সঞ্চয়ে ও বিনিয়োগে বন্ড

আমাদের দেশে বন্ড ইস্যু করে মূলধন সংগ্রহের সংস্কৃতিটা গড়ে উঠছে না কিংবা তার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে না বলে আক্ষেপের সীমা ছিল না। কিন্তু অতি সম্প্রতি লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হওয়া ১ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলারের (৮৫ টাকা হিসাবে ১৬১ কোটি ৫০ লাখ টাকা) ‘বাংলা বন্ড’ কিছুটা আশার আলো তৈরি করেছে। দেশে না হলেও দেশের প্রয়োজনে বাংলাদেশি টাকা আখ্যায়িত বন্ড বিদেশের মাটিতে বিক্রি করা গেছে এবং সেটা লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়েছে, এটা একদিকে যেমন দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য ব্যাংকঋণের বিকল্প সূত্রের সন্ধান দিচ্ছে, তেমনি দেশের অর্থনৈতিক ভাবমূর্তির জন্য ইতিবাচক একটা দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছে। তবে বাংলা বন্ড যে এত সহজে লন্ডনের মতো বাজারে উতরে গেছে, তার কারণ এটি ইস্যু করেছে বিশ্বব্যাংকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)। এর সফলতার ওপর ভিত্তি করে আইএফসি ভবিষ্যতে আরও বন্ড ইস্যু করবে বলে জানা গেছে, যার পরিমাণ দাঁড়াবে মোট ১০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান এই বন্ড ইস্যু করলে এত সহজে বাজার পেত কি না, সন্দেহ আছে।

বন্ড সম্পর্কে এ দেশের সাধারণ মানুষের ধারণা অস্পষ্ট। বন্ড হচ্ছে একধরনের চুক্তি বা ঋণপত্র। যে চুক্তিপত্র বা ঋণপত্রের বিপরীতে কোনো প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে মূলধন সংগ্রহ করে, সেই চুক্তিপত্র কিংবা দলিলটিই বন্ড। ইংরেজি ‘বন্ড’ শব্দটির অর্থ অঙ্গীকারনামা বা মুচলেকা, ব্যবহারিকভাবেও বন্ড হচ্ছে এটির বিপরীতে যে ঋণ গ্রহণ করা হচ্ছে, সেটি নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিশ্রুত সুদসহ ফেরত দেওয়ার অঙ্গীকারপত্র। অর্থবাজারের পরিভাষায় এই সুদের হারকে কুপনও বলা হয়ে থাকে। সুতরাং ‘কুপন রেট’ বললে বুঝে নিতে হবে, এর মানে সুদের হার। এই ঋণপত্র বা অঙ্গীকারনামার বিপরীতে ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি কিংবা বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করে। তার জন্য অবশ্য বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য অন্যান্য কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয়। বন্ডে বিনিয়োগের বিপরীতে যে সুদের হার উল্লেখ করা থাকে, নির্দিষ্ট বিরতিতে সেই সুদ এবং মূল অর্থের অংশবিশেষ পরিশোধ করা হয়। এই সুদের হার পরিবর্তনশীলও হতে পারে। এ রকম ক্ষেত্রে ট্রেজারি বিল কিংবা বাজারে সুদের হারের ওঠানামার ওপরও প্রতিশ্রুত সুদ বা কুপন হার নির্ভরশীল হয়। বন্ডের ধরনের ওপর নির্ভর করে এই পরিশোধের পরিমাণ ও সময়। পরিশোধের ধরন বিশেষে বন্ড দুই ধরনের, রিডিমেবল এবং কনভার্টেবল। 

রিডিমেবল বন্ডের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় পরপর সুদসহ আংশিক পরিশোধের মাধ্যমে মেয়াদপূর্তিতে এটি সম্পূর্ণভাবে পরিশোধিত হয়ে যায়। অন্যদিকে কনভার্টেবল বন্ডে একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর বন্ডের একাংশ কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে পুরোটাই শেয়ারে রূপান্তরিত হয়ে যায়, অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে বন্ডের ক্রেতা সেই কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারে পরিণত হয়।

মেয়াদের হিসাবে বন্ড সাধারণত দুই ধরনের হতে পারে: পারপিচুয়াল এবং রিডিমেবল। পারপিচুয়াল বন্ড পরিশোধের কোনো নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে না। কোম্পানি অবসায়িত না হওয়া পর্যন্ত এই বন্ড কার্যকর থাকে। পক্ষান্তরে রিডিমেবল বন্ড একটি নির্দিষ্ট সময় পর পূর্ণ পরিশোধের মাধ্যমে অবসায়িত হয়। 

লভ্যাংশ বিচারেও বন্ড দুই ধরনের: কুপনযুক্ত বন্ড ও জিরো-কুপন বন্ড। আমরা এক্ষণে জানি, কুপন অর্থ সুদ, সুতরাং কুপনযুক্ত বন্ডের বিপরীতে ক্রেতা বা বন্ডের ধারক একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর নির্ধারিত হারে সুদ বা লভ্যাংশ পায়। অন্যদিকে জিরো-কুপন বন্ডে মধ্যবর্তী সময়ে কোনো সুদ বা লভ্যাংশ দেওয়া হয় না। মেয়াদ শেষে বন্ডের মালিক বা ধারককে অভিহিত মূল্য অনুসারে প্রতিশ্রুত সম্পূর্ণ পুরো টাকা ফেরত দেওয়া হয়।

ওপরে যে কুপন বা সুদের হারের কথা বলা হলো, সেটা অপরিবর্তনীয় হার, যা বন্ডের পুরো মেয়াদ পর্যন্ত স্থির থাকে। কিন্তু আরেক ধরনের সুদের হার আছে যেটা পরিবর্তনশীল, আর্থ বাজারের পরিভাষায় যাকে ভাসমান (ফ্লোটিং) বলা হয়। এই হার সাধারণত তিন মাস বা ছয় মাসের ট্রেজারি বিলের সুদের হারের ওপর নির্ভরশীল করা হয়। অর্থাৎ ট্রেজারি বিলের সুদের হারের বাড়া-কমার সঙ্গে বন্ডের সুদের হারও ওঠা-নামা করবে।

একটা উন্নত বাজারে যেখানে বন্ডের জন্য সেকেন্ডারি মার্কেট আছে, সেখানে বন্ডের বেচাকেনা বাজার সুদের হারের ওপর নির্ভর করে। সাধারণত ব্যাংক আমানতের ওপর সুদের হার কমে গেলে বন্ডের দাম বেড়ে যায়, কারণ, এ ক্ষেত্রে ব্যাংকে আমানত রাখার চেয়ে বন্ডে বিনিয়োগ অধিকতর লাভজনক। এ রকম পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদি বন্ডের মালিকেরা সেকেন্ডারি বাজারে উচ্চমূল্যে তাঁদের বন্ড মেয়াদপূর্তির আগেই বিক্রি করে দিয়ে বাড়তি মুনাফা লাভ করতে পারেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে একটা পরিণত বাজারে বন্ড থেকে দুভাবে আয় করা সম্ভব, পূর্ণ মেয়াদ ধরে রেখে অর্জিত সুদ কিংবা বন্ডের দাম বেড়ে গেলে সেকেন্ডারি মার্কেটে বিক্রি করেন মুনাফা দিয়ে। 

বন্ড বাজারের এই প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্য কেবল উন্নত অর্থনীতি ও পরিণত আর্থ বাজারের জন্য প্রযোজ্য। বাংলাদেশের অপরিণত বাজারে এসবের বাস্তবায়ন এখনো সুদূর পরাহত। দেশের দীর্ঘমেয়াদি সরকারি বড় প্রকল্পগুলো কিংবা বেসরকারি খাতের শিল্প ও অবকাঠামো খাত বাস্তবায়নে অর্থায়নের জন্য দরকার বন্ড, অথচ এসবের জন্য এখনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা পরিহার করা সম্ভব হয়নি। তাই ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বল্প মেয়াদি তহবিল দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থায়ন করতে হচ্ছে। এটি কোনোভাবেই একটা পরিণত বাজারের প্রবণতা হতে পারে না। কিন্তু বন্ড বাজারের অপরিপূর্ণতাগুলো দূর করা না গেলে পুঁজি সংগ্রহের এই গুরুত্বপূর্ণ উৎসটি অনাবিষ্কৃত ও অব্যবহৃত থেকে যাবে। 

আমাদের অর্থনীতির যে ঊর্ধ্বযাত্রা, সেটিকে ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, আর এই বিনিয়োগের মূল উৎস এখনো রয়ে গেছে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণ, যদিও বাণিজ্যিক ব্যাংক কোনোভাবেই শিল্পায়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণ গ্রহণের যোগ্য উৎস হতে পারে না। এই খামতিটা মেনে নিয়েই সম্প্রসারিত হচ্ছে আমাদের অর্থনীতি। আমাদের বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পুঁজিবাজারমুখী করা যায়নি কোনোভাবেই। এসব শিল্পোদ্যোক্তারা ব্যাংকঋণেই যেন স্বচ্ছন্দ, কারণ বহুবিধ হতে পারে। প্রথম কারণ হতে পারে ব্যাংকের সঙ্গে তাঁরা সুদের হার নিয়ে দর-কষাকষি করতে পারেন এবং ব্যাংকগুলোও দ্রুত মুনাফার হাতছানিতে তাঁদের দাবির কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। দ্বিতীয় কারণ হতে পারে, শিল্পোদ্যোক্তারা তাঁদের বাণিজ্য সাম্রাজ্যে অংশীদার আনতে ইচ্ছুক নন, যাঁদের কাছে লভ্যাংশ এবং অন্যান্য পরিচালন বিষয় তাঁদের জবাবদিহি করতে হয়। তৃতীয় কারণ হতে পারে, ব্যাংক থেকে ঋণপ্রাপ্তি যত সহজে ঘটে, বিভিন্ন নিয়মনীতি পরিপালনের শর্তে পুঁজিবাজার থেকে তহবিল সংগ্রহ করা ততোধিক কঠিন। চতুর্থ কারণ হতে পারে, পুঁজিবাজার থেকে সংগৃহীত মূলধনের বিনিময়ে বিনিয়োগকারীদেরও উদ্যোক্তার সমহারে লভ্যাংশ দিতে হয়, অথচ ব্যাংকঋণ কিংবা বন্ডের ক্ষেত্রে প্রদেয় সুদ মুনাফার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। সুতরাং পুঁজি সংগ্রহের এই পন্থাটি অব্যবহৃত রয়ে গেছে। 

ওপরে ধারণাকৃত অন্ততপক্ষে এই চতুর্থ কারণটির জন্যই শিল্পোদ্যোক্তাদের বন্ড বাজার থেকে তহবিল সংগ্রহ করতে উদ্বুদ্ধ হওয়া সংগত ছিল। কিন্তু অনেক কারণে সেটিও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। অপ্রচলিত এই পন্থাটি গ্রহণ করতে উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করার জন্য যা যা করার দরকার, সেটি করার জন্য কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। এটির জন্য সবার আগে দরকার আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার। বন্ডে বিনিয়োগের প্রধান ঝুঁকি হচ্ছে ঋণঝুঁকি, অর্থাৎ সুদ প্রদান এবং মূল তহবিল ফেরত দানে ইস্যুকারীর ব্যর্থতা বা খেলাপ। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামো এখনো তৈরি করা যায়নি। বন্ড খেলাপের জন্য দীর্ঘ কালক্ষেপণকারী দেওয়ানি মামলা ছাড়া অর্থঋণ আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বন্ড ইস্যুর জন্য রেজিস্ট্রেশন খরচ, স্ট্যাম্প ডিউটি, ইস্যু ম্যানেজার, আন্ডার রাইটিং, ক্রেডিট রেটিং, সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি, লিস্টিং এবং ট্রাস্টি ফি, আইনি খরচ—সবকিছু মিলিয়ে অনেক খরচ লেগে যায়। বন্ড ইস্যু করার পূর্বশর্তগুলো সঠিকভাবে পরিপালন করাও বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রায় অসম্ভব। উপরন্তু সব পূর্বশর্ত পালন করলেও বাংলাদেশের বাস্তবতায় বন্ড ইস্যু করার সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করার জন্য বছরখানেক সময় লেগে যায়। এসব কারণে উদ্যোক্তারা ব্যাংকঋণকেই অধিকতর সহজলভ্য বিবেচনা করেন। এত কিছুর পর যদি বন্ড ইস্যু করার ব্যবস্থা সম্পন্নও হয়, বন্ডে বিনিয়োগকারীদের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় মেয়াদপূর্তির আগে প্রয়োজনে বন্ড বিক্রি করার সেকেন্ডারি বাজারের অনুপস্থিতি। এমনকি বন্ডে বিনিয়োগলব্ধ আয়ে যে কর রেয়াত পাওয়া যায়, সেটিও আমাদের আমানতকারী কিংবা বিনিয়োগকারীদের উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি কেবল একটি যথাযথ বাজারের অভাবে। 

এসব সম্মিলিত কারণে আমাদের দেশে একটা কার্যকর বন্ড বাজার চালু হয়নি। কেবল ব্যাংকগুলো তাদের মূলধন পর্যাপ্ততা রক্ষা করার জন্য বন্ড ছেড়ে মূলধন সংগ্রহ করে থাকে, যার প্রধান ক্রেতা এখন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোই। অথচ একটা কার্যকরী বন্ড বাজার চালু থাকলে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংক নির্ভরশীলতা কমিয়ে সহজেই তাদের মূলধন সংগ্রহ করতে পারত। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থায়নও বন্ড বাজার থেকে আহরণ করা সম্ভব হতো। আমাদের প্রবৃদ্ধির হার সমুন্নত রাখতে হলে বিনিয়োগের যে ধারা বহাল রাখতে হবে, তার জন্য বন্ড বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সংস্কারে আর কালবিলম্ব করার অবকাশ নেই। 

ফারুক মঈনউদ্দীন লেখক ও ব্যাংকার
[email protected]