প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপ প্রত্যাশিত

উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশে দীর্ঘ মেয়াদে খুন ও ধর্ষণের মতো মামলার তদন্ত কার্যক্রম স্থগিত থাকার খবর উদ্বেগজনক। সম্প্রতি আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে জেনেছি যে আলোচিত সগিরা মোর্শেদ হত্যাকাণ্ড মামলার বিচার কার্যক্রম টানা ২৭ বছর ধরে স্থগিত ছিল। এ রকম একটি আলোচিত মামলা, যেখানে ভাড়াটে ঘাতকেরা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে, সে রকম পর্যায়ে বিচার বন্ধ থাকবে, রাষ্ট্রপক্ষ নির্লিপ্ত থাকবে, সেটা মার্জনা করা চলে না।

এখন আবার নতুন করে তথ্য বের হলো যে ২ থেকে ২১ বছর পর্যন্ত ফৌজদারি মামলার তদন্ত বা বিচার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে, এ রকম মামলার সংখ্যা ১২৬টি। দেশের অন্যতম সবচেয়ে পুরোনো গোয়েন্দা সংস্থা সিআইডি। তারাই খুঁজে ১২৬ মামলার তালিকা করেছে। সুতরাং অন্যান্য সংস্থার দায়ের করা মামলার ক্ষেত্রেও এ রকম স্থগিতাদেশ থাকতে পারে। সার্বিক বিচারে এটা খুবই স্পষ্ট যে এত বিপুল সংখ্যায় ফৌজদারি মামলা বছরের পর বছর ধরে স্থগিত থাকার বিষয়ে প্রধান দায় রাষ্ট্রপক্ষকেই নিতে হবে। কারণ, তারা শুনানির উদ্যোগ না নিলে আদালতের পক্ষে পুরোনো মামলা খুঁজে বের করে
অগ্রাধিকার দিয়ে মামলা নিষ্পত্তি করা দুরূহ। অবশ্য তা অসম্ভব নয়। রাষ্ট্রপক্ষকে সক্রিয় করে তোলার একটা উদ্যোগ আদালতের তরফে থাকবে, সেটাও প্রত্যাশিত। এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে আলোচ্য ১২৬ মামলা স্থগিত থাকার ঘটনা নিশ্চয় উন্নত মামলা ব্যবস্থাপনা নির্দেশক নয়, বরং এ ধরনের তথ্য ৩৫ লাখ মামলাজটে জবুথবু আমাদের বিদ্যমান বিচারব্যবস্থার দুর্বলতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

তবে আমরা আশা করব, এই মুহূর্তে স্থগিতাদেশ থাকা মামলাগুলোর বিষয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির উদ্যোগ নেওয়া অসম্ভব নয়। এসব মামলার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকলে সেটা একটা গভীর অনুশোচনীয় বিষয় এবং সংশ্লিষ্টদের মানতেই হবে যে এটা অব্যাহতভাবে একটা পদ্ধতিগত মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। ভুক্তভোগী ও সন্দেহভাজন অভিযুক্ত প্রত্যেকেই দ্রুত বিচারলাভের দাবিদার। আর দ্রুত বিচারের প্রাণ হচ্ছে অপরাধ সংঘটনের পরপরই তদন্তকাজ পরিচালনা এবং তার ফলাফল বিচারালয়ে পৌঁছে দেওয়া। তদন্ত কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত থাকলে তা মামলাটির ভিত্তিমূলেই কুঠারাঘাত হানে। কারণ, সাক্ষ্য–প্রমাণ ও আলামত নষ্ট হয়, সাক্ষীদের স্মৃতিহানি ঘটে। সুতরাং অনির্দিষ্টকাল ধরে তদন্ত স্থগিত রাখা একটা ভয়ানক ব্যাপার।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযোগ গঠনের পরে বিচার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেওয়া আছে, যা আরও বেশি পীড়াদায়ক। তবে বাংলাদেশের বাস্তবতায় এমন বহু মামলা দায়ের হতে পারে, যা অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এর কার্যক্রম চলতে দেওয়াটাই আইনের শাসনের পরিপন্থী। কিন্তু তাই বলে উভয় পক্ষকে শুনে মামলা চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি না করে শুধু অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের ওপর কালক্ষেপণ গ্রহণযোগ্য নয়। এটা অনুমেয় যে উল্লিখিত ১২৬ মামলার কার্যক্রম সিংহভাগ ক্ষেত্রেই অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে স্থগিত আছে।

অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরকে অবশ্যই এ বিষয়ের অচলাবস্থা নিরসনে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর সম্মেলনে ঘটে দেশের প্রথম রক্তক্ষয়ী জঙ্গি হামলা। এতে শিল্পীসহ ১০ জন নিহত এবং দেড় শতাধিক মানুষ আহত হন। স্থগিতাদেশের কারণে এই মামলা ২০১৫ সাল থেকে থেমে আছে। গত চার বছরেও রাষ্ট্রপক্ষ যে এ বিষয়ে শুনানি করতে উদ্যোগী হলো না, তা একটা বিস্ময়।

আমরা মনে করি, দীর্ঘদিন স্থগিত থাকা মামলাগুলোর শুনানি অন্তে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির বিষয়ে প্রধান বিচারপতির যথা প্রশাসনিক হস্তক্ষেপও একটা আশু প্রতিকার দিতে পারে। এ বিষয়ে বিশেষ বেঞ্চ গঠনে প্রধান বিচারপতির এখতিয়ার নিরঙ্কুশ।