বিচ্ছেদি পরিবারে সন্তানের অভিভাবক কে

স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদে সন্তান কার কাছে থাকবে, তা আলোচনা করেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। ছবিটি প্রতীকী
স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদে সন্তান কার কাছে থাকবে, তা আলোচনা করেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। ছবিটি প্রতীকী

মা–বাবার বিচ্ছেদের পর যে সমস্যার মুখোমুখি আমরা প্রথমেই হই, সেটা হলো সন্তানের জিম্মা ও অভিভাবকত্ব নিয়ে। আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় আইনে বা ইসলামি শরিয়া আইনে যা–ই বলা থাকুক না কেন, নাবালক সন্তানের পক্ষে সেটা জানা বা বোঝার কথা নয়। এরপর তো বাস্তবতা আছেই, যা আরও কঠিন।

আমাদের দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে সন্তানের সঙ্গে বাবার চেয়ে মায়ের সম্পর্ক নিবিড়। ব্যতিক্রম নেই, সেটা নয়। তাই দেখা যায়, যেকোনো দম্পতির বিবাহবিচ্ছেদের পর সন্তানকে কেন্দ্র করেই শেষ অবধি টানাটানি শুরু হয়, যে যুদ্ধের প্রভাব আর কারও ওপর না পড়লেও সন্তানের ওপর নানাভাবে পড়ে। এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাবের তুলনায় নেতিবাচকই বেশি।

সন্তানের মনোজগতের বিষয়টি আমরা খুব বিবেচনা করি বলেও মনে হয় না। আমরা আইনি কাঠামো, ধর্মীয় নির্দেশনা আর মা–বাবার আর্থসামাজিক বিষয়টিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। অথচ আমাদের জানা বা বোঝা এবং অভিজ্ঞতার বাইরেও সন্তানের নিজস্ব চিন্তাচেতনা, ভালো লাগা বা না লাগার বিষয় আছে, সেটা আমরা গণ্য করি না। যে কারণে মা–বাবার বিবাহবিচ্ছেদ আর সন্তানের ‘জিম্মা ও অভিভাবকত্বের’ টানাপোড়েনের কুফল কিছুদিনের মধ্যেই পেতে শুরু করি এবং সেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত নয়।

এ যুদ্ধে উভয়েই বিজয়ী হতে চান, তাই সন্তানের মনোজগতের বিষয়টি কেউ খুব একটা বিবেচনা করেন না।

আমরা জানি, কন্যাসন্তানের ক্ষেত্রে তাঁর বিয়ে না হওয়া অবধি এবং পুত্রসন্তানের ক্ষেত্রে সাত বছর বয়স অবধি মায়ের জিম্মায় থাকে। এই সময় বাবা তাঁর সন্তানের প্রতি নিয়মিত দায়িত্ব পালন করে যাবেন, সেটাও আইনেই বলা আছে। কিন্তু বাস্তবতার কারণে বিপরীত মেরুতে বসবাস করায় মাকে প্রায়ই দ্বারস্থ হতে হয় আদালতের। তারপর আদালতের বারান্দাতেই মাকে বাকি দিনগুলো কাটাতে হয়। আইনি জটিলতা—আইনজীবীদের মক্কেলের স্বার্থ উদ্ধারের নানামুখী মারপ্যাঁচ তো আছেই। তবে কি মা কেবল সারা জীবন গর্ভধারণের দায়ই বহন করে যাবেন? আর কিছু নয়?

তারপরও সম্প্রতি আমাদের বিচার বিভাগ সন্তানের জিম্মা ও অভিভাবকত্ব নির্ধারণের বিষয়ে যথেষ্ট সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছে। আদালত বারবার বিবেচনায় আনছেন শিশুর সর্বোত্তম মঙ্গলের বিষয়টি। আইন, ধর্ম, পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করেই এসব রায় হচ্ছে।

বাস্তবতা এই, মায়েরাও যে আইনগত অভিভাবক নিযুক্ত হতে পারেন, সন্তানের জীবন গঠনে মাও যে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, এ বিষয়গুলো সম্প্রতি বিজ্ঞ আদালতে সমাদৃত হচ্ছে। সেসব ক্ষেত্রে আদালত (কন্যা বা পুত্রসন্তানের বয়স যা–ই হোক না কেন) কতগুলো বিষয় সুবিবেচনায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে রয়েছে বাবা বা মায়ের আর্থসামাজিক অবস্থা, তাঁদের ব্যক্তিগত স্বভাব-চরিত্র-আচার-আচরণ-চাল-চলন, যা সন্তানের সার্বিক কল্যাণে কতটুকু ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে বা ফেলতে পারে। বাবা বা মায়ের সন্তানের সঙ্গে সম্পর্ক, যোগাযোগ, বোঝাপড়ার অবস্থা অথবা সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবন গঠনে বাবা বা মা কতটুকু ও কীভাবে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারছেন বা পারবেন—এ সবকিছুই বিবেচ্য হচ্ছে আদালতের কাছে। নানা দিক সূক্ষ্মভাবে বিচার–বিশ্লেষণ করেই ইদানীং বিজ্ঞ আদালত মাকে সন্তানের জিম্মার পাশাপাশি আইনগত অভিভাবকও নিযুক্ত করছেন। বাবার পক্ষ থেকে মাকে সন্তানের জিম্মা দেওয়া নিয়ে খুব বেশি আপত্তি থাকে না। কারণ, জিম্মার কাজটা কঠিন এক গুরুদায়িত্ব। যা কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়, সেটা ‘লিগ্যাল গার্জিয়ানশিপ’ বা আইনগত অভিভাবক নিযুক্তির ক্ষেত্রে।

‘লিগ্যাল গার্জিয়ানশিপ’ মাকে দেওয়ার বেলায় আইনে যা–ই বলা থাকুক না কেন, বিজ্ঞ-আধুনিক-বিজ্ঞানমনস্ক এবং বাস্তবতা অনুধাবনকারী আদালত উভয় পক্ষের শুনানিতে সন্তুষ্ট হয়েই একাধিক মামলায় মাকে সন্তানের আইনগত অভিভাবক নিযুক্ত করছেন। বাবার অধিকার ক্ষুণ্ন করা আদালতের উদ্দেশ্য নয়। সন্তানের সার্বিক মঙ্গলই এখানে বিবেচ্য। এই আদেশ দানের ক্ষেত্রে সন্তানের সঙ্গে বাবার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে বাবার আচরণ, ভাবনাচিন্তা ও সন্তানের প্রতি যথাযথ ভবিষ্যৎ দায়িত্ব পালনে অবহেলা বা উদাসীনতা অনেকাংশে ভূমিকা রাখছে। পক্ষান্তরে সন্তানের মঙ্গলার্থে এবং সব দায়িত্ব পালনে মায়ের জোরালো ও ইতিবাচক ভূমিকাও সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে।

আইনে যা–ই থাকুক না কেন, মানুষের কল্যাণেই আইন। আইনের সার্থকতা সেখানেই, যখন সেটা মানুষের মঙ্গলে কাজে লাগে। সেই জন্যই সম্প্রতি আমাদের বিচার বিভাগ সন্তানের জিম্মা ও অভিভাবকত্ব নির্ধারণের বিষয়ে যথেষ্ট সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছে। কিছু মামলায় মাকে ‘সোল কাস্টডি আর লিগ্যাল গার্জিয়ানশিপ’ দিচ্ছে। মা কেন আইনগত অভিভাবকত্ব পাবেন, সেটা নিয়েও যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিচ্ছে।

মায়ের অবদান কেবল বায়োলজিক্যাল বা সন্তান জন্মদান নয়; মা সন্তানের জীবন গঠনে, ভবিষ্যৎ নির্ধারণে ঘরে-বাইরে সমান ও সমান্তরালভাবেই কাজ করছেন বা করতে পারছেন অথবা পারবেন—এটা নিশ্চিত হওয়ার পরই আদালত এ দায়িত্ব দিচ্ছেন।

যুগ বদলে যাচ্ছে। পরিবর্তিত হচ্ছে মানুষের মন–মানসিকতার। মা আজকাল যতটুকু সন্তানের গর্ভধারিণী হিসাবে বিবেচ্য হচ্ছেন, তার চেয়ে বেশি বিবেচিত হচ্ছে সন্তানের সার্বিক মঙ্গলার্থে মায়ের নিরলসভাবে ঘরে-বাইরে কাজ করে যাওয়া ও করতে পারার সামর্থ্য। তাই মা সন্তানের আইনগত অভিভাবক হতে পারেন—মা সন্তানের সার্বিক মঙ্গলার্থে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, মায়ের সম্পদ ও সম্পত্তিতে সন্তানের যেমন নিরঙ্কুশ ও একচ্ছত্র অধিকার ও দাবি রয়েছে, তেমনি মা সন্তানকে বেড়ে উঠতে বা জীবন গঠনে বাবার চেয়ে কোনো অংশে কম ভূমিকা রাখছেন না বলেই বিবেচ্য।

শিশুর সর্বোত্তম মঙ্গল কোন বাবা বা মা চান না? উভয়েই চান। কেবল উভয়ের অবস্থা ও অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে যেকোনো একজনকে তো দায়িত্ব দিতেই হবে। দু-একটি ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম দেখা গিয়েছে যে বাবা বা মা কেউ চাননি সন্তানের দায়িত্ব নিতে। সেটা ব্যতিক্রম। আর ব্যতিক্রম কখনোই উদাহরণ হতে পারে না। একসময়ের স্বামী-স্ত্রীর মান-অভিমান-জেদ-রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণার শিকার কোনো অবস্থাতেই তাঁদের সন্তান হতে পারে না। এটা কারও কাছেই গ্রহণীয় নয়।

আইনে এবং সমাজে প্রচলনটা এমনই ছিল যে মায়ের কাছেই বাচ্চা থাকবে আর বাবা অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিয়ে যাবেন। সেখানেও মা–বাবার সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর দূরত্ব ও বৈরিতা শুরু হওয়ায় শেষ অবধি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সন্তান।

আজকাল মায়েরাও নানা কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন। নিজের ব্যক্তিসত্তার পূর্ণ বিকাশে কখনোবা নিজেই তাঁর সন্তানের বাবার কাছ থেকে অর্থনৈতিকভাবেও সহযোগিতা নিতে চাইছেন না বা বাবার সঙ্গে বাচ্চার দেখাও হোক, সেটাও চাইছেন না। সে ক্ষেত্রেও শেষ অবধি ফলাফল ভালো আসছে না। একসময়ের স্বামী-স্ত্রীর বর্তমান বৈরী সম্পর্কের ভিকটিম হচ্ছে সন্তান, যা তার বেড়ে ওঠায় বা ভবিষ্যৎ জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আবার ভিন্ন দিকে অধিকাংশ বাবা মনে করছেন, মায়ের কাছেই যখন থাকছে, তবে সন্তানের সব দায় মায়ের।

এই যে আবারও একসময়ের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটা অদৃশ্য দ্বন্দ্বযুদ্ধ, এর ফল কি আমাদের আগামী দিনের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনছে?

আইনে যা–ই থাকুক আর বিজ্ঞ বিচারক তাঁর মেধা, প্রজ্ঞা এবং বিজ্ঞ কৌশলীদের নানামুখী আইনি বিশ্লেষণে যে রায়ই দিন, আমরা এক পক্ষ খুশিমনে মেনে নিচ্ছি বা অন্য পক্ষ সংক্ষুব্ধ হয়ে আরও উচ্চ আদালতে যাচ্ছি নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে। আমরা যেতেই পারি। সংক্ষুব্ধ পক্ষ যেতেই পারে। কিন্তু যাওয়ার আগে আমাদের কি আরেকবার ভাবার সুযোগ আছে বা আমরা কি ভাবতে পারি যে শিশুর সর্বোত্তম মঙ্গলের জন্য আমরা কি আরেকটু সহনশীল হতে পারি না? বারবার আদালতের দ্বারস্থ না হয়ে নিজেরাই কি আমাদের বাচ্চাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে পারি না?

দিলরুবা শরমিন: আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী।