ফিলিস্তিনকে ইইউর স্বীকৃতি দিতেই হবে

ফিলিস্তিনের কাছ থেকে অনেক ভূখণ্ড ছিনিয়ে নিয়ে ইসরায়েল তা অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে। ছবি: রয়টার্স
ফিলিস্তিনের কাছ থেকে অনেক ভূখণ্ড ছিনিয়ে নিয়ে ইসরায়েল তা অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে। ছবি: রয়টার্স

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত অবসানে দুই-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের যে আশাটুকু এত দিন অবশিষ্ট ছিল, যুক্তরাষ্ট্র সেটুকুকেও হয়তো নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে। সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি স্থাপনকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন নয় বলে ঘোষণা দেওয়ার মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বের একমত হওয়া বিষয়কেই ঠেলে ফেললেন। কাজেই এখন বাকি বিশ্বের পাল্টা ঠেলা দিতেই হবে।

ফিলিস্তিনের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ইসরায়েল যে ভূখণ্ড অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে, সেখানে ইসরায়েলের বসতি স্থাপন নীতি যে আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন, তাতে কারও কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনালগ্নে আয়োজিত চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী, কোনো দখলদার শক্তি ‘অন্য দেশের কাছ থেকে দখল করা ভূমিতে নিজের দেশের সাধারণ জনগণকে পুনর্বাসিত করতে পারবে না।’ ১৯৯৮ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) প্রতিষ্ঠা করেছিল যে রোম স্ট্যাটিউট তাতেই বলা হয়েছে, এ ধরনের বসতি তোলা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। উপরন্তু ১৯৬৭ সালে যখন ইসরায়েল ফিলিস্তিন এবং অন্যান্য আরব ভূখণ্ড দখল করা শুরু করেছিল, তখন নিরাপত্তা পরিষদের ২৪২ নম্বর সনদে তার নিন্দা জানানো হয়েছিল।

২০১৬ সালে নিরাপত্তা পরিষদে আরেকটি সনদ গৃহীত হয়, যাতে পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করা হয়, ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরায়েলের বসতি স্থাপনা গড়ার ‘কোনো আইনি বৈধতা নেই’। ওই সনদে সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপনকে আন্তর্জাতিক আইনের ‘সুস্পষ্ট লঙ্ঘন’ এবং দুই-রাষ্ট্র সমাধানে প্রক্রিয়ার ‘বিরাট বাধা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যায় এমন যেকোনো যৌক্তিক ও সর্বজনস্বীকৃত বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বরাবর যা করে থাকে, সেবারও তাই করেছিল। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসন ওই রেজল্যুশনে ভেটো না দিয়ে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছিল।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেওর সর্বশেষ ঘোষণা আসার দিন কয়েক আগে ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস সেই যুক্তিকেই সমুন্নত রেখে একটি রুলিং দিয়েছে, যাতে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া ভূখণ্ডে ইসরায়েল যে পণ্য উৎপাদন করে, সেসব পণ্যের লেবেলে উৎপাদনস্থলের নাম অধিকৃত এলাকা হিসেবেই উল্লেখ করতে হবে। এরপরও সত্যকে স্বীকার করতে যুক্তরাষ্ট্র গড়িমসি করে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। একমাত্র প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের প্রশাসন ১৯৭৮ সালে ইসরায়েলের বসতি স্থাপন নীতিকে অবৈধ বলেছিল। কিন্তু জিমি কার্টারের উত্তরসূরি রোনাল্ড রিগ্যান জিমির সেই নীতির প্রকাশ্য বিরোধিতা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের অন্য প্রেসিডেন্টরা বসতি নির্মাণকে শান্তি আলোচনার প্রতিবন্ধকতা হিসেবে এর সমালোচনা করলেও সেটিকে তাঁরা অবৈধ বলতে রাজি হননি।

পম্পেওর ঘোষণাকে স্বাভাবিকভাবেই ইসরায়েলের কর্মকর্তারা স্বাগত জানিয়েছেন। দেশটির দক্ষিণপন্থী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু (যিনি সম্প্রতি পার্লামেন্টারি নির্বাচনের সময় দখলকৃত গোটা পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন) বলেছেন, ট্রাম্প প্রশাসন একটি ‘ঐতিহাসিক ভুল’কে শুধরে দিয়েছে। কূটাভাষ হলো এই নেতানিয়াহু নিজেই এখন চ্যালেঞ্জে পড়ে গিয়েছেন। তিনি একটি সরকার গড়তে ব্যর্থ হয়েছেন এবং দুর্নীতির অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে বিচার শুরু হতে যাচ্ছে।

ইসরায়েলে কে সরকার গড়তে যাচ্ছে তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি গড়ার উন্মাদনা ফিরে আসার ঝুঁকিকে খাটো করে দেখা যাবে না। ইসরায়েলের যেকোনো আগ্রাসী সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্র বরাবরের মতোই সায় দিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় তাদের এই আগ্রাসন ঠেকাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেই এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পদক্ষেপে সায় দিলেও ইইউর পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক মুখ্য কর্মকর্তা ফেদেরিকা মঘেরিনি ইসরায়েলের বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ইইউ আগের অবস্থানেই অবিচল আছে: বসতি স্থাপনবিষয়ক সব ধরনের তৎপরতা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অবৈধ’ এবং এটি মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘমেয়াদি শান্তিপ্রক্রিয়া ও দুই-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের সম্ভাবনাকে মাটি করে দিয়েছে।

অন্য যেকোনো বারের চেয়ে এবার ইইউ কঠোরভাবে ইসরায়েলের সমালোচনা করেছে। বিশেষ করে ইসরায়েল হিউম্যান রাইটস ওয়াচের স্থানীয় পরিচালককে বের করে দেওয়া এবং নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের গুলি করার জন্য ইইউ তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তবে শুধু বাগাড়ম্বরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। যদি ইইউ নেতারা সত্যিকার অর্থে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়, তাহলে তাদের সামনে দুটো পথ খোলা আছে। হয় আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে হবে, নয়তো সমঝোতার মধ্য দিয়ে সমাধানে না পৌঁছানো পর্যন্ত ইসরায়েলের প্রতি দেওয়া স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে নিতে হবে।

ইউরোপভুক্ত বেশির ভাগ পার্লামেন্ট ফিলিস্তিনকে ১৯৬৭ সালের আগের সীমান্ত ফিরিয়ে দিয়ে এবং পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে তাকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছে। শুধু সুইডেন এই স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে ‘ঠিক সময়’ উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার পক্ষে মত দিয়েছে। সেই ঠিক সময় এখন সমুপস্থিত হয়েছে। দখলদার ইসরায়েলের হাতে ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে দশক দশক ধরে সহিংসতার চক্র ঘুরতেই থাকবে। এই চক্র শুধু ইইউ ভাঙতে পারে। আর তা করতে হলে ইইউ মুখে যা বলে তা কাজে পরিণত করতে হবে। ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলেই সেটি কার্যকর হবে।

ইইউ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলেই যে ইসরায়েল তার দখল করা জায়গা থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে সরে যাবে, তা নয়। তবে এতে ইসরায়েলের নেতারা ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড লুটে নেওয়ার মতো যেসব উসকানিমূলক কথাবার্তা বলছেন এবং আগ্রাসী কাজ করছেন, তা কিছুটা হলেও বাধাগ্রস্ত হবে। এতে আলাদা দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একটি সম্ভাবনা তৈরি হবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
দাউদ কাত্তাব: ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ও প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা বিষয়ের সাবেক অধ্যাপক