যুদ্ধকালীন আর যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের মধ্যপ্রহরগুলো

>

১৯৭১ সালে আমাদের বিজয়ের মুহূর্তের অভিজ্ঞতা নিয়ে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির লেখা সংকলিত হয়েছিল ১৯৯৩ সালে, ভোরের কাগজ পত্রিকার বিজয় দিবসের ক্রোড়পত্রে। সেই লেখাগুলো নিয়ে প্রথমা প্রকাশন প্রকাশ করেছে বিজয়ের মুহূর্ত ১৯৭১ শিরোনামের একটি বই। এবার বিজয়ের মাসে আমরা বইটি থেকে কিছু নির্বাচিত লেখা প্রকাশ করছি প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য। আজ ছাপা হলো শাফায়াত জামিল–এর লেখাটি।

২২ বছর ধরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় যুদ্ধের স্মৃতিচারণা করেছি। তবে আজকের স্মৃতিচারণা কিছুটা অন্য রকম। বিজয়ের মুহূর্তের স্মৃতি আর অনুভব। ডায়েরি লেখার অভ্যাস নেই বলে প্রতিদিন যে অসংখ্য খুঁটিনাটি ঘটনা তখন ঘটে যেত চারপাশে, তার অনেক কিছুই আজ আর মনে নেই। তবে বিজয়ের সেই মুহূর্ত ছিল এক বিশেষ ক্ষণ।

১৬ ডিসেম্বরে আমি ছিলাম সিলেটে। এর আগে সিলেটের রাধানগরে পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি রাধানগর কমপ্লেক্স দখলের যুদ্ধ হয়। রাধানগর কমপ্লেক্স একটি স্কুল। এই স্কুল আর পাশের ছোটখেল নামে একটা গ্রামজুড়ে ছিল পাকিস্তানিদের ঘাঁটি। এখানে তাদের থার্টি ফ্রন্টিয়ার ফোর্স আর থার্টি ওয়ান পাঞ্জাব ফোর্স—এই দুটি কোম্পানি অবস্থান করছিল।

যুদ্ধ হলো দুই দফায়। প্রথমে ২৬ নভেম্বর। (প্রসঙ্গত, ২১ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনস্থ করা হয়) ২৬ তারিখে যুদ্ধে অংশ নিল ভারতের ফাইভ বাই ফাইভ গোর্খা রেজিমেন্ট। আমি আমার একটি প্লাটুন দিলাম। এর দায়িত্বে ছিলেন নায়েব সুবেদার বদিউর রহমান। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর রাধাখেল কমপ্লেক্স মুক্ত হলেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তানিরা আবার প্রতি-আক্রমণ করে কমপ্লেক্স অধিকার করে নেয়। উভয় পক্ষেই ক্ষয়ক্ষতি হয় প্রচুর। ফাইভ বাই ফাইভ হারায় চারজন অফিসার এবং ৫৭ জন বিভিন্ন পদের সেনা। এরপর ২৮ নভেম্বর আবার আক্রমণ করা হলো। এবার গুর্খা ও আমার ব্যাটালিয়নের যুগপৎ আক্রমণ। পেছনে সাপোর্ট দিল তিন কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা। এবার আমরা রাধানগর কমপ্লেক্স ও ছোটখেল দুটিই পুরোপুরি মুক্ত করলাম। এই যুদ্ধেই আমি আহত হলাম। আমার কোমরে গুলি লাগল। সিলেট অঞ্চলের ভারতীয় বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল গিল। তামাবিল বর্ডার থেকে তাঁর হেলিকপ্টারে করে আমাকে শিলং মিলিটারি হসপিটালে নেওয়া হলো। এখানে আমি ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিলাম।

গিল আমাকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেখতে এসেছিলেন। তাঁর স্ত্রীও আসতেন তাঁর সঙ্গে। তারপর হঠাৎ তাঁর আসা বন্ধ হয়ে গেল। পরে ওই হাসপাতালেরই এক বাঙালি ডাক্তারের কাছে শুনেছিলাম, তিনিও আহত হয়েছেন। তিনি আহত হয়েছিলেন ময়মনসিংহের কামালপুর-জামালপুর সেক্টরে। ইতিমধ্যে আমার ব্যাটালিয়নের ডেল্টা কোম্পানির কমান্ডার ক্যাপ্টেন নবী ও নায়েব সুবেদার বদিউরের প্লাটুন রাধানগর/ছোটখেল দখলের পর আরও এগিয়ে যায়। দখল করে নেয় দক্ষিণ কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট। ক্যাপ্টেন নবী সম্পর্কে এ প্রসঙ্গে একটু বর্ণনা দেওয়া প্রয়োজন। এই অসমসাহসী অফিসার আসলে আর্মি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ সে আমার ব্যাটালিয়নের ডেল্টা ও আলফা কোম্পানির মিলিত ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিল। আমি আহত হওয়ার পর আমার ব্যাটালিয়নের একটি অংশের কমান্ডার হয় সে। ২৬ মার্চে যুদ্ধ শুরুর সময় সে ছিল পাকিস্তানের কোয়েটায়। ২৬ মার্চ সে পিআইএ প্লেনে ঢাকায় আসে। ঢাকা থেকে জিজিরা। জিজিরাথেকে অতঃপর মাগুরায় গিয়ে যুদ্ধে যোগ দেয়। নবীর সঙ্গে মে মাসে আমার কলকাতায় দেখা হয়। বিডিএফ হেডকোয়ার্টারে। আমি তাকে আমার থার্ড বেঙ্গল ব্যাটালিয়নে নিয়ে নিই।

কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট মুক্ত হওয়ার পর নবীকে ছাতকে পাঠানো হলো। ১৪ ডিসেম্বর নবী, ব্রিগেডিয়ার মোহসীন ও ক্যাপ্টেন আকবরের নেতৃত্বে মুক্ত হয় ছাতক।

এরপর নবী অনেক অপারেশন করে সিলেট ঢোকে। ফলে শিলং থেকে সিলেট ফেরার পথে ১৫ ডিসেম্বরের অপরাহ্ণে ছাতক-সিলেট রাস্তায় নবীর সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়। নবীর কাছে জানলাম, রাধানগর ছোটখেল কমপ্লেক্স দখলের পর ওরা অনেক অস্ত্রশস্ত্র পেয়েছে। আর পেয়েছে বেশ কয়েকজন নারীর মৃতদেহ, যাঁদের পালিয়ে যাওয়ার আগে পাকসেনারা হত্যা করে যায়।

পাকিস্তানের পরাজয় ও আত্মসমর্পণ যে অত্যাসন্ন, তা আমরা আগেই অনুমান করেছিলাম; ৩ ডিসেম্বর যখন ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। হাসপাতালে শুয়ে রেডিওতে জেনারেল মানেকশর হুমকি শুনতে পেতাম। তা ছাড়া ইতিমধ্যে লাখখানেক ট্রেনিং পাওয়া মুক্তিযোদ্ধা সে সময় অস্ত্রসহ ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশে।

বিজয় আসন্ন জানলেও সেটা যে ১৬ তারিখেই, তা জানতাম না। যোগাযোগব্যবস্থা ছিল খুব খারাপ। অন্যান্য সেক্টরে কী ঘটছে, সে খবর জানতে অনেক দেরি হতো। হেডকোয়ার্টার ও কমান্ডার ইন চিফের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। সব যোগাযোগই হতো আমাদের সহযোগী অংশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর মাধ্যমে। ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ ১৬ তারিখে হলেও সিলেটে হয়েছিল ১৮ ডিসেম্বর।

সিলেটে আমি উঠেছিলাম আর এইচ বাংলোয়। মেজর জিয়াও সে সময় সিলেটে। যুদ্ধ শেষ হওয়ায় আমরা তখন মোটামুটি নিশ্চিন্ত। নিশ্বাস নেওয়ার অবসর পাচ্ছি। আমাদের সবার মধ্যেই তখন বিজয়ের তুমুল আনন্দের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশ গঠনের সোৎসাহ ভাবনা।

যা-ই হোক, ১৬ ডিসেম্বরে ফিরে আসি। সন্ধ্যায় সার্কিট হাউসে এলাম। মাঠের মাঝখানে বাংলাদেশের ম্যাপ আঁকা পতাকা উড়ছে। মাঠে দাঁড়িয়ে আছেন জিয়াউর রহমান, সিলেটের ডিসি সৈয়দ আহমদ ও এডিসি শওকত আলী। সবারই মুখ থেকে যুদ্ধের ছায়া অন্তর্হিত। আমাদের উপস্থিতির খবর পেয়ে কোথা থেকে যেন হাজার হাজার লোক চলে এল। নিয়াজি যেদিন ঢাকায় নতমুখে আত্মসমর্পণের দলিলে সই করছেন, সেদিনই সায়াহ্নের আধো আলোয় জনতার অভিনন্দনে ডুবে যেতে আমরা ভাবছিলাম সূর্যোদয়ের কথা।

সিলেটে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করল ১৮ ডিসেম্বর। সকাল ১০টার দিকে সিলেট এয়ারপোর্টে আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ সম্পন্ন হলো। আমি এ মুহূর্তে ভারতীয় বা পাকিস্তানি কোনো পক্ষের অধিনায়কদেরই নাম মনে করতে পারছি না। আর সিলেটের উত্তরে খোলা ময়দানে আত্মসমর্পণ করল পাকিস্তানের ১১ থেকে ১২ হাজার সেনা। তাদের রাখা হয় একটি স্কুলে। স্কুলটির নাম সম্ভবত সিলেট মডেল/টেকনিক্যাল স্কুল। পরে তাদের স্পেশাল ট্রেনে ভারতে পাঠানো হয়। যুদ্ধের শেষের দিকে, পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দিন যখন ঘনিয়ে আসছে, সে সময় বুঝতে পারছিলাম আমাদের মধ্যে ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছে একটি আশঙ্কা। তা হলো বিজয়ের পর মিত্রবাহিনীর ফিরে না–যাওয়ার সম্ভাবনা, রাশিয়া পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর ক্ষেত্রে যা করেছিল আরকি। এ ভাবনা একেবারেই অঙ্কুর পর্যায়ে ছিল। তবে সে সময়েই আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল, এ রকম ঘটলে আমরা গেরিলাযুদ্ধের প্রস্তুতি নেব। তবে ভাগ্য ভালো আমাদের সে প্রস্তুতি নিতে হয়নি।

’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। পরবর্তী সময়ে আমাদের বিজয়ের ফল আমরা ধরে রাখতে পারিনি। যে চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে আমরা স্বদেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলাম, আমার বিশ্বাস, ভবিষ্যতে আবার তার স্ফুরণ ঘটবে এবং মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতা রক্ষায় আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আবার সক্রিয় হয়ে উঠবে। [ঈষৎ সংক্ষেপিত]

শাফায়াত জামিল: (১৯৪০-২০১২), অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল, মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বীর বিক্রম উপাধিপ্রাপ্ত