জলবায়ু উদ্বাস্তুরা কোথায় যাবে

স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে ২ ডিসেম্বর থেকে কপ-২৫ (কনফারেন্স অব পার্টিজ) জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন শুরু হয়েছে। চলবে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এএফপি ফাইল ছবি
স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে ২ ডিসেম্বর থেকে কপ-২৫ (কনফারেন্স অব পার্টিজ) জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন শুরু হয়েছে। চলবে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এএফপি ফাইল ছবি

একবার পরিবেশবিজ্ঞানী ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ আতিক রহমানকে জিজ্ঞেস করলাম, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ার ফলে দেশের বিরাট এলাকা যদি ডুবে যায়, তাহলে এই জলবায়ু উদ্বাস্তুরা কোথায় যাবে? দেশে তো জায়গা নেই। তিনি বললেন, আমেরিকায় যাবে! সেখানে তো বিরাট এলাকা বিরান পড়ে আছে।

তাঁর যুক্তিটা হলো জলবায়ু সংকট সৃষ্টির জন্য দায়ী দেশগুলোর এক নম্বরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো। ওরা এত বেশি তেল ও জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ায় যে আবহাওয়ামণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড বেশি হারে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন দ্রুততর হচ্ছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে। এটাই হয়েছে আমাদের মতো দেশের জন্য মহাবিপদ। উপকূলবর্তী অনেক অঞ্চল সমুদ্রে তলিয়ে যেতে পারে। লবণাক্ততা বেড়ে চরম সংকট সৃষ্টি করবে। ইতিমধ্যেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।

স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে ২ ডিসেম্বর থেকে কপ-২৫ (কনফারেন্স অব পার্টিজ) জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন শুরু হয়েছে। চলবে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত। আলোচনা হবে ২০৫০ সালের মধ্যে কীভাবে ‘কার্বন নিউট্রালিটি’ অর্জন করা যায়। অর্থাৎ কার্বন নিঃসরণ এমনভাবে কমিয়ে আনতে হবে যেন ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের সময়ের বায়ুমণ্ডলের বৈশ্বিক গড় উষ্ণতার চেয়ে ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশি বাড়তে না পারে। এর মধ্যে সীমিত রাখতে হবে। ইতিমধ্যে ১ ডিগ্রি বেড়েছে। পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলছেন, ২ নয়, আরও কম—দেড় ডিগ্রির মধ্যে সীমিত রাখতে হবে। তাহলে হয়তো বাঁচার আশা আছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদ্রিদ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়ে বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন এখন প্রতিটি দেশ, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো জলবায়ুজনিত অরক্ষিত দেশগুলোর জন্য অস্তিত্বের হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে।

২০১৫ সালে প্যারিস শীর্ষ সম্মেলনে ১৮৮টি দেশ সিদ্ধান্তে এসেছিল যেন ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রির বেশি বাড়তে না পারে। এ জন্য কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ অন্তত ৩৬ গিগাটনের মধ্যে সীমিত রাখতে হবে। যদিও সেটা ২ ডিগ্রি উষ্ণতা বৃদ্ধি ঠেকাতে যথেষ্ট নয়। এখন গবেষকেরা হিসাব করে দেখছেন, আগামী ২০ বছরে বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ প্রায় ৪১ গিগাটনে পৌঁছাবে। তার মানে বিপদ আসন্ন (দেখুন, দ্য ইকোনমিস্ট, ২৩-২৯ নভেম্বর ২০১৯)।

ইতিমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝাপটা লাগতে শুরু করেছে বিভিন্ন দেশে। আমেরিকাও বাদ যাচ্ছে না। দাবানল, খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসে বিশ্বের কয়েক শ কোটি মানুষ আক্রান্ত। আবহাওয়া বিভাগ বলছে, ২০১৯ সালটি হবে তিনটি উষ্ণতম বছরের একটি। জাতিসংঘ মহাসচিব ‘জলবায়ু জরুরি অবস্থা’র কথা বলছেন।

বিশ্ব যদি এখনো সংবিৎ ফিরে না পায়, তাহলে অনেক প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কারণ, বৈশ্বিক উষ্ণতা যদি দেড়-দুই ডিগ্রি বৃদ্ধির মধ্যে ধরে রাখতে না পারা যায়, তাহলে ওরা টিকে থাকতে পারবে না।

অনেকে বলেন, আগেও অনেকবার উষ্ণায়ন ঘটেছে, কিন্তু প্রাণিকুল বিলুপ্ত হয়নি। তাহলে এবার কেন হবে? এবার হবে, কারণ আগে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটেছে হাজার হাজার বছর ধরে। ফলে প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা পেয়েছে। পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী খাপ খাইয়ে নেওয়ার পর্যাপ্ত সময় পেয়েছে। কিন্তু এবার মাত্র শ খানেক বছরের মধ্যে জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে চলেছে। এর ফলে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

আমরা জানি না ভবিষ্যৎ কতটা বিপর্যয়কর হতে পারে। অনেক বিজ্ঞানী বলছেন, নতুন কিছু আবিষ্কার বায়ুমণ্ডলের কার্বন শোষণের উপায় বের করতে চলেছে। যেমন কৃত্রিম সবুজ পাতা বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে অক্সিজেন ফিরিয়ে দেবে। অথবা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বনাঞ্চল ও পতিত জমিতে গাছের চারা উড়োজাহাজে এনে আকাশ থেকে সরাসরি রোপণ করা হবে। এতে প্রতিবছর কোটি কোটি নতুন গাছ জন্মাবে। বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের অভাব থাকবে না। এ রকম আরও অনেক আবিষ্কারের কথা শোনা যায়। কিন্তু কোনোটাই এখনো পরীক্ষিত ও নির্ভরযোগ্য নয়।

তাই এখন আমাদের বিকল্প নবায়নযোগ্য জ্বালানির কথা ভাবতে হবে। সেখানে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি ও জলবিদ্যুতের ওপর বেশি জোর দিতে হবে। তাহলে হয়তো বিপর্যয় এড়ানোর একটা উপায় বের হবে।

আমাদের পরিষ্কার বুঝতে হবে, পৃথিবী ধ্বংসের প্রান্তে। সব দেশে গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপাদন কমিয়ে ক্রমে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। এই মুহূর্তের জন্য এটাই হবে ‘ক্লাইমেট জাস্টিস’ বা জলবায়ু সুবিচার। এর বিকল্প নেই।

আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
[email protected]