অপরাধ, শাস্তি ও জাতির দায়

হোলি আর্টিজান মামলায় অভিযুক্ত আটজনের মধ্যে সাতজনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। রাষ্ট্র এবং সম্ভবত জাতি এই শাস্তিই চেয়েছিল। গাইবান্ধার জনপ্রিয় সাংসদ মনজুরুল ইসলাম লিটন হত্যায় মূল আসামিসহ তাঁর সাত সহযোগীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ, বাদী এবং পরিবার ও এলাকাবাসী এতে সন্তুষ্ট হয়েছেন। বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে বুয়েটেরই ২৫ জন ছাত্রকে অভিযুক্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে এবং তাঁদের সবারই সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ড দেশের আপামর মানুষকে স্তম্ভিত, বেদনার্ত এবং ক্ষুব্ধ করেছিল। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রায় সবাই এ ধরনের নির্মম অপরাধে জড়িতদের ফাঁসিই চেয়েছিলেন। শোনা যাচ্ছে, বুয়েটের নিজস্ব তদন্তে আবরার হত্যায় জড়িত প্রায় ৬০ জনের নাম এসেছে। তাঁদেরও হয়তো সর্বোচ্চ দণ্ডই মানুষ কামনা করবে।

বিচারে দোষী প্রমাণিত হলে অপরাধ অনুযায়ী অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। দেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল, তার খেসারত এ জাতি দীর্ঘদিন দিয়েছে। এ রকম প্রেক্ষাপটেই নাগরিক সমাজের তরফ থেকে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি ওঠে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড এবং একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শেষ পর্যন্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। অপরাধীদের অনেকের ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয়েছে। আমরা মনে রাখব, ২০১৩ সালে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে প্রথমে দেশের তরুণসমাজ ও তারপর সর্বস্তরের জনগণ দেশদ্রোহী অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি তুলেছিল। শাসকদের অবহেলায় বিচার বিলম্বিত ও ব্যাহত হওয়ায়, এমনিতেই জাতির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছিল। তারা বিচার, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে কালক্ষেপণের ঝুঁকি নেয়নি, সরাসরি দণ্ডের মাত্রা ঠিক করে দিয়ে প্রায় এক দফা, এক দাবিতে পৌঁছেছিল। এসবই স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ক্ষুব্ধ জাতির ন্যায়সংগত প্রতিক্রিয়া, স্বাভাবিক প্রত্যাশা। তবু এখনকার প্রবণতা দেখে একবার বোধ হয় একটু থেমে গভীরভাবে কিছু বিষয় ভাবা দরকার—জাতির প্রয়োজনে, ভবিষ্যতের বিবেচনায়।

২.
অস্বীকার করা যাবে না যে দেশে অপরাধ বেড়েছে। দেখা যাচ্ছে, সামান্য দ্বন্দ্বে কিংবা তুচ্ছ স্বার্থে মানুষ খুনের মতো অপরাধ করতে পিছপা হচ্ছে না। পরকীয়া, দাম্পত্য কলহ, প্রেমে ব্যর্থতা, জমি ও সম্পদ দখলসহ বিভিন্ন অপরাধে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে খুন করছে। ধর্ষণ, গণধর্ষণ বেড়েছে, শিশুও রেহাই পাচ্ছে না, ধর্ষণের পরে খুনও বেড়েছে। আবার এলাকাভিত্তিক ÿক্ষমতাধর ব্যক্তির উত্থান ঘটেছে, যারা এলাকার দখল ও সর্বময় ÿক্ষমতা ধরে রাখার জন্য খুন-জখমসহ সব ধরনের অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। এরা প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হাতে রেখে বিচারের পথও রুদ্ধ করে রাখে।

এভাবে একদিকে ভুক্তভোগীদের মনে ক্ষোভ জমে আর কখনো সুযোগ পেলে তারা রক্তের বদলে রক্ত, খুনের বদলে খুন নীতিতেই প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে সমাজে প্রতিহিংসার মনোভাব বাড়ছে। সমাজ থেকে কেবলই দাবি উঠছে কঠোর আইনের এবং অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তির। কিন্তু এটিই তো অপরাধ হ্রাসের একমাত্র পথ নয়। আইনজ্ঞরা বলেন, বেশির ভাগ অপরাধের বিচারে প্রচলিত আইনই পর্যাপ্ত। কিন্তু বিচারহীনতার ফাঁদে পড়ে বঞ্চিত-প্রতারিত জাতি যা আছে, তার ওপর আস্থা হারিয়েছে। তা ছাড়া ন্যায়বিচার না পাওয়ার শঙ্কা থেকে অনেকেই প্রতিকারের ব্যবস্থা নিজের হাতে তুলে নিতে চান।

কিন্তু অপরাধ, অপরাধপ্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এ-ই কি একমাত্র পথ? বরং মানুষ যদি এই প্রবণতায় আটকে যায়, তবে সমাজে ঘৃণা-বিদ্বেষ-প্রতিহিংসার চর্চা বাড়বে না? আমরা সমাজে তেমন আলামতই দেখছি। কিন্তু ঘৃণা বা বিদ্বেষ কিংবা প্রতিহিংসার পথে কোনো সমাজের পক্ষে সত্যিকারের মহান জাতি গঠন সম্ভব নয়।

কেবল অপরাধীকে কঠোর শাস্তি দিয়ে অপরাধপ্রবণতা বন্ধ হবে না। আইনি বিচার একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, জনবহুল কৃষিপ্রধান দেশে জমিজমা, সম্পত্তিসংক্রান্ত অপরাধ ও মামলার পরিমাণ সব সময়ই বেশি। ক্রমবর্ধমান মামলার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলার মতো বিচারিক ব্যবস্থাও তৈরি হয়নি এতকালে। এ দেশে সেই বহুল উচ্চারিত ইংরেজি প্রবাদটি সত্য হয়েছে—বিচার বিলম্বিত হয়ে ভুক্তভোগী মানুষের ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির অধিকার অস্বীকৃত হচ্ছে। তা ছাড়া আদালতের সংস্কৃতি এবং আগ্রাসী পক্ষের নানা ভয়ভীতি, হেনস্তা ও উৎপাতের বাধা তো রয়েছেই। সবটা মিলিয়ে সমাজে এক দিকে আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে সংশয়, অনাস্থা, অসহায়তা আর অন্যদিকে তার মনে জোরদার হতে থাকে সর্বোচ্চ শাস্তির বাসনা। এ জন্য চাপ প্রয়োগের সুযোগ থাকলে সেটা সে দেবেই।

অর্থাৎ বিচারব্যবস্থায় দক্ষতা, সততা এবং তাতে মানুষের আস্থা ফিরে না এলে সম্ভবত জাতির পক্ষে ঘৃণা-বিদ্বেষ-ক্রোধ-প্রতিহিংসা এবং প্রতিপক্ষতার চর্চা বন্ধ করা মুশকিল। কিন্তু এসবই তো মানুষের নেতিবাচক রিপু। কখন জাতি মহত্ত্ব, ঔদার্য বা ক্ষমার মতো উচ্চ নৈতিকতার চর্চা করবে। জাতীয় নেতাদের কি এ বিষয়ে ভাবতে হবে না?

সমাজে প্রতিপক্ষতার মনোভাবের সূত্রে আরও একটু পেছনে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ টানা যায়।

৩.
মুক্তিযুদ্ধ জাতীয় ইতিহাসে বীরত্ব ও ত্যাগের মহত্ত্বে ভাস্বর এক অধ্যায়, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু যুদ্ধের বাস্তবতা অনুযায়ী, এ সময় শতভাগ নিজের পক্ষে থেকে বিপক্ষের শতভাগ ক্ষতিসাধন ও বিনাশই ছিল কাম্য। নিরপেক্ষতার সুযোগ যুদ্ধকালে থাকে না, কেননা সে অবস্থান তো নিষ্ক্রিয়তা, যা শত্রুর বিরুদ্ধে শতভাগ দেওয়ার শর্ত ভঙ্গ করে।

এ কারণেই যুদ্ধে শ্রেয়নীতির আদর্শ রক্ষিত হয় না, মানবিক বিবেচনা সব সময় রক্ষা করা যায় না। আমাদের দেশে ১৯৭১ সালে যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে তা বিচ্ছিন্ন কিছু রণাঙ্গনে সীমাবদ্ধ থাকেনি, সারা দেশে নয় মাস ধরেই প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে এটি জারি ছিল। এ যুদ্ধ আমাদের দিক থেকে কেবল পেশাদার সৈনিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, এ যুদ্ধে পুরো জাতিই জড়িয়ে পড়েছিল। তখনকার অভূতপূর্ব ঐক্য, অপরিসীম ত্যাগ এবং ব্যক্তি ও সমষ্টির বীরত্বব্যঞ্জক ভূমিকা কেবল অবিস্মরণীয় ঘটনাই নয়, তা জাতির মহৎ এক উত্তরাধিকার। যুদ্ধের পরে বিজয় এসেছে, সাফল্য ঘটেছে, লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে, মহানায়ক বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়ে স্বদেশে ফিরে জাতির নেতৃত্ব হাতে তুলে নিয়েছিলেন।

যুদ্ধ জাতিকে সর্বোচ্চ প্রতিদান দিয়েছে—স্বাধীনতা। রেখে গেছে ৩০ লাখ শহীদ ও কয়েক লাখ নারীর আত্মত্যাগের কাহিনি। যুদ্ধে সাফল্য এসেছে কারণ, এ দেশের অধিকাংশ মানুষ এটিকে জাতীয় কাজ হিসেবে গণ্য করেছে বলে ব্যক্তির ত্যাগ ও বীরত্বের মাধ্যমেই এই সামষ্টিক অর্জন। যুদ্ধের সময় যারা সরাসরি শত্রুপক্ষের হয়ে কাজ করে, যারা মানবতার বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, নিপীড়নের মতো অপরাধে লিপ্ত হয় তাদের বিচার হতেই হবে, শাস্তিও তাদের প্রাপ্য।

যুদ্ধকালীন এই প্রতিপক্ষতার বিচারিক এবং রাজনৈতিক-সামাজিক নিষ্পত্তি জাতির অগ্রগতির জন্যই দ্রুত সম্পন্ন করা প্রয়োজন। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী সাধারণ ÿক্ষমা এবং বিচার—দুটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু কাজটি সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা সম্পন্ন করার সুযোগ তিনি পাননি। তাঁকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরে সামরিক শাসকেরা প্রতিপক্ষতার মনোভাবকে গোটা জাতির বিভাজন পর্যন্ত টেনে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। এসবই জাতীয় জীবনের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা।

আমরা দেখছি স্বাধীন দেশে রাজনৈতিক খুনোখুনি থামেনি, কেবল বেড়েছে। এর মধ্যে অন্তর্দলীয় কোন্দলের কারণে মৃত্যুও কম নয়, তরুণদের মধ্যেই নিহতের সংখ্যা বেশি। যেকোনো যুদ্ধের পরে সমাজে সমঝোতা ও শান্তির বাতাবরণ তৈরির কাজও করতে হয়, যা আমরা উপেক্ষা করেছি। এভাবেই সমাজজীবন চলতে থাকলে একটি জাতির জন্য মানবিক গুণের সর্বোচ্চ প্রকাশ এবং তা থেকে সমঝোতা ও শান্তি-স্বস্তিতে সহবাসের সংস্কৃতির বিকাশ ব্যাহত হতে বাধ্য। সাম্প্রতিক ইতিহাসে আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডার গণহত্যার বীভৎসতা আমরা জানি। হুতু-তুতসি দুই জাতিতে বিভক্তি এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস ও ঘৃণার চর্চা ইতিহাসের ভয়াবহ গণহত্যার জন্ম দিয়েছিল। মাত্র তিন মাসে প্রায় ৮ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল। এটি ১৯৯৫ সালের ঘটনা। কিন্তু এর পরে এক দশকের মধ্যে দেশটি গণহত্যার ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। কিছু বড় অপরাধীর বিচার হয়েছে, কিন্তু মূল গল্পটি হলো গণহত্যার শিকার জাতির পুনর্মিলনের উদ্যোগে (reconciliation) সাড়া দেওয়া। সেখানে ÿক্ষমা, ঔদার্যের মতো মহৎ গুণের চর্চা হয়েছে, দেখা গেছে আগামীর ও সমষ্টির প্রয়োজন বোঝার দূরদর্শিতা।

৪.
জাতিকেই অর্থাৎ সে জাতির নেতৃত্বকেই ঠিক করতে হবে সমাজে অবিশ্বাস, ঘৃণা, ক্রোধ, প্রতিহিংসা ও সংঘাতের সংস্কৃতির চর্চা অবাধে চলবে, নাকি মানবিক গুণাবলি, যথা ক্ষমা, মহত্ত্ব, প্রীতি, প্রেম, সৌহার্দ্য ইত্যাদি চর্চায় গুরুত্ব দেওয়া হবে। সমাজে অনুতাপ-সন্তাপ-সহমর্মিতার চর্চা হবে না? প্রথম ধারায় সুযোগসন্ধানী ও বেপরোয়া উচ্চাভিলাষী মানুষেরাই সব সুযোগ আত্মসাৎ করে নানা ভেক ধরে, নানান ফিকিরে তারা নিজেদের ভাগ্য গড়ে তোলে—কিন্তু তা সব সময় ঘটে অন্যের হানি ঘটিয়ে, অন্যকে কষ্ট দিয়ে এবং সমাজে বিভাজন তীব্রতর করে। এ রকম বাস্তবতায় লুণ্ঠন, দুর্নীতি, খুন, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণসহ কোনো অপরাধই বাদ যায় না।

এভাবে তো আর চলতে পারে না। আইনের প্রয়োগ ঘটাতে হবে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সেই সঙ্গে মহৎ উন্নত জাতি তৈরির বাতাবরণ তৈরি করতে হবে।

আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক