের পৌষ মাস।

কাউকে না কাউকে দায়িত্ব নিতে হয়। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে সরে দাঁড়ানো ভালো। খালেদা জিয়ার প্রথম প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় ডালজাতীয় শস্যের দাম বাড়ে। তখন পরিকল্পনামন্ত্রী জহিরউদ্দিন খান কৃষকের সমালোচনা করেন। কৃষকের অবমাননায় আমি আহত হই। আমার কলামে পরিকল্পনামন্ত্রীকে রূঢ়ভাবে সমালোচনা করি। খালেদা জিয়াও তাঁকে তিরস্কার করেন। জহিরউদ্দিন খান ছিলেন সৎ ও সংস্কৃতিমান এবং আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ। তিনি তৎক্ষণাৎ পদত্যাগ করেন। মন্ত্রিত্ব তাঁর আয়ের উৎস ছিল না।

বাঙালি অপমানিত হয়ে পদচ্যুত হতে সংকোচ বোধ করে না, কিন্তু দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়ে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করাকে সে প্রাণত্যাগের সমান মনে করে। এই যে পেঁয়াজ নিয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে গেল, এর দায় কেউ নিলেন না। দেশে রাজনীতি নেই বলে কোথাও কোনো উত্তেজনাও নেই। বাঙালি যে কতটা সহিষ্ণু জাতি, তার প্রমাণ পাওয়া গেল। প্রখর রোদে ন্যায্যমূল্যে এক কেজি পেঁয়াজের জন্য হাজারো নারী-পুরুষ টিসিবির ট্রাকের প্রতীক্ষায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

সরকার কথিত জঙ্গি দমনে যতটা আগ্রহী, মজুতদার-মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে মৃদু ব্যবস্থা নিতেও তার শতভাগের এক ভাগ নয়। তার ফলে তারা যা খুশি তা-ই করতে পারে, যত দূর খুশি, তত দূর যেতে তারা পরোয়া করে না। পেঁয়াজ নিয়ে যে দুঃসাহসের পরিচয় তারা দিয়েছে, ভবিষ্যতে আরও অনেক পণ্যেই এর চেয়েও যে বড় কিছু ঘটাবে না, তার নিশ্চয়তা কী?

মজুতদারদের সিন্ডিকেটকে তোষণ করে পেঁয়াজের মতো যেকোনো পণ্য ভবিষ্যতে প্লেনে নয়, রকেটে আমদানি করলেও জনগণের ভোগান্তি দূর হবে না। কোনো সমস্যার গোড়াতে হাত না দিয়ে ডালপালা নিয়ে নাড়াচাড়া করে কোনো লাভ নেই। জিডিপির অংশ প্রতিদিন আওড়ালে রাষ্ট্রের আয় বাড়তে পারে, মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব হবে না।

জনবহুল দেশ। খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের অর্জন বিপুল। সে জন্য সরকারের কৃষি বিভাগের ভূমিকা যেমন রয়েছে, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের অবদানও বিরাট। কিন্তু সবচেয়ে বড় ভূমিকা আমাদের কৃষকের। তাঁরা ন্যায্যমূল্য পান না বলে অনেক পণ্য উৎপাদনে তাঁদের উৎসাহ থাকে না। তা ছাড়া প্রতিদিন কৃষিজমির পরিমাণ কমছে। উর্বর জমিতে ইটভাটায় ভরে গেছে দেশ। শিল্পকারখানা ও বাড়িঘর হচ্ছে কৃষিজমি নষ্ট করে। শুধু ধান চাষে জোর দিলে খাদ্য সমস্যা দূর হবে না। এবারের পেঁয়াজ-কাণ্ড থেকে শিক্ষা না নিলে প্রতিবছর নতুন কোটিপতির সংখ্যা বাড়বে, সেই সঙ্গে বাড়বে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক