সর্বনাশা মহাজনি ঋণ

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে কৃষির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। একদা খাদ্যঘাটতির দেশ এখন অনেকটা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু এই খাদ্য যাঁরা উৎপন্ন করেন, সেই কৃষকের জীবনে খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি। তিন বছর আগে বোরো মৌসুমে আগাম বন্যায় কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকার ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কৃষকেরা যে এলাকার মহাজন, বিভিন্ন ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছিলেন, তা এখনো শোধ করতে পারেননি। গত দুই বছর ফসল ভালো হলেও ধানের ন্যায্য দাম পাননি তাঁরা। কৃষকের ধান উৎপাদন করতে যে খরচ হয় উৎপাদিত পণ্যের দাম যদি তার চেয়ে কম হয়, ধান বিক্রি করে তাহলে তাঁরা কখনো ঋণচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন না।

প্রথম আলোর দুই প্রতিবেদক সরেজমিনে হাওরবেষ্টিত উপজেলা ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, নিকলী ও করিমগঞ্জ ঘুরে যে চিত্র তুলে ধরেছেন, তাতে সেখানকার কৃষকের দুঃখ-দুর্দশা উঠে এসেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ মৌসুমে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে ৫৫ হাজার ৮৪৫ হেক্টর জমির প্রায় ৩ লাখ মেট্রিক টন ধান নষ্ট হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হন ১ লাখের অধিক কৃষক। সে সময়ে সরকারের কাছ থেকে কৃষক কিছু সহযোগিতা পেয়েছেন, যা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ফলে অনেক কৃষক ব্যাংকিং ব্যবস্থা, এনজিও ও মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন। ব্যাংক থেকে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ হারে ও এনজিও থেকে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ হারে ঋণ পাওয়া গেলেও মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ পেতে তাঁদের সুদ গুনতে হয়েছে ৫০ শতাংশ হারে।

আরও উদ্বেগের বিষয় মহাজনের ঋণ শোধ করতে না পেরে অনেক কৃষক তাঁদের বাড়িতে ‘বদ্ধ’ খাটতে বা বাধ্যতামূলক শ্রম দিতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে কিশোর রাজীবসহ বেশ কয়েকজন ‘বদ্ধ’ শ্রমিকের কাহিনি উঠে এসেছে। মহাজনের ঋণ শোধ করতে না পেরে তঁারা মহাজনের বাড়িতেই শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। শুধু কিশোরগঞ্জের কৃষকই যে এই সর্বনাশা মহাজনি ঋণের শিকার হচ্ছেন, তা নয়। দেশের সব অঞ্চলেই কমবেশি মহাজনি ঋণ চালু আছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নিতে হলে নানা রকম ঝামেলা পোহাতে হয়। অনেক দলিল-কাগজপত্র দেখাতে হয়। গ্রামের গরিব কৃষকের অনেকের পক্ষে সেটি সম্ভব হয় না। অনেক সময় একশ্রেণির দালাল মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য তাঁদের প্ররোচিত করে থাকেন। অন্যদিকে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে যে ঋণ দেওয়া হয়, তার বেশির ভাগই ধনী কৃষক নিয়ে থাকেন। অনেকে কৃষিঋণ নিয়ে অন্য কাজেও ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ আছে।

যেখানে সরকার ১০ টাকায় কৃষককে ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ দিয়েছে, সেখানে তাঁদের কেন উচ্চহারে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা ও শাখার অভাব নেই। কৃষককে ঋণ দেওয়ার জন্য আলাদা কৃষি ব্যাংক রয়েছে। তারপরও কেন কৃষক ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সহজে ঋণ পাবেন না? হাওরের কৃষককে মহাজনি ঋণচক্র থেকে বের করে আনতে হলে প্রত্যেক কৃষককে ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসন, কৃষি ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে।

যেসব কৃষক বা তাঁদের সন্তান মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ‘বদ্ধ’ খাটতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁদের অবিলম্বে মুক্ত করতে হবে। কোনো সভ্য রাষ্ট্রে এই ‘দাসবৃত্তি’ চলতে পারে না।

আশা করি, কর্তৃপক্ষ হাওরের কৃষকের দুর্দশা মোচনে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।