জয় আসুক নেপালে, শুভকামনা বাংলাদেশ

নেপালের কাঠমান্ডুতে ১৩তম দক্ষিণ এশিয়ান গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান
নেপালের কাঠমান্ডুতে ১৩তম দক্ষিণ এশিয়ান গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান

পদক জয় নয়, অংশগ্রহণই বড় কথা—আধুনিক অলিম্পিকের জনক পিয়ের দ্য কুবের্তিনের সেই অমর উক্তির অনুসারী হয়ে থাকলে আজকাল আর চলে না। বিশেষ করে নিজেদের সামর্থ্য প্রকাশের ক্ষেত্রগুলোতে পদক জয়ে তীব্র একটা চাপ ঘিরে ধরে। যেমন দক্ষিণ এশিয়ান গেমস, একসময় যার পরিচয় ছিল সাফ গেমস। হালে যা এসএ গেমস নাম নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ ক্রীড়ানুষ্ঠানের আড়ালে এ অঞ্চলের ‘অলিম্পিকও’ হয়ে উঠেছে। ১৭০ কোটি মানুষের এই ‘অলিম্পিক’ এখন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের কাছে এক অগ্নিপরীক্ষার নামও। কারণ, এখানেই ফুটে ওঠে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের সামগ্রিক ছবিটা।

সেই ছবিটাই ধরা পড়বে ১-১০ ডিসেম্বর নেপালের তিনটি শহর কাঠমান্ডু, পোখারা আর জানকপুর শহরে ১৩তম এসএ গেমসের আয়নায়। ২৬টি খেলার মধ্যে বাংলাদেশ হাজির হয়েছে ২৫টিতে। হকি বাদে ফুটবল, ক্রিকেট, অ্যাথলেটিকস, সাঁতার, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, কাবাডি, কারাতেসহ প্রায় সব খেলাই আছে। এই বিপুল ক্রীড়াযজ্ঞ উপভোগ করতে তৈরি এই অঞ্চলের ক্রীড়াপ্রেমীরা। গত রোববার গেমসের উদ্বোধনও হয়ে গেছে। গতকাল সকালে আমরা একটি সুখবরও পেয়েছি। তায়কোয়ান্দোতে বাংলাদেশকে প্রথম সোনা এনে দিয়েছেন দিপু চাকমা।

গত ১২টি দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে ১৭২৮টি সোনার মাত্র ৬৭টি জিতেছে বাংলাদেশ। দিপুরটি যোগ করলে ৬৮। মোট পদকের মাত্র ৩.৮৭ শতাংশ। ভারত এবারের হিসাব বাদে ১০৮৮টি সোনা (৬২ শতাংশ)। ৬৪২টি রুপা ও ৩৩৫টি ব্রোঞ্জ নিয়ে মোট ২০৬৫টি পদক জিতেছে। পাকিস্তান ২৬৭টি সোনা পেয়েছে। শ্রীলঙ্কা ২১০, নেপাল ৭৩ এবং মাত্র চারবারের অংশগ্রহণে আফগানিস্তান ২১, ভুটান ২টি সোনা। আজও সোনাশূন্য মালদ্বীপ।

এই ১২টি গেমসে মোট ৫৫৪৫টি পদকের মধ্যে বাংলাদেশের নামের পাশে ৬৪৯টি। ১৭৭টি রুপার সঙ্গে ৪০৫টি ব্রোঞ্জ। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সাফল্য দুবার তৃতীয় হওয়া। দুই অঙ্কের সোনা জিতেছে মাত্র দুবার। দুবারই স্বাগতিক হিসেবে। ১৯৯৩ সালে ঢাকায় ১১টি। ২০১০ সালে ঢাকায় ১৮টি। কিন্তু সেই সাফল্যের পরের আসর ২০১৬ সালে ভারতের গুয়াহাটি ও শিলংয়ে চূড়ান্ত ভরাডুবি। পাহাড়ের চূড়া থেকে যেন সমুদ্রের তলদেশ দর্শন। ১৮ থেকে নেমে মাত্র ৪টি সোনা! গেমসে মোট সোনা ছিল ২২৮টি। যার একটি জিতে ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তারের সেই কান্নার ছবি ভাইরাল হয়েছিল। দুটি সোনা জেতেন অবহেলিত সাঁতারকন্যা মাহফুজা খাতুন। পিস্তল শুটিংয়ে সোনা আনেন শুটার শাকিল আহমেদ। অথচ এই ইভেন্টগুলোতে সোনার কোনো স্বপ্ন ছিল না লাল-সবুজের।

স্বপ্ন কি আসলেই আছে? একেবারেই নেই বলা যাবে না। তবে পরিকল্পনায় বড়সড় ঘাটতি যে রয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক নেই। জাতীয়ভাবেই আজও স্থির করা হয়নি আন্তর্জাতিক ক্রীড়ায় বাংলাদেশ নিজেদের কোথায় দেখতে চায়। এমনকি এই নেপাল এসএ গেমসে তিন শতাধিক সোনার লড়াইয়ে বাংলাদেশ কটি জিততে চায় বা জেতার ক্ষমতা রাখে, সেটাও বোঝা কঠিন। তাই গত ২২ নভেম্বর ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের (বিওএ) কর্মকর্তারা ‘কাঠমান্ডু এসএ গেমসে বাংলাদেশের লক্ষ্য কী’ প্রশ্নটা এড়িয়ে বারবার বলেন, ‘আমরা গতবারের চেয়ে ভালো করতে চাই।’

ভালো তো করাই উচিত। অন্তত ১৫–২০টি সোনা না জিতলে সেটা ব্যর্থতাই হবে। কারণ, এই গেমসের মোড়ল ভারত এবার ফুটবলসহ ১০-১১টি খেলায় দল পাঠায়নি বলে জানা যাচ্ছে। পাকিস্তানও নাকি খেলছে না সাতটিতে। ভারতের চোখ এখন অলিম্পিকে। যার ফলে তারা এসএ গেমসটাকে ঠেলে দিয়েছে পেছনের পাতায়। এই গেমসে অনেক বছর ধরেই ভারত দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির খেলোয়াড় পাঠায়। সেই খেলোয়াড়েরাই ৮০ ভাগ সোনা নিয়ে যান। পাকিস্তানও কিছু ইভেন্টে এখন বিশ্বমানের। এটির গুরুত্ব যা আছে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা বা নেপালের কাছেই বেশি।

বাংলাদেশ এই গেমসের জন্যই অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু অপেক্ষাই সার, উন্নত কোচিংয়ের অভাব সেই স্বাধীনতার পর থেকেই। খেলোয়াড়ের সক্ষমতা বাড়ছে না সেভাবে। ক্রীড়া বাজেট কম। এই এসএ গেমসের জন্য সরকারের কাছে বিওএ ৩০ কোটি টাকা চাইলে সরকার প্রথম ধাপে দিয়েছে ১৫ কোটি। অপর্যাপ্ত অবকাঠামো। খেলোয়াড়েরা অসচ্ছল। ১০-১৫ হাজার টাকার একটা চাকরিই তাঁদের জন্য মহার্ঘ। খেলাধুলার বিজ্ঞানভিত্তিক চর্চাগুলো পুরোপুরি অনুসরণ করতে পারছে না বাংলাদেশ। ফেডারেশনগুলোর বেশির ভাগই লক্ষ্যহীন। গেমস এলে কয়েক মাস আগে ‘ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে’র মতো নড়াচড়া শুরু হয়। অথচ সারা বছর অনুশীলনের খবর নেই। ২০১০ সালে স্বাগতিক হিসেবে সাফল্য পাওয়ার কারণ ছিল টানা এক বছর অনুশীলন। গতবার প্রায় সাত মাস অনুশীলন হয়। এবার মাস চারেক। কান পাতলেই শোনা যায় বেশির ভাগ খেলোয়াড়ের মুখে এ নিয়ে অতৃপ্তি।

অথচ অনেক ক্ষেত্রেই দেশ এগিয়ে চলেছে। কিন্তু সামগ্রিক ক্রীড়ায় সেই ছাপটা নেই। হ্যাঁ, ক্রিকেটে এগিয়েছে ঠিক। ফুটবলও এখন ভালো করছে। কিন্তু ফুটবল-ক্রিকেট দেশের গোটা ক্রীড়ার সামগ্রিক প্রতিচ্ছবি নয়। ক্রীড়া মানে অন্য খেলাগুলোও। সেই খেলাগুলোর ছবিটা বিবর্ণ। অ্যাথলেটিকস এ দেশে প্রায় মৃতই এখন। শুটিংয়ে ১৯৯১ থেকে ৯৫—এই তিনটি দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে ২২টি সোনার ১৫টিই জেতে বাংলাদেশ। তখন ভারতও পিছিয়ে ছিল অনেক। অথচ এবার শুটিং দল নেপাল গেছে বিরাট এক অনিশ্চয়তা সঙ্গী করে। ভারতই এখানে ছড়ি ঘোরায়। এই ভারত গত বছর সর্বশেষ ইন্দোনেশিয়ায় এশিয়ান গেমসে ১৬টি সোনা জিতেছে। ৮টিই অ্যাথলেটিকসে। সঙ্গে ২৪টি রুপা আর ৩০টি ব্রোঞ্জ। অথচ ১৯৮৬ সালের পর এই প্রথম গত এশিয়াডে পদকশূন্য ছিল বাংলাদেশ! এশিয়াডে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের একমাত্র সোনাটি এসেছে ২০১০ গুয়াংজুতে, মোহাম্মদ আশরাফুলের নেতৃত্বে ছেলেদের ক্রিকেটে। যেখানে ভারত ছিল না।

গত এশিয়াডে ৪৩টি দেশের মধ্যে পদকশূন্য ৭ দেশের একটি বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, ভুটানও একই নৌকার যাত্রী। পাকিস্তান ৪টি ব্রোঞ্জ জিতেছে। নেপালের মতো দেশ প্যারামাউন্টিংয়ে ১টি রুপা পেয়েছে। আফগানিস্তান ২টি ব্রোঞ্জ। এই দেশগুলোর অখ্যাত ক্রীড়াবিদেরা বড় মঞ্চে ভালো করছেন।

বাংলাদেশ ভালো করতে পারে জলপাইগুড়ির মেয়ে স্বপ্না বর্মণকে অনুপ্রেরণা মেনে। দারিদ্র্য ও শারীরিক বাধা জয় করে মেয়েটি গত বছর প্রথম এশিয়াডে খেলেই ভারতকে হেপটাথলনে পদক এনে দেন। জন্মগতভাবে তাঁর পায়ে ১২টি আঙুল। তাই মাপমতো কেডস পাওয়া যেত না। এই খেলোয়াড়দের পেছনে ভারত প্রচুর বিনিয়োগ করছে। বাংলাদেশ সেটা করতে পারছে না বলেই এতটা পিছিয়ে থাকা। এগিয়ে যেতে হলে ক্রীড়া ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, দুর্নীতি বিদায় করতে হবে। কিন্তু কীভাবে? এবারের এসএ গেমস উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন খেলার আবাসিক ক্যাম্পে খেলোয়াড়দের দৈনিক খাওয়ার জন্য জনপ্রতি বরাদ্দ ছিল ৬০০ টাকা। অনেক খেলোয়াড়ের অভিযোগ, ২-৩ শ টাকার বেশি তাঁরা পাননি। বাকি টাকাটা ফেডারেশনের কারও না কারও পকেটে চলে গেছে। এভাবে খেলার উন্নয়ন আশা করা দুরাশাই। তবু নেপালে এসএ গেমস দলের জন্য শুভকামনা।

মাসুদ আলম: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি