রাজনীতির বাজারে অর্থনীতির সূত্র

অর্থনীতির সূত্রগুলো বেশ মজার এবং একই সঙ্গে কার্যকর। অনেক বছর আগে স্কুলের টেক্সট বইয়ে পড়েছিলাম উৎপাদনের ক্রমিক হ্রাসের নিয়ম। এই সূত্র ধরে কৃষি উৎপাদনের একটা হদিস করা যায়। একই জমিতে একই ধরনের উপকরণ ব্যবহার করতে থাকলে একটা পর্যায়ে এসে শস্যের ফলন কমতে থাকে। অর্থাৎ জমির উৎপাদিকা শক্তি হ্রাস পায়। শস্যের উৎপাদন কমে গেল তো চাষি বসে থাকবেন না। তাঁর চাই আরও বেশি। এখন তো শুধু নিজের পরিবারের সদস্যদের দুমুঠো অন্ন জোগানোর দায় না, বাজারের জন্যও চাষবাস করতে হয়। ফলে জমির উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানো হয় কৃত্রিম উপায়ে। সেখানে নানান রকমের সার ব্যবহার করে আগের মতো কিংবা তার চেয়েও বেশি ফলন পাওয়া যায়। ধীরে ধীরে জমি হয়ে ওঠে রাসায়নিক বিষের ডিপো। একপর্যায়ে এসে জমির স্বাভাবিক উৎপাদনক্ষমতা আর তেমন থাকে না। জমি তখন আর জমি থাকে না, এটি হয়ে যায় কারখানা। সেখানে প্রধান কাঁচামাল হলো সার কিংবা সেচ।

অর্থনীতির এই সূত্রটা রাজনীতির সঙ্গে কেমন যেন মিলে যায়। একটা সময় ছিল, যখন রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ইশতেহারে নানা প্রতিশ্রুতি দিত। মাঠের বক্তৃতায় নেতারা ওয়াদা করতেন, এই করবেন সেই করবেন। মানুষ আশায় থাকত। এই ধারা এখনো বজায় আছে। তবে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের গতি দিন দিন যাচ্ছে কমে। এখন তাঁরা যত না বলেন হেন করেঙ্গা তেন করেঙ্গা, তার চেয়ে বেশি বলেন—ও খারাপ, ওইদিকে যেয়ো নাকো তুমি। দলগুলোর ডেলিভারি দেওয়ার ক্ষমতা কমে গেছে। সে জন্য মানুষ আর আগের মতো জনসভায় পঙ্গপালের মতো ছুটে যায় না। তখন মানুষ টানার জন্য, মাঠ ভরানোর জন্য লোক ভাড়া করে আনা হয়। বস্তিগুলো হলো তাদের প্রধান টার্গেট। এ জন্য বড়সড় বাজেট থাকে, ব্রোকার থাকে। তাঁরা বাস-ট্রাক ভাড়া করে ভাড়াটে শ্রোতা নিয়ে আসেন।

বড় দলের জনসভায় দেখা যায়, সামনে নারীরা বসে থাকেন। নারীরা সামনে থাকবেন, এটাই দস্তুর। তো তাঁদের অধিকাংশের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখলেই বোঝা যায়, নেতার ভাষণের এক বিন্দুও তাঁদের কান দিয়ে মরমে পসে না। জনসভাগুলোতে এমন পুরুষের সংখ্যাও যথেষ্ট। লোক ভাড়া করে আনার দায়িত্ব হলো দলের স্থানীয় সংগঠকের। এ নিয়ে ব্যাপক চাঁদাবাজি হয়। দিনভর রাস্তাঘাট বন্ধ থাকে। তাতে কী? রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বা আবেদন তৈরির ক্রমহ্রাসমান বিধি জারি হয়ে যাওয়ায় রাসায়নিক সারের মতোই প্রক্সি জনতা দিয়ে মাঠ ভরতে হয়। এই ফাঁকিটা ধরা পড়ে সবার চোখেই। তবু এটা বন্ধ হয় না। রাজনীতির প্রতিযোগিতামূলক এই বাজারে লোককে দেখাতে হয়—দেখো, আমাদের দল কত জনপ্রিয়, আমাদের মিটিংয়ে কত লোক! এ যেন নকল পণ্য চকচকে মোড়কে কেনাবেচা করা।

অনেক দিন আগে একটা টক শোতে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে কথা হচ্ছিল। আমি বলেছিলাম, মেয়রের কাজ কী? আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, তাঁর প্রধান কাজ দুটি। এক. দলের জনসভায় লোক সাপ্লাই দেওয়া; দুই. দলের লোকদের ঠিকাদারি দেওয়া।

রাজনৈতিক দলের ভেতরে অনুকূল পরিবেশ না থাকার কারণে ভালো মানুষেরা দল করেন না—এমন একটা কথা চালু আছে। দলের নেতারা এটা মানতে নারাজ। তাঁদের কেউ কেউ বলেন, দল করতে হলে অনেক ত্যাগ করতে হয়, তিতিক্ষা লাগে। যাঁরা ঝোপ বুঝে কোপ মারতে চান, তাঁরা বসে থাকেন কখন দেশে অনির্বাচিত সরকার আসবে, তখন তাঁরা পদ পাবেন। এ নিয়ে কথার লড়াই জারি আছে।

রাজনীতিবিদেরা কিন্তু বলছেন না, তাঁদের দলে সবাই ফেরেশতা। তাঁরা বলছেন, ‘ভালো মানুষেরা’ অর্থাৎ তাঁদের ভাষায় ‘সুশীল’রা সব সুবিধাবাদী। দলের ভেতরের পরিবেশটা যে খারাপ হতে পারে, এটা তাঁরা চর্মচোখে দেখলেও মুখে বলেন না।

আমি একসময় ছাত্রলীগ করতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ তখনো ‘অখণ্ড’। দেখলাম সব হলেই ছাত্রলীগ জনপ্রিয়। কিন্তু রোকেয়া হল আর জগন্নাথ হলে ছাত্রলীগ দুর্বল। ছাত্র ইউনিয়ন সেখানে খুবই সবল। সত্তরের ডাকসু নির্বাচনে দেখা গেল, সব হলে ছাত্রলীগের প্যানেল জিতল। কিন্তু রোকেয়া হল আর জগন্নাথ হলে জিতল ছাত্র ইউনিয়ন। আমাদের তখন কী রাগ! মেয়েরা কেন ছাত্রলীগ করে না? ওরা ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে কী পায়? ‘হিন্দুরা’ কেন ছাত্র ইউনিয়ন করে? আমরা এটা বুঝতে চাইতাম না, ছাত্রলীগের পরিবেশটাই এমন যে মেয়েরা বা অমুসলিমরা তাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। এটা ওদের দোষ নয়, দোষ আমাদের। কিন্তু আমাদের মধ্যে ওই বোধ জাগেনি। উপলব্ধির এই ঘাটতিগুলো অনেক সময় আমাদের বিবেচনাবোধ আচ্ছন্ন করে ফেলে। তখন আমরা সম্ভাব্য মিত্রকে শত্রু মনে করি, মনে করি ষড়যন্ত্রকারী।

এখানে আমি অর্থনীতির আরেকটি সূত্র উল্লেখ করব। এটা হলো গ্রেশামস ল—ব্যাড মানি ড্রাইভস অ্যাওয়ে গুড মানি। রানি ভিক্টোরিয়ার আমলে ইংল্যান্ডের চ্যান্সেলর অব এক্সচেকার ছিলেন গ্রেশাম সাহেব। এটা হলো তাঁদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তিনি দেখলেন ধাতব মুদ্রার খরচ অনেক বেশি। তখন তো সোনা-রূপার মুদ্রা চালু ছিল। তিনি তামার মুদ্রা চালু করলেন সোনার মুদ্রার মানে। দেখা গেল, বাজার থেকে সোনার মুদ্রা সব উধাও। মুদ্রার গায়ে যে মান লেখা থাকে, তার ধাতব মূল্য যদি লিখিত মানের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে সে ওই ধাতু গলিয়ে ধাতু হিসেবেই বাজারে বেচে দেবে।

রাজনীতির ময়দানে একই ছবি। সোনার ছেলেরা আর সোনার নন। তাঁরা তামা-কাঁসার স্তরে নেমে গেছেন। তাঁদের ভিড়ে ভালো ছেলেরা ভেড়েন না। বাজার নকল পণ্যে সয়লাব হয়ে গেলে আসল জিনিসটা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এত আমরা হরদম দেখি। দেখুন না, এত খোঁজাখুঁজি করেও যুবলীগের মধ্যে চেয়ারম্যান হওয়ার মতো কাউকে পাওয়া গেল না। শেষমেশ ধরে আনতে হলো সাহিত্যের এক অধ্যাপককে, যিনি কখনোই রাজনীতিতে ছিলেন না।

পুঁজিবাদের একটা বড় বৈশিষ্ট্য এবং অনিবার্য গন্তব্য হলো মনোপলি বা একচেটিয়া কারবার। বাজারে অগুনতি ছোট উৎপাদক বা বিক্রেতা থাকলেও কয়েকটা বড় কোম্পানির চাপে তারা হারিয়ে যায়। শহরের একটা গলিতে একই ধরনের মাল বেচে—এ রকম হয়তো দশটা মুদি দোকান আছে। হঠাৎ কাছেই বড় রাস্তায় গজিয়ে উঠল সুপারশপ। তার আগ্রাসী ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিংয়ে মুদিদোকানদারেরা পাততাড়ি গোটাতে থাকলেন। এটি আমরা চোখের সামনেই দেখছি।

সুপারশপের ঝলমলে পরিবেশ ক্রেতাকে টানে বেশি। বেশি বেশি লোকের কাছে পণ্য অল্প মার্জিনে বেচলেও মোট লাভ হয় বেশি। এটা ক্রেতার জন্যও সুবিধাজনক। এই মনোপলি কারবার রাজনীতির আসরও দখল করেছে। এ দেশে ডানপন্থী বলুন আর বামপন্থী বলুন, দল তো ডজন ডজন। আশির দশকে খুচরো দলগুলো নিয়ে বড় একটা জোট হয়েছিল। জোটে দল ছিল ৭০-৮০টা। এটা করেছিলেন আ স ম আবদুর রব। কয়েক বছর আগে নাজমুল হুদা এ রকম আরেকটি জোটের ঘোষণা দিয়েছিলেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও একই কাণ্ড করেছিলেন, ৫০-৬০টা ‘ইসলামি’ দলের একটা ফ্র্যাঞ্চাইজি। ওটা কল্কে পায়নি। রাজনীতির বাজারে এখন মনোপলি হলো দুটি দলের—আওয়ামী লীগ আর বিএনপি। দুটিই সুপারশপ। বাকিগুলো মুদিদোকান।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
[email protected]